"আমারে চাও না তুমি আজ আর, জানি;
তোমার শরীর ছানি
মিটায় পিপাসা
কে সে আজ! --তোমার রক্তের ভালোবাসা
দিয়েছ কাহারে!
কে বা সেই! --আমি এই সমুদ্রের পারে
বসে আছি একা আজ--ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে"
____________
১৯৩৩
'জীবনানন্দ দাশ'
খুব বেশি বিষণ্ণতা চেপে বসলে শৈশবের কাছে মুখ লুকোনো আমার একধরণের গোপন ওষুধ । মাঝে মাঝে তাই প্রিয় কোন নদীর কাছে, পাহাড়ের কাছে হারিয়ে যেতে মন চায়। কিন্তু যাপিত জীবনের নানাবিধ ঝামেলা পেরিয়ে সবসময় তা সম্ভব হয় না বললেই চলে।
সেদিন বন্ধু শাফিনের সাথে অন্তর্জালে নিজের মন খারাপের গল্প করতে গিয়ে সে জানালো -"তোমার কোথাও ঘুরে আসা উচিত" ! আমিও সায় দিলাম তাতে কিন্তু একা একা কোথাও যাওয়া কতটা উপভোগ্য হবে তা একটা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। তাই বলে কি কোথাও যাওয়া হবে না! একা যাওয়ার সিদ্ধান্তে অগত্যা অটল রইলাম। দুপুর একটায় সিদ্ধান্ত নিলাম কুতুবদিয়া যাব, সিদ্ধান্ত নিলাম আগুপিছু না ভেবেই। উদ্দেশ্য শিশুদের পরিবার পরিদর্শন আর নিজের শেকড় সন্ধান। আমার কাজ মূলত কক্সবাজার সরকারি শিশু পরিবারের সুবিধাভোগী শিশুদের নিয়ে। ওদের পরিবার পরিদর্শন কাজের একটা অংশ হওয়ায় খুব বেশি ভাবতে হয়নি। অল্প সময়ের সিদ্ধান্তে শিশুদের ঠিকানা, তথ্য-উপাত্ত গুছিয়ে ব্যাগে কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে রওনা হলাম। কক্সবাজার-টেকনাফ লিঙ্করোড থেকে এস আলম এ উঠে চকোরিয়া পুরনো বাসস্ট্যান্ড নেমে চান্দের গাড়িতে উঠে বসলাম, উদ্দেশ্য পেকুয়া হয়ে মগনামা ঘাট। চকোরিয়া হতে মগনামা ঘাটে যেতে হলে চান্দের গাড়ি অথবা সিএনজি-ই ভরসা। নইলে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি যেসব গাড়ি মগনামা যায় তাতে চেপে বসলেই হয় কিন্তু মাঝপথে সিট খালি থাকে না সবসময়।
লোকাল চান্দের গাড়িতে সমস্যা একটাই এসব থেমে থেমে যাত্রী নামায়-উঠায়। কত রকমের মানুষ, কতরকম কোলাহল, বিচিত্র সব আলোচনা। যারা গাড়িতে উঠছে-নামছে তাদের কারো হাতে সবজিভর্তি থলে, সেভেন-আপ এর বোতলের গলায় দড়িবাঁধা কেরোসিন তেল। এসব ছাপিয়ে যা বিমোহিত করে তা হল পথের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। চারপাশের সবুজের সমারোহ, চিরচেনা গ্রাম। পথের পাশে সারি সারি শিরীষ গাছ, পাতায় পাতায় শাদা ও গোলাপির মিশেলে ফুল, দোয়েল, শালিক আর চড়ুইয়ের সমারোহ। রাতুল কৃষ্ণচূড়া, জারুল যেন নিজেদের নিংড়ে দিয়ে ফুটে আছে। খেজুর গাছে কমলারঙের পাকা, থোকায় থোকায় ঝুলে আছে খেজুর। যেদিকে চোখ যায় লবণের বিস্তৃত মাঠ কালো কালো পলিথিনে মোড়ানো, তার ওপর লবণপানি। মাঠে গেঁথে থাকা খুঁটিতে লেজ নাচিয়ে হাওয়ায় দোল খায় ফিঙে! লোনাজলেভরা মাঠের মাঝে মাঝে কর্দমাক্ত ছোট ছোট খাল। দেখলে মনে হয় এইমাত্র কেউ সমুদ্র থেকে দড়িবেঁধে মাঠে এনে ফেলেছে। মগনামা ঘাট থেকে চ্যানেল পার হয়ে কুতুবদিয়া যেতে হয়। সন্ধ্যে ছ'টা নাগাদ মগনামা ঘাটে পৌঁছে দেখি মিনিট দুয়েক আগে ওপারে যাওয়ার ঘাটের বোট ছেড়ে গেছে। বিকল্প আছে স্পিড বোট। স্পিড বোটে চড়ে ওপারে যাবার দুঃসাহস করতে না পারায় অগত্যা বসে রইলাম ফিরতি বোটের জন্য। আরক্তিম গোধূলি তখনো অন্ধকারে পুরোটা মিলিয়ে যায়নি। ওপারে যেতে অপেক্ষারত অসংখ্য যাত্রী বসে আছে, সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা ফুরফুরে বাতাস শরীরে মেখে দিচ্ছে অন্যরকম এক সুখ। সাতটায় বোটে উঠলাম গন্তব্য বড়ঘোপ ঘাট। ঢেউয়ের চূড়ায় ভাসতে ভাসতে মিনিট ত্রিশের মধ্যেই বড়ঘোপ ঘাটে পৌঁছে গেলাম। একা যাওয়ার সমস্যা হল দোদুল্যমান বোটে উঠতে নামতে বুক ধুকপুক করছিল, এই বুঝি পা ফসকে পানিতে পড়ে যাব! জানি না সাঁতার। চট্টগ্রাম বিভাগ এর কক্সবাজার জেলার এই দ্বীপটির তিনপাশে বেষ্টিত বঙ্গোপসাগর আর পূর্বে বাঁশখালী ও পেকুয়া।
গতবার যখন এসেছিলাম দলবেঁধে গিয়েছিলাম মালেক শাহ হুজুরের মাঝারে, যদিও আমার এসব ধর্মীয় লৌকিকতায় তেমন আগ্রহ নেই। 'কুতুবদিয়া' নামকরণ বিষয়ে ধারনা করা হয় “হযরত কুতুবুদ্দীন” নামে এক কামেল ব্যক্তি আলী আকবর, আলী ফকিরসহ কিছু সঙ্গী নিয়ে মগ পর্তুগীজ বিতাড়িত করে এ দ্বীপে আস্তানা স্থাপন করেন। অন্যদিকে আরাকান থেকে পলায়নরত মুসলমানেরা চট্টগ্রামের আশেপাশের অঞ্চল থেকে ভাগ্যাণ্বেষণে উক্ত দ্বীপে আসতে থাকে। জরিপ করে দেখা যায়,আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, পটিয়া, চকরিয়া অঞ্চল থেকে অধিকাংশ আদিপুরুষের আগমন। নির্যাতিত মুসলমানেরা কুতুবুদ্দীনেরপ্রতি শ্রদ্ধান্তরে কুতুবুদ্দীনের নামানুসারে এ দ্বীপের নামকরন করেন“কুতুবুদ্দীনের দিয়া”, পরবর্তীতে ইহা‘কুতুবদিয়া’ নামে স্বীকৃতি লাভ করে। দ্বীপকে স্থানীয়ভাবে ‘দিয়া’ বা ‘ডিয়া’বলা হয়।
যা হোক, ঘাট থেকে রিকশা নিয়ে চান্দের গাড়িরস্ট্যান্ড এ যেতে চল্লিশ টাকা নিল সাথে একজন নারীকে পেলাম যিনি সাথে উঠলেন। যেতে যেতে কথা হল অনেক। জানলাম তিনি স্থানীয় একটা উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন। স্টেশনে গিয়ে গাড়ি পেলাম যদিও কিন্তু ভিড়ের ঠেলায় হাঁসফাঁস লাগছিল খুব। এই গাড়ি ছাড়া বিকল্প আছে সিএনজি, যে পরিমাণ ভাড়া হাঁকায় আর একা যেতে রাতেরবেলা সাহস করলাম না। কুতুবদিয়া কতটুকু আর জায়গা! ২১৫.৮ বর্গকিমি এর মত আয়তন। জনসংখ্যা বর্তমানে ১,৩৩,৮৮৮জন (২০১১ সালের হিসেব মতে)।
ধুরুংবাজার স্টেশনে গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম চাচা দাঁড়িয়ে আছেন আমাকে রিসিভ করার জন্য। কতদিন পর দেখা! আমার এই চাচাকে খুব ভয় পেত সবাই। যখন স্কুলে পড়ি একবার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় কী বকাটাই না খেয়েছিলাম! এখন চাচাকে দেখে সেই চাচার সাথে মিলাতে পারছিলাম না। রোগা হয়েছে অনেক, মনে হচ্ছে কয় বছরে অনেক বুড়িয়ে গেছে। বাবা মারা যাবার পর সবাই চেয়েছিলেন আমি এখানে এসে থাকি, কিন্তু মামারা পড়াশোনার পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই গণ্ডগ্রামে মেয়ের পড়ালেখা হবে না বলে চাচাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। চাচার কুতুবদিয়া নিয়ে অনেক গর্ব ছিল। বলতেন-কুতুবদিয়ার মানুষ সবচেয়ে শিক্ষিত। আসলেই তো! বর্তমানে এখানকার শিক্ষার হার ৭৭ শতাংশ ।
শুরুতেই বলেছিলাম শেকড়ের কথা! আমার দাদারবাড়ি মূলত কুতুবদিয়ায়। শেষবার গিয়েছিলাম ১৯৯৮ সালে। তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। দাদারবাড়ি হলেও বাবার এক খালা ও খালাতো ভাই-বোনেরা ছাড়া কেউ থাকেন না সেখানে। তাছাড়া বাবাও যেহেতু বেঁচে নেই খুব একটা যাওয়ার তাড়না নেই বললেই চলে। তবে কুতুবদিয়া নিয়ে স্মৃতি কম নয়! শৈশবে যতবারই গিয়েছি কাজিনদের সাথে দাপিয়ে বেড়িয়েছি। সময়ের ব্যবধানে সবাই যে যার সংসার, কর্মব্যস্ততায় আটকে পড়েছে। না যাওয়ার এটাই একটা বড় কারণ বটে!
রাতটা ধুরুংবাজার সংলগ্ন চাচার বাসায় কাটাতে গিয়েও সমুদ্রের গর্জন শোনার লোভ সামলাতে পারলাম না। রাত এগারটায় চাচাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে আলী ফকিরের ডেইলে চলে গেলাম। আগের বার যখন গিয়েছি তখন কাঁচা রাস্তা, মাঝে মাঝে ইট বিছানো ছিল। এবার দেখলাম অধিকাংশ রাস্তাই পিচঢালা। রাস্তার ধারে ধারে গৃহস্থের বাঁশঝাড়। বিদ্যুৎ নেই, সৌরবিদ্যুতের টিমটিমে আলোই ভরসা। তবে সব ঘরেও সৌরবিদ্যুৎ নেই। কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। মাইলখানেক পথ হেঁটে পৌছলাম ফুফাতো ভাই মোজাম্মেলের বাড়ি। সমবয়সী হওয়ায় ছোটবেলার অনেক স্মৃতির সাথে ও জড়িয়ে আছে। মোজাম্মেল ছোটবেলা থেকেই দুঃসাহসী। এমন কোন দুষ্টুমি নেই ও করতো না। এবার গিয়ে শুনলাম মাঝসমুদ্রে ওর মাছ ধরতে যাওয়ার গল্প। ওদের বাড়ির সাথেই লাগোয়া ঐতিহাসিক কুতুবদিয়ার বাতিঘর। আমি উঠোনে দাঁড়ালাম। একটু পরপরই ঘুরতে ঘুরতে আলো ফেলে যাচ্ছে মুখের ওপর ! ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম ছিল একটি সমুদ্রবন্দর। খ্রিস্টীয় নয় শতক থেকে আরব বণিকগণ চট্টগ্রামের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করে। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর (চৌদ্দ শতক) থেকে চট্টগ্রাম বন্দর একটি ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বন্দরে পরিণত হয়। সেকালে সামুদ্রিক জাহাজে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ছিল না, অভিজ্ঞ নাবিকরা প্রাচীন প্রচলিত পদ্ধতিতে সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে বন্দরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটলেও সমুদ্রে জাহাজ পরিচালনায় কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার ব্যবস্থা ছিল না। ১৮২২ সালে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলভাগ বিধ্বস্ত করে দেয়। প্লাবনের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় সমুদ্রবক্ষে পলি জমে সৃষ্টি হয় অনেক চর। বিস্তীর্ণ এলাকায় নতুন নতুন চর জেগে ওঠার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে দেশী-বিদেশি জাহাজ চলাচলে সমস্যা দেখা দেয়। নির্বিঘ্নে জাহাজ চলাচলের স্বার্থে ব্রিটিশ সরকার বাতিঘর স্থাপনের জন্য জরিপ কাজ পরিচালনা করে এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিণে তিনদিকে বঙ্গোপসাগর পরিবেষ্টিত কুতুবদিয়ায় একটি সুউচ্চ বাতিঘর স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। বঙ্গোপসাগরে চলাচলরত জাহাজকে সংকেত দেখানোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ও সামুদ্রিক এলাকায় বিভিন্ন সময় সেন্ট মার্টিনস, কক্সবাজার, নরম্যান্স পয়েন্ট, পতেঙ্গা ও কুতুবদিয়ায় বাতিঘর স্থাপন করা হয়। এসব বাতিঘরের বিচ্ছুরিত আলো ২৫-৩৫ কি.মি গভীর সমুদ্র থেকে দেখা যায়। সবচেয়ে প্রাচীন বাতিঘর স্থাপিত হয় কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায়। কুতুবদিয়া বাতিঘরের নির্মাণকাল ১৮৪৬ সাল এবং ঘূর্ণায়মান বাতি স্থাপিত হয় ১৮৯২ সালে।
রাতে ঘুমোতে গিয়ে সমুদ্রের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে শুনতে রোমন্থন করছিলাম কুতুবদিয়ায় কাটানো আমার শৈশবের মধুর স্মৃতিগুলো। স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর কে কোথায় ছিটকে গেছে! অথচ ভাবলেই সুতোর বান্ডেলের মতো সব হিড়হিড় করে বের হয়ে আসে। মানুষ যে কিছুই ভোলে না! শুধু চাপা পড়ে থাকে শতশত স্মৃতির অন্তরালে। দরজায় টোকা পড়লেই খুলে যায় সব!
ভোরবেলায় সাধারণত আমার ঘুম ভাঙে না। কিন্তু মোরগের ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেল। এমন সুন্দর ভোর, পাখির কাকলি নাগরিক জীবনে সহজে ধরা দেয় না। ইচ্ছে হল এই ভোরেই নির্জন সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দাঁড়াই! মোজাম্মেলকে সাথে নিয়ে চলে গেলাম সমুদ্রের কাছে। ভোরের সমুদ্র যে কী স্নিগ্ধকর তা ঠিক বর্ণনীয় নয়। শুধু আস্বাদনেই সুখ। পাশেই বাতিঘর। খুব ছোটবেলায় এসেছিলাম মায়ের সাথে, সালটা ঠিক মনে না থাকলেও এটা মনে আছে বাতিঘরটা ছিল আরও একটু দূরে। পুরনো বাতিঘরতার ভাঙা অংশের কাছে গিয়ে পারুল আপা বলেছিল-"ইবা তুয়ানে বাঁই গিইয়ি"( এটা তুফানে ভেঙে গেছে)। তখন পাথরগুলো কিছু ভাঙা অংশ পরিত্যক্ত পড়েছিল পারে। এবার পারুল আপা নেই। শুনেছি খুব একটা আসেও না। স্বামী-সন্তান নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করছে। কিন্তু কুতুবদিয়া দ্বীপে ও-ই ছিল আমার একমাত্র প্রিয় মানুষ!
পাথরের ভিতের উপর নির্মিত কুতুবদিয়া বাতিঘরটির উচ্চতা ছিল প্রায় ৪০ মিটার। এর ছয়টি কামরায় পাটাতন ও সিঁড়ি ছিল কাঠের। সর্বোচ্চ কামরায় আট ফিতার ল্যাম্প বসানো হয়েছিল। ল্যাম্পের জ্বালানি ছিল নারিকেল তেল। বাতিঘরের নিচতলা ছিল মাটির নিচে এবং এর দেয়াল ছিল খুবই পুরু। এ বাতিঘর নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছিল ৪,৪২৮ টাকা। আট তলা এ বাতিঘরের প্রতি তলার উচ্চতা ছিল প্রায় ৫ মিটার। প্রতি কক্ষে ছিল কাঁচের জানালা। সর্বোচ্চ কক্ষে জ্বালানো হত বাতি। একটি কাঠের ফ্রেমে রাখা বাতিটি প্রতিদিন সূর্যাস্তের আগে জ্বালানো হত। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হেয়ারের তত্ত্বাবধানে ও ইঞ্জিনিয়ার জে এইচ টুগুডের নির্দেশনায় কুতুবদিয়ার বাতিঘরটি নির্মিত হয়। দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়নের আলী ফকির ডেইলে পশ্চিম সমুদ্র উপকূলে নির্মিত এ বাতিঘরটি ১৮৯৭ সালের প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সমগ্র লাইট হাউজ নড়বড়ে হয়ে যায়। লাইট হাউজের রক্ষকের বাসভবন বিধ্বস্ত হয়। ভবনের কাঠের মেঝে বাতাসের তীব্রতায় প্রায় ৭০ মিটার দূরে ছিটকে পড়ে। ভবনের টিনের তৈরি ছাদ আশপাশের মাঠে গিয়ে আছড়ে পড়ে। স্তূপাকৃত বড় বড় পাথর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। ১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে স্থায়ী ভাঙ্গনে বিলীন হবার পূর্ব পর্যন্ত এ বাতিঘর বিরামহীন আলো দেখিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের প্রায় ৩৫ কি.মি দূর থেকে দিকনির্দেশনা দিত। সেই বাতিঘর! তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বইয়ে বারবার পড়তাম, কুতুবদিয়া কীসের জন্য বিখ্যাত!
আমরা নানা কারণে, অকারণেও প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলি। কিন্তু তাদের স্মৃতিগুলো দগদগে হয়ে বেঁচে থাকে মনে, শুধু ভুলে যাবার ভান করি। আজ যা ভুলতে এই দূর সমুদ্রের কাছে এতবছর পর আমার একাকী আসা, তাও কি ভুলতে পারব? আসলে যেখানেই যাই আমরা তো আমাদের 'আমি'কে সাথে করেই নিয়ে যাই! তাই ভোলার ব্যাপারটা একেবারেই অবান্তর। শুধু প্রলেপ পড়ে ক্ষতে, জ্বালা কমে, হয়তো!
বালিয়াড়ির উপর বসে অপার সমুদ্রের দিকে তাকালে নিজের শূন্যতাকে তুচ্ছ করে আসা যায় অনায়াসে, প্রমাণিত সত্য। বিশাল সমুদ্রকে দেখে মনে হয় মানুষ কত ক্ষুদ্র!
মোজাম্মেলের চোখে মুখে বয়সের ছাপ, অথচ ওর বয়সই বা কত! সমুদ্রের লবণাক্ততা আর রোদে জ্বলে চামড়ায় কালচে ছোপ পড়ে গেছে যেন। ছোটবেলা কথা বলতে বলতে খালি পায়ে হেঁটে বেড়ালাম কিছুটা সময় বালিয়াড়িতে। পায়ের নিচে কাঁকড়ার সুড়সুড়ি সে এক বিচিত্র অনুভূতি। ওর মামাতো বোন পারুল ছিল কুতুবদিয়ায় আমার নির্ভরতার, ভালোলাগার অন্যতম আশ্রয়। সারাক্ষণ ছায়ার মতো লেগে থাকতাম দুজন। পারুল আপা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতো আর ঝিনুকের ছিলান দিয়ে আম খেতে খেতে আমরা সমুদ্রের পার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাদ্রাসায় যেতাম, লেমসিখালিতে। কুতুবদিয়া সদর উপজেলায় ৬ টি ইউনিয়ন আছে; * আলি আকবর ডেইল, *দক্ষিণ ধুরুং, *কৈয়ার বিল, *লেমসিখালী, *উত্তর ধুরুং এবং *বড়ঘোপ। আরজুর বিয়ে হয়েছে কৈয়ার বিল এ।
এবার আরজু'র সাথেও দেখা হল না। ওর এখন তিনটে বাচ্চা, রাতে ফুফু বলছিলেন, ও সংসারী হয়েছে খুব। অথচ আরজু আমাদের সকল ভাইবোনের মধ্যে বোকাসোকা ছিল। কী হাসাহাসিই না করতো সবাই ওকে নিয়ে! আরজু আমমার চাচাতো বোন আর মোজাম্মেলের মামাতো বোন।হেমন্তের ধান তোলা হয়ে গেলে চাঁদনি রাতে সবাই দলবেঁধে বউচি খেলার দিন মনে পড়ে গেল। সেবারই বোধহয় আমরা একসাথে হয়েছিলাম সবাই। আরজুকে সবাই ক্ষেপাতো আর ও কেঁদেকেটে চাচির কাছে গিয়ে নালিশ করত। কে কোথায় আজ! ফাঁকাফাঁকা লাগে বুকের ভেতর।
সমুদ্র দর্শন শেষ করে শিশুর পরিবার পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়লাম। শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশ নয় সেখানকার খেটে খাওয়া মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সমুদ্রের বিশালতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকেও নিয়ন্ত্রণ করে কি ! সেসব মানুষের উদারতার কাছে দারিদ্র্যও হার মেনে নেয় যেন! যাওয়ার সময় ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখিনি অন্ধকারে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথে চ্যানেলের উত্তাল ঢেউ আর তার চূড়ায় যুদ্ধরত বোটের অসহায়ত্ব দেখতে দেখতে মনে হল মৃত্যুর চেয়ে বেঁচে থাকা অনেক সুন্দর।
মনে পড়ল ঢেউয়ের দোলায় ভাসতে ভাসতে সিলভিয়া প্ল্যাথ'র 'এপ্রিল ১৮' কবিতাটি (যদিও অনুবাদটি কার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না)--
আমার সমগ্র পেছনের কাদা
পচে ওঠে আমার খুলির গর্তে—
এবং গর্ভ বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মত
কোনো ব্যাখ্যেয় কারণে যদি
সঙ্কুচিত হতো আমার পাকস্থলি—
আমি তোমাকে মনে রাখতাম না।
অথবা যদি ‘পনিরের চাঁদে’র মত
বিরল ঘুমের কারণে অথবা
খাদ্য, যা বেগুনি পাতার মত
আমাকে পুষ্টি দিয়ে যায়—
তা হলেও না।
কয়েক গজ আততায়ী ঘাস,
কয়েক টুকরো আকাশ আর বৃক্ষশিখরে
গোধূলীতে টেনিস বলের মত সহজে এবং
উদ্ধার-অযোগ্যভাবে হারিয়েছে কাল—
একটি ভবিষ্যৎ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৬ রাত ৯:৩০