"স্মার্না নামের এক রাজকুমারী ছিলো এক রাজার। সে রাজকুমারী এতই সুন্দরী ছিলো যে তাকে স্বয়ং প্রেমের দেবী আফ্রোদীতির সাথে তুলনা করা হতো। আফ্রোদীতি অবশ্য এ নিয়ে বেশ ক্ষেপাই ছিলো বলা যায়। স্মার্নার অবশ্য একটা নিষিদ্ধ অনুভূতি ছিলো যা সে কাউকে বলতে পারতো না। সেই নিষিদ্ধ অনুভূতি তাকে এমনই ডুকরে খেতো যে একসময় নিজেকে মেরে ফেলার জন্য পাহাড়ে পা বাড়ায়। সে যাত্রায় আফ্রোদীতির পাঠানো এক দাসীর হাতে তার রক্ষে হয়। কিন্তু তার বিনিময়ে নিষিদ্ধ কামনার কথা সেই দাসীকে বলে দেয়। সে জানতো না তার এই দুর্বলতার সুযোগ নেবার জন্যই এই দাসীর আগমন। দাসী সুযোগ বুঝে স্মার্নার নিষিদ্ধ ভালোবাসা তার পিতার সাথে মিলনের পথ সুগম করে দেয়।স্মর্না তার পিতা রাজা সিনাইরাসের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। মদ্যপ রাজা টানা ১২ রাত তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। ১৩ রাতের দিন রাজার খুব মন চাইলো যে দাসীর সাথে সে রতিক্রিয়ায় মত্ত তার চেহারা দেখার। রাতের আধারে কুপির আলোয় ঘুমন্ত সেই দাসীর মুখের কাপড় সরায়, তখন দেখে এ তারই কন্যা।
রাজা পাগল হয়ে তার কন্যাকে দাবড়িয়ে নিয়ে যায় সুদূর সাইপ্রাস থেকে লেবানন সিরিয়া পার করে সৌদী আরবের ঠিক পূবে। পুরোটা পথ স্মার্না দেবতাদের কাছে একটাই বর চেয়েছিলো, এ যাত্রা যেনো রক্ষা পায়। দেবতারা তার কথা শুনে, তাকে একটা গাছে পরিনত করে আড়াল করে। ঐ গাছটার নামও স্মার্নাই থেকে যায়।
তখন যেনো মনে হতো এর থেকে কি মৃত্যুই শ্রেয় ছিলো না? প্রাচীন মিথ বলে সৃষ্টির আগে শুধু মৃত্যু বিরাজমান ছিলো। সেই মৃত্যু নাকি ডুকড়ে কাঁদতো কারন তাকে ঘিরে ছিলো পরম শূণ্য অন্ধকার। একটা সময় মনে হতে লাগলো তার সময় কাটানো যেনো অর্থহীন। এমন সময় হঠাৎ কারো শব্দ শুনতে পায়, বলা হয় তোমার অপেক্ষার দিন ফুরোবে। মৃত্যু তখন হকচকিয়ে ওঠে। সে চারপাশ তাকায়, পাগলের মতো অসীম এই জগতের আদ্যপান্ত দৌড়ে বেড়ায়, অন্ধকার বৈ কিছুই পায় না। এরকম করে কত স হস্র বছর নিঃসঙ্গতায় কেটে গেলে প্রচন্ড হতাশা আবারও পেয়ে বসে মৃত্যুকে। হঠাৎ একসময় সেই অচেনা কন্ঠস্বর হঠাৎ বলে বসলো,"সময় ফুরোলো, একটু রোষো। তোমার বেচে থাকার অর্থ পূর্ন হবে অতি শীঘ্রই!" এর কিছু সময়পর ঘটলো এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরন আর চারপাশে অসম্ভব আলোকময় দ্যুতির ছড়াছড়ি। এরপর সৃষ্টি হলো গ্রহ নক্ষত্র মহাবিশ্ব, গ্যালাক্সী...তার সাথে জন্ম নিলো অজস্র গ্রহে প্রানের সমীরন। বিস্ফোরনের কয়েক লক্ষ বছর মৃত্যু যেনো যৌবন ফিরে পেলো, নিজের ইচ্ছে মতো সে ছোট ছোট তারা নক্ষত্রের জীবন নিমিষে খেয়ে ফেলতো। পুরো মহাবিশ্ব ছিলো মৃত্যুর অগাধ আধিপত্য। মৃত্যু এতটাই ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সে জানকবচকারী তৈরী করলো। তখন পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে ধ্বংস আর গড়ার খেলা। এরই ফাকে জন্ম নিলো আমাদের সৌরজগত আর তার কিছু পর জন্ম নিলো আমাদের পৃথিবী। মৃত্যুর চোখ পড়লো আমাদের পৃথিবীর দিকে। যখন সে এগিয়ে আসতে লাগলো তখন শুনতে পেলো সেই কন্ঠস্বর, শুধু কন্ঠস্বরই নয়, এ যেনো স্বয়ং সে। তার উপস্থিতির দ্যুতি এমনই তীব্র ছিলো মৃত্যুকে ঘিরে থাকা এত নিকষ আধারও দৌড়ে পালালো।
: ওখানেই দাড়াও, তুমি!
: কে তুমি? আমাকে থামতে বলার সাহস কোথা থেকে পেলে? আমাকে চেনো?
: তোমাকে ভালো করে চিনি। তোমার সামনে বিশাল এক দায়িত্ব আছে। যদি তুমি এই সৌরজগৎ, এই পৃথিবীকে ছেড়ে দাও, তাহলে তোমার বেচে থাকার অর্থ একদিন পূর্ন হবে।
মৃত্যুর মুখে কথা আর বেরুলো না। সে বেশ কয়েকলক্ষ বছর যেনো চুপষে গেলো। ততদিনে পৃথিবীতে প্রানের অঙ্গুরোদগম ঘটলো, জন্ম নিলো মানুষ নামের অদ্ভূত এক জীব। অদ্ভূত এজন্য যে যেই কন্ঠস্বরকে মৃত্যু এত হাজার লক্ষ কোটি বছর ধরেও চিনতে পারেনি, এই ছোট্ট দুর্বল মানবজাতী তাকে ঈশ্বর বলে ডাকতে শুরু করলো। মৃত্যু শুধু আভিভূত হয়ে তাকিয়ে রয়। তার কাজ দিন দিন বাড়তে থাকে, এবং তা আগের চাইতেও কয়েকগুন বেশী। মৃত্যু একদিন ঈশ্বরের কথার মর্মার্থ বুঝতে শুরু করে।
ভালোবাসা এমন একটা অনুভূতি যার শক্তির কোনো তুলনা হয় না। তুমি ভালোবাসা দিয়ে পুরো একটা বিশ্বযুদ্ধ থামাতে পারো অথবা ফোটাতে পারো পাথরে পদ্মফুল। ভালোবাসা মানে না কোনটা সিদ্ধ কোনটা নিষিদ্ধ। এজন্যই লোকে বলে এ এক মরনবিষ। যখন ভালোবেসে দু ফোটা অশ্রু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে কোনো মায়ের, তখন নাকি ঈশ্বরের আরশ কাঁপে, ঈশ্বর উতলা হয়ে জানতে চান এই মা কি চায়? তখন ঈশ্বরের হাত ঐ মায়ের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তবু আজও বহু সন্তান যুদ্ধ বিগ্রহ, অসুখের নামে মায়ের কোলে মারা যায়, অথবা জন্মাবার আগেই পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেয়। এ এক অমোঘ সমীকরন। ঈশ্বরও কখনো কখনো বোবা বধির হয়ে যান। জানি না কেন হন, হয়তো প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়ম তিনিও ভাংতে চান না, মৃত্যুকে ক্ষমতাহীন রাখা এই প্রকৃতির যেনো ধাতে নেই। তবু সব কথার একটাই কথা, ভালোবাসা অমর করে, দৈহিক মৃত্যু হলেও ভালোবাসা তার স্মৃতি বাচিয়ে রাখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর।
তাই শুদ্ধ ভালোবাসায় কোনো অপরাধ নেই। যদি পবিত্র এবং সত্য ভালোবাসা হয়, তাহলে তার ফলও পাবে একদিন। সেই স্মার্না যে বাবার ক্রোধ থেকে বাচতে পালাতে গিয়ে গাছে পরিনত হয়েছিলো তার পরিনতি কি হয়েছিলো জানো? সে ততদিনে গর্ভবতী হয়ে গিয়েছিলো। গাছে পরিনত হবার ৯ মাস পর সে গাছ ফেটে বের হয় অপূর্ন সুন্দর এ্যাডোনিস। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! সেই এ্যাডোনিসের প্রেমে পড়ে যায় প্রেমের দেবী আফ্রোদীটি স্বয়ং। তার জন্য তাকে লড়তে হয় জিউসের সাথে, যুদ্ধের দেবতা এ্যারিসের সাথে কূটচালে যেতে হয়। এ যেনো স্মার্নার নিষিদ্ধ প্রেমের মধুর পরিশোধ।
ভালোবাসা যে রং এই ধরা দিক, সেটা পবিত্র। চোখের জলে বরন করে যে ভালোবাসা তাকে কখনো ঈর্ষা করতে হয় না। তাকে বুকে টেনে নিয়ে আজীবন ঘর বাধার স্বপ্ন পূরন করলেই তাকে মূল্য দেয়া হয়, পরিপূর্নতা দেয়া হয়, অমরত্ব লাভ করা যায় এই মর্ত্যে।
কেমন আছো, চন্দ্রাবতী?
২৯ আগস্ট ২০১৬
রিপি
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৩৯