আগের পর্বের লিন্ক
"তরী আর চন্দ্রালোকের নীল ডায়েরী"
:
:
"আবির আর চন্দ্রার পরিচয় হয়েছিল একুশের এক বইমেলায় আজ থেকে প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে। চন্দ্রার তখন ষোল আর আবিরের আঠারো। সেখান থেকেই ওদের ভালোলাগা, ভালোবাসার শুরু। ভালোবাসার সাথে শুরু হয় কত রকমের পাগলামি। এক সাথে ভোর দেখা, সুর্য্য ডোবা দেখা, কদম ফুলের মালা গাথা.. রাত দুটায় চুপি চুপি ছাদে বসে জ্যোৎস্না দেখা। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আইসক্রিম খাওয়া, বৃষ্টিতে ভিজে প্রথম চুমু খাওয়া। আরও কত রকমের মিস্টি পাগলামিতে ভেসে যাওয়া! প্রতিদিন একবার দেখা বা কথা হওয়াটা দুজনের যেন অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়। হোক সেটা ছাদে বা রাস্তায় বা ১০ সেকেন্ড এর জন্য হলেও দেখা বা কথা যেন হতেই হবে।
দেখতে দেখতে কিভাবে যেন দুবছর চলে যায়। চন্দ্রা যখন কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন আবির ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পড়তে ইন্ডিয়ার ব্যাঙ্গালোরে এ ভর্তি হয়। দুজন দুজনকে ছেড়ে এতো দুরে কিভাবে থাকবে এই ভেবেই যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে। এমনি এদের ব্যাপারটা চন্দ্রার বাবা একদম মেনে নেয়নি। কিন্তু কিভাবে থাকবে দুজন দুজনকে ছেড়ে..। এই বয়েসটাই কেমন জানি... মানুষ এমন সব দুঃসাহসের কাজ করে বসে যা হয়তো অনেক ম্যাচুউরড মানুষও করতে পারেনা।
ইন্ডিয়া যাবার আগের দিন চন্দ্রা আর আবির একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলে। ওরা কাজি ওফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলে। তারপর বিকেলে যে যার বাসায় চলে যায়। কথা ছিল পরাশুনা শেষ করে দুজোন দুজনের পরিবার কে জানাবে। কত স্বপ্ন চোখে কত ভাবনা... এমনকি ওদের কোল জুড়ে যে মেয়ে আসবে তার নাম ও ঠিক করে ফেলে: "তরী" জাফরিন জারা তরী। কিন্তু আবিরের আর পড়াশুনা করার জন্য ইন্ডিয়া যাওয়া হয়নি..। বিয়ের পর বাসায় যাবার পথেই সে রোড এক্সিডেন্ট করে। আবিরকে যখন হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় তখনও ওর জ্ঞান ছিল। মাকে মারা যাবার আগে ওদের বিয়ের ব্যাপারটাও বলে যায়। তখন মোবাইল ছিল না। আনালগের যুগ। চন্দ্রা যখন আবিরের এক্সিডেন্টের খবর পায় তখন রাত দুটো বাজে। আবিরের মা ফোন করে চন্দ্রার বাবার সাথে প্রথমে কথা বলে সব ঘটনা জানায়। চন্দ্রার রাগী বাবাটা ঘটনা শুনে বাচ্চাদের মত হয়ে শোকাতুর হয়ে গেলো। মেয়েকে ঘুম থেকে আলতো করে ডেকে বলে,"চন্দ্রা ওঠো, তোমার ফোন এসেছে।" চন্দ্রা এত রাতে বাবার ডাকে উঠে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে আবিরের মা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,
" মাগো, তুমি কি আমার ছেলেটাকে একবার দেখতে আসবে?" চন্দ্রা কি বলবে কিছু বুঝার আগেই বাবা চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরে বলে," আয় মা! তোকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।" চন্দ্রার মা ততখনে জ্ঞান হারায়। বাসার লোকজন উনাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে।
রিক্সায় উঠে পুরো রাস্তা বাবা চন্দ্রার হাত শক্ত করে ধরে রাখে। সে রাতে পুর্নিমার তোরে পুরো শহর যেন ভেসে যাচ্ছিল। শুধু চন্দ্রাকেই যেন পুর্নিমার আলো স্পর্শ করার সাহস হয়নি। হসপিটালে চন্দ্রা আবিরের পায়ের কাছে বসে পা জড়িয়ে সারারাাত পাথর হয়ে বসে থাকে। এরপর বাসায় ফিরে ওর তিনদিন কোন জ্ঞান ছিল না। আবির মারা যাবার প্রায় দু বছর পরও স্বাভাবিক হতে পারেনি। শুধু ভরা পূর্নিমার রাতে ছাদে গিয়ে চাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো আর কি যেন খুজতো।
এর প্রায় পাঁচ বছর পর আবিরের বন্ধু রাশিদের সাথে চন্দ্রার বিয়ে হয়। রাশিদ আবিরের বন্ধু হলেও চন্দ্রাদের পাড়াতেই থাকতো। ছোট থেকেই চন্দ্রাকে পছন্দ করতো কিন্তু কখনো বলার সাহস পায়নি। রাশিদ সব জেনে শুনেই চন্দ্রার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। ওদের বিয়ে হয়।
তরী ডায়রিটা বন্ধ করে আবার আকাশের দিকে তাকায়.... পুর্নিমার রুপালি আলোর ছটায় আজকেও যেন পুরো শহর ঝলসে যাচ্ছে... পুরো শহরেই যেন চন্দ্রালোকের কেমন জানি একটা মায়া লেপ্টে আছে.... জোৎস্নার আলো জানালার গ্রীল বেয়ে গলে গলে তরীর ঘরে এসে ঠিকরে পড়ছে। সেই আলোয় ভিজে যাচ্ছে তরীর হাতে রাখা মায়ের নীল ডায়েরীটা। তরীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে আবার। তরী সেই ঝাপসা চোখে আবার আকাশের দিকে তাকায়।জ্যোৎস্নানীলে মায়ের জমে রাখা নীলকষ্ট গুলো আবার খুঁজতে চেষ্টা করে। আচ্ছা মা ও কি আজ জ্যোৎস্না দেখছে? মা কি আজও সেই আগের মত জ্যোৎস্নানীলে মুখ লুকিয়ে কাঁদে আর অপেক্ষা করে সেই প্রিয় মানুষটির জন্য, যার সাথে চন্দ্রজলে গা ভাসিয়ে একদিন স্বপ্ন দেখেছিলো ভালবাসার নীলকাব্য লেখার, স্বপ্ন দেখেছিলো একটা ছোট্ট সুখের সংসার আর তরী নামের একটা ফুটফুটে রাজকন্যার।
দুরের কোন ফ্লাট হতে রবি বাবুর একটা গান ভেসে আসছে...। তরী কান পেত গানের কথাগুলি শোনার চেস্টা করে...। আর নিজের অজান্তেই কখন যেন ওর চোখ বেয়ে নীলকস্ট গুলি টপ টপ করে ঝড়তে থাকে....
তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই—
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই॥
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ,
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই॥
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে—
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই॥
তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই—
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই....
তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই.....
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৭:৩০