বেশ কসরত করেই বাস থেকে নামতে হলো । ইদানিং বাসে করে যাওয়া আসাটা খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে . বিশেষত মেয়েদের জন্যে তো ভীষণ বিড়ম্বনা ! দীর্ঘ সময় বাসের জন্যে লাইনে দাড়িয়ে থাকা , তারপর বাস এলে সিট না পেয়ে স্ট্যান্ডবাই মুডে ভ্রমণ ! সপ্তাহে ৪ দিন এই বিড়ম্বনা সহ্য করে বনানীতে যাওয়া-আসা করতে হয় । কখনও কখনও কপাল ভালো থাকলে কোনো বান্ধবীর সাথে দুইবোন শেয়ারে CNG নিয়ে চলে যাওয়া যায় ! আজও যদি যাওয়ার সময় তেমন ব্যবস্থা হতো ... ! এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাস থেকে নেমে ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটা দিলো সুগন্ধা , পাশে জমজ বোন সুবর্ণা ।
ক্যাম্পাসে ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে গেলো তান্নির সাথে ! এই মেয়েটা প্রতিদিন দেখা হলে প্রথমে কিছুক্ষণ জড়াজড়ি হুরোহুরি করবে , ভাব যেনো অনেকদিন পর দেশে ফিরে বান্ধবীদের সাথে দেখা ! তারপর আগের রাতে বয়ফ্রেন্ডের সাথে কি কথা হলো, সকালে উঠে বাসায় কি কি কান্ড করে এলো , ব্লা ব্লা .. ! সুবর্ণা এসবে একটু বিরক্ত হলেও সুগন্ধার কখনই তান্নির হৈচৈ খারাপ লাগেনা ! আজো দেখা হওয়া মাত্র ছুটে এসে সুগন্ধার হাত ধরে টান দিলো মেয়েটা । হঠাৎ টান সামলাতে না পেরে কাধে ঝোলানো টি-স্কেল সেটটা পড়ে গেলো সুগন্ধার । সেটা উঠাতে যাবে, এমন সময় ওর একটা হাত খামচে ধরলো সুবর্ণা !
- ওই যে ... দ্যাখ , বসে আছে ...
- কই ?
- আরে ! ওই যে , লিফটের সামনের সিটগুলার একটায় !
সুবর্ণার কথা মতো মুখ ঘুরিয়ে সেদিক তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখতে পেলো সুগন্ধা । অমনি শীতল একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো তার মুখে । ছেলেটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বোনের দিকে তাকালো সুগন্ধা । বুঝতে পারলো, সুবর্ণা প্রানপনে চেষ্টা করছে নিজেকে শান্ত রাখার । প্রায় ৪-৫ মাস হলো ছেলেটা ওদের পিছনে ঘুর ঘুর করে ! আরো স্পেসিফিকেলি, সুবর্নার পিছে ! সম্ভবত ওকে ছেলেটা পছন্দ করে । বাস স্ট্যান্ডে প্রায়ই দেখা হয়, একই সাথে দিবানিশী বাসে করে একই স্টপেজে নামে , তারপর দাড়িয়ে থাকে চুপ চাপ । রেলগেটে নামার পর ওরা যখন রিক্সা নেয়, ছেলেটা তখনো চুপ করে দাড়িয়ে থাকে । চেয়ে থাকে সুবর্নার দিকে ! ছেলেটার চাহনিটা অদ্ভুত ! চোখে চোখ পড়লে মনে হয়, যেনো একেবারে মনের ভেতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে ভেজা ভেজা চোখ দুটো দিয়ে ! সুবর্ণাই প্রথম ব্যাপারটা খেয়াল করছিলো , ওকে বলার পর ওরও তাই মনে হয়েছে !
ওরা ঠিক করছে এই ছেলেটাকে কিছুতেই বুঝতে দেবেনা যে ওরা তাকে খেয়াল করে , ওদের আসে পাশে তার উপস্হিতি টের পায় । kind of ignorance. এইসব টুটকা-পুটকা ছেলেদের পাত্তা দেয়ার কোনো কারণ নাই ।
----------------------------------
বোনের পরামর্শ মতো ছেলেটার দিকে না তাকালেও চোখের কোন দিয়ে এখন ঠিকই তাকে খেয়াল করছে সুবর্ণা । বরাবরের মতোই একটা ফুল হাতা শার্ট , জিন্স , স্নিকার তার পরনে । শার্টের হাতাটা কনুই পর্যন্ত ভাজ করা । ছেলেটাকে কখনও শার্ট ছাড়া অন্যকিছু পড়তে দেখছে বলে মনে পড়ে না ! চুলগুলা এলোমেলো , মনে হয় যেনো বাসার চিরুনীগুলা সব বেচে কটকটি খেয়েছে ! ডান কোমরে সম্ভবত বেল্টের হুকে ঝোলানো আইডিটা মাঝেই মাঝেই শার্টের কোনা দিয়ে উকি ঝুকি দিচ্ছে । ইয়েলো রঙের আইডি রিবনটা ইতস্তত ভাবে ডান পকেটে গুজে রাখা । এমন অদ্ভুতভাবে আইডি খুব কম স্টুডেন্টই ঝোলায় ! প্রথম দিকে ছেলেটা কিসে পড়ে , সেটা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছিল সে আর সুগন্ধা ! আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের না , এটা নিশ্চিত ছি লো । যেহেতু ইয়েলো রিবন কিন্তু আর্কিটেকচারে পড়েনা , সেহেতু ছেলেটা অবশ্যই ত্রিপল ই-র ! কারণ ভার্সিটিতে শুধু এই দুই ডিপার্টমেন্টের আইডিই ইয়েলো !
এই মুহুর্তে ছেলেটা যে সরাসরি ওর দিকেই চেয়ে আছে, না দেখলেও সেটা বুঝতে পারছে সুবর্ণা ! আচ্ছা , ছেলেটা এমন কেনো ! এভাবে ড্যাব ড্যাব করে কেউ তাকায় নাকি মেয়েদের দিকে ! আজব !! লজ্জা শরম কম নাকি ব্যাটার ? সুবর্ণা যখনই বুঝতে পারে, ছেলেটা আসেপাশে আছে এবং ওকে দেখছে , কেমন যেনো একটা অদ্ভুত অনুভুতি হয় ওর ভিতর ! সুগন্ধাকে একদিন সেটা বলায় বেশ ঝাড়ি খেতে হয়েছিলো অবশ্য ! সুগন্ধা ওকে বুঝিয়েছে, এইসব আজাইরা ছেলেদের নিয়ে কিছুতেই কিছু ভাবা যাবেনা । তার মতে, ভার্সিটির বেশির ভাগ ছেলে ফ্রড । এদের থেকে দূরে থাকাই ভালো ।
সুবর্ণার অবশ্য মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্ত লাগে । এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকলে যে কোনো মেয়ে বিরক্ত হবে । এটাকি গাধাটা জানে না ? নাকি ইচ্ছা করেই এমন করে ? সব চেয়ে বেশি বিরক্তিকর হচ্ছে , একবার যদি সে কোনো ভাবে তাদের দুইবোনকে দেখতে পায়, তাহলেই হয়েছে ! ওরা একদম ক্লাসে না ঢোকা পর্যন্ত আঠার মতো লেগে থাকবে সাথে ! কি ওয়েটিং এরিয়া, কি স্টাডি । এমনকি ১৭ তলায় স্টুডিওতে ঢুকে গেলেও কাচে ঘেরা দেয়ালে ওপাশে এসে দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ । how disgusting !! একদিন ভালোমতো অপমান করতে পারলে দারুণ হতো ।
আচ্ছা , ছেলেটা ওদের দুইবোনের মাঝে পার্থক্য করে কিভাবে ? নিশ্চয়ই ওর ডান ভ্রুর উপরের তিলটা দেখে ! সুগন্ধার ভ্রুর উপরে এমন কোনো তিল নেই ।
-- চল, ক্লাসের সময় হইসে !
-- হম , চল !
বলে সুগন্ধার পিছু পিছু ইভেন নাম্বার লিফটের লাইনে গিয়ে দাড়ালো সে । চোখের কোনা দিয়ে খেয়াল করলো, ছেলেটাও উঠে দাড়িয়ে শান্ত দৃঢ় পায়ে হেটে আসছে । কিছুতেই তাকাবেনা ভেবেও শেষমেষ মুখ তুলে ছেলেটার দিকে তাকাতে বাধ্য হলো সুবর্ণা । সাধারণ চেহারা , সাদা-মাঠা আওউটলুক । ভাসাভাসা দৃষ্টিতে এক নজরে তাকিয়ে আছে ছেলেটা ওর দিকেই । সুবর্ণা ভ্রু কুচকে প্রবল বিরক্তি জ্ঞাপক একটা অভিব্যক্তি নিয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরালো । লিফট চলে আসা মাত্র দুইবোন চট করে তাতে উঠে পড়ল । দরজা বন্ধ হয়ে যাবার আগ মুহুর্তে করিডোরে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার চোখে চোখ পড়ে গেলো সুবর্ণার । হঠাৎ ওর মনে হলো, কপালে ভাজ ফেলে নির্বাক চোখে চেয়ে থাকা ছেলেটা কিছু বলতে চায় ওকে ...
-------------------------------------
লিফটের দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কেমন যেনো একটা শুন্যতা খচ খচ করতে লাগলো বুকের ভেতর । প্রতিবারই এমন হয় । মেয়েটাকে দেখতেও ভীষণ ইচ্ছে করে, আবার চোখের আড়াল হয়ে গেলেও অস্থির লাগে ! ভার্সিটির ঘড়িতে দুইটা বাজতে দশ মিনিট বাকি । ওদের ছুটি হবে চারটায় । এই সময়টুকু কোথাও বসে ঝিমিয়ে কাটানো গেলে ভালো হতো । অথচ করিডোরে , স্টাডি এরিয়া, ওয়েটিং- সব ফিলাপ । কোথাও বসার জায়গা নেই ! আজ কোনো ক্লাসও নেই স্মরণের । শুধু মেয়েটাকে একটা বার দেখার আশায় এতদূর থেকে বাসে ঝুলে ঝুলে ভার্সিটিতে আসা ওর । নিজের ক্যাম্পাসের দিকে যাবে কিনা - ভাবলো একবার স্মরণ । পরমুহুর্তেই সে চিন্তা বাতিল করে দিলো । একে তো ত্রিপলইর ক্যাম্পাস থেকে আর্কিটেকচারের ক্যাম্পাসে যেতে আসতে অহেতুক দশ মিনিট হাটতে হবে, তার উপর আবার এর মাঝে যদি সুবর্ণা নিচে নামে কোনো কারণে ! তাহলে তো ও দেখতে পাবেনা ... ! ওকে একটু দেখার জন্যেই তো এতো কিছু । সুতরাং কোথাও না গিয়ে এখানে থাকাই শ্রেয় ।
স্মরণের একেকটা সকাল তাকে দেখার কি তীব্র আকাঙ্খা বুকে নিয়ে আসে , এটা হয়তো কোনদিনই মেয়েটা জানতে পারবেনা !
ক্যাম্পাসের বাইরে এসে গেটের ডান দিকে শান বাধানো টাইলসের উপর পা ঝুলিয়ে বসে রইলো স্মরণ । অসম্ভব রকম ভালোবাসা বুকে নিয়ে তাকে এখন দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে, সুবর্ণা নামের ঐ মেয়েটাকে আরো একটাবার দেখার আশায় ...।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৩:৫৩