আজ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা বন্ধু হে আমার। রবিঠাকুর এর এই গানটি অত্যধিক প্রিয় আমার। বন্ধু, চিরকালই একজন বন্ধুর পেছনে ছুটেছি। পেয়েছি, আবার পাইনি। কেমন বন্ধু চাই আমি, আমরা? সে বন্ধুর কাছেই তো ছুটে যাই সুদিনে- দুর্দিনে। আমার যে গ্রামে জন্ম, সে গ্রামে ঢুকতেই একটা মহীরুহ বটগাছ ছিল, এখনো আছে। আমার আজন্ম সখা সে বটগাছ। ছোটবেলায় দেখেছি যখন খুব রোদ পড়ত অনেক মানুষ সে গাছের নিচে এসে বসতো। কত কথা! সুখের, দুখের, হাসি-আনন্দের। পাড়ার সকল কথারা এসে সে গাছের নিচে জড়ো হ'ত। পাশেই আলমগিরের মুদির দোকান, সাধুর চায়ের দোকান। বটতলায় বসা ছেলে-বুড়ো আড্ডার ফাঁকে চা খেয়ে নিতো আর নিত্যপ্রয়োজনীয় সদাই করে ফিরতো। আমরা যারা ছোট ছিলাম বিজন দুপুরে মাকে ঘুম পাড়িয়ে চুপিচুপি ঘরপালানো দস্যিপনায় মত্ত সবাই এসে আশ্রয় করেছি এই মহীরুহ'র ছায়াতলে। পাতার ফুরফুরি বানিয়ে পাশের ডোবার পাশে ময়না কাঁটার ঝোপ থেকে কাঁটা ছিঁড়ে নিয়ে ফুরফুরেতে গেঁথে বাতাসের। বিপরীতে ধরে রাখতাম। কাচা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো একপ্রকার খেলনা ছিল আমরা বলতাম ফড্ডাসি, আছারগুলা নামন বুনোফল ঢুকিয়ে বাজির মতো ফুটাতাম। বটফল পড়ে বিছিয়ে থাকতো পথে, সে ফল খেতে আসতো হরেকরকম পাখি। কিচিরমিচির ডাকে মুখরিত হয়ে থাকতো বটতলা। সাধুর চায়ের দোকানের পাশে ক্যারাম বোর্ড পাতা, দুই টাকায় একদান খেলা যে'ত। পাড়ার কিশোরেরা ক্যারাম খেলতে খেলতে গেয়ে উঠতো গানের কয়েকটা কলি। মনে মনে কত কথা বলেছি সে গাছের সাথে,কে শুনেছে কবে সেইসব কথা !
আমি খুব ডানপিটে স্বভাবী ছিলাম। গ্রামের মাঝে ছিল সুউচ্চ লোহার টাওয়ার। সে টাওয়ার ভেঙে উপরে উঠে চুপচাপ বসে মানুষের যাওয়া আসা দেখতাম। নানারকম মানুষ, হাঁটাচলা, নানাভঙ্গি। তিন তিনবার টাওয়ার থেকে পড়ে হাত ভেঙেছি আর ভাঙা হাত গলায় ঝুলিয়ে সারাগ্রাম চষে বেড়িয়েছি। গ্রামের একপাশে ধানী জমি আর বাগান। সে বাগানের লিচুগাছের মগডালে উঠে মনের সুখে গান গাইতাম আর সারাগ্রাম খুঁজে না পেয়ে মা এসে লম্বা বাঁশ দিয়ে গুঁতো মেরে গাছ থেকে নামাতেন। সে গাছ, সে টাওয়ারের সাথে আমার মুখচোরা ছেলেবেলার কী দারুণ সখ্য ছিল!
আমাদের মাটির ঘর, মা ঘরের দেয়াল নিপাট করে রাখতেন এঁটেল মাটিতে লেপে। মা মারা যাওয়ার পর, খুব কষ্ট পেলে সে ঘরের দেয়ালের সাথে বুক আগলে কেঁদেছি বড় হওয়া অব্ধিও। দেয়ালটিকে মা মা মনে হ'ত। সেও তো ছিল আমার সখা।
একদিন ছোট এক কুকুরছানা সারা গায়ে ঘা নিয়ে বাবার পিছু নিয়ে বাড়িতে হাজির। বাবার মায়া হলো, মা সে কুকুর ছানাকে যত্নে গোসল করিয়ে ওষুধ দিয়ে তাজা করে তুললেন। আমার ভাইয়ের মতোই কুকুরটি বড় হচ্ছিল। মা যখন নেই, বাথরুম যেতে রাতেরবেলা ভয় করতো আমার। মিন্টু আমার সাথে যেত, পাশে বসে থাকতো, আমি কথা বলতাম আর সে কুঁই কুঁই করে আমার কথার যেন জবাব দিতো। সে মিন্টু নামের কুকুরটি আমার বিপদের বন্ধু ছিল, যাকে কোনদিন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় নানাকারণে।
আমার স্কুলের বন্ধুরা। লাইজু, বেণু, সুইটি, লিপি, তাহেরা, মিল্টন, প্রভাত, জাহেদ, তাহের, হারুণ.... কত কত সুন্দর সময় কেটেছে আমাদের। আমার পাশে ছিল প্রকৃত বন্ধুর মতোই নানা জটিলতায়। সে বিপদের বন্ধুদের ভুলি কী করে! সময়ের কারণে একেকজন দূরে দূরে ছিটকে গেছি কিন্তু স্মৃতিতে ডুব দিলে সে মুখগুলো এখনো কত স্বচ্ছ হয়ে ধরা দেয়! পূর্ণিমা, যে আমার কাছে ভালবাসার এক পরম নিদর্শন। তার কথা মনে হলে ভালবাসা কে আরো বেশি ভালবাসতে ইচ্ছে করে।
আমার কাজিন, চম্পাপু। আমার বিষণ্ণবেলার একক আশ্রয়। কষ্টে বুক ভারি হলেই ওর কোলে মাথা রেখে চিৎকার করে কেঁদেছি। ভার কমে যেত নিমিষেই। সেই তো আমার পরানসখা, রয়েছে পরানে পরানে।
মিনা, আমার পত্রবন্ধু। একটা ম্যাগাজিনের সে কক্সবাজার প্রতিনিধি, আমি রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি। পরস্পর চিঠিতে কত কাছের, সমস্তটা ওকে জানাতাম। কখনো বন্ধু, আবার কখনো আচমকা আমার বড় বোনের ভূমিকায় ওকে পেয়েছি। আজো, আমার অত্যাচার বুকপেতে নেয়। এমন বন্ধু পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার।
শাফিন, ওর কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমার ভেঙে যাওয়া মনের জোর ওর কাছে যেন গচ্ছিত আছে। ওর কাছে গেলেই ফুরফুরে। সালমা, আরেকজন আমার আবাগের আশ্রয়। আমার কাছে বন্ধু মানে তো সেই, যাকে মন খুলে সব কথা বলে ফেলা যায় দ্বিতীয়বার না ভেবেই।
বন্ধু কে হতে পারে?
আমার জন্মদিন, আর কারো মনে থাক না থাক তার মনে থাকে। প্রথম উইশসহ মেসেজটা আমি তার কাছ থেকে পাই। আমার মন খারাপ, ভালো করে দিতে তার নানাপ্রকার চেষ্টা। আমার অসুস্থতা, আমাকে নিয়ে তার ভাবনা। দেশে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ, তার ফোন। আমার গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত, আমাকে নিয়ে তার উৎকণ্ঠা, ফোন করে খবর নেয়া। কোথাও আমার সমালোচনা শুনেছে, আমার সাথে শেয়ার করা, প্রতিবাদ করা। আমার লেখা কোথাও প্রকাশিত হলে, তার ফোন, মেসেজ। আমি কোন ভুল করেছি, আমাকে শাসন করা।
হ্যাঁ, আমি উপর্যুক্ত সূত্রের মাধ্যমে আমার প্রকৃত বন্ধু, কাছের মানুষ চিহ্নিত করি। সে বন্ধুকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে পারি, পাশে থাকতে পারি। মনে রাখতে পারি। যার বা যাদের মধ্যে এসব আমরা পাই না, তাদের মুছে ফেলি ; না পারলেও অন্তত চেষ্টা করি জীবনে তার উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করতে। মানুষ মানুষের মনে দাগ রাখতে না পারলে একদিন সত্যিই মুছে যায়। যেতেই হয়।
ভালোলাগা এই, আমি তেমন বন্ধু পেয়েছি। আমার সকল বন্ধুকে ভালবাসা, ভালবাসা নিরন্তর।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ৮:৪২