একটা ঈশপের গল্প দিয়ে শুরু করি ।
অনেক কাল আগের কথা । একদিন "কাক-পাখি"দের রাজার ময়ূরের মতো শৈল্পিক ভঙ্গিমায় পেখম মেলে নেচে নেচে হাঁটার খুব শখ হলো । নিজের কৃষ্ণকায় দেহে ময়ূরের রাজকীয় সৌন্দর্য্য না থাকায় যে অন্তর্জ্বালা কাক দিবা রাত্রি ভোগ করতো,তা থেকে পরিত্রানের এই সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত চিত্তে কাক-রাজা শুরু করলো অনুকরণ-অধ্যাবসায় । এদিকে রাজার কান্ড কারখানা দেখে নির্বোধ কাক-পাখির দল রাজার সাথে সাথে নিজেরাও রাজাকে অনুকরণ করে ময়ূর হন্টন রপ্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো । দিন-মাস-বছর যায়,কিন্তু কাক-রাজা কিছুতেই ময়ূরের মতো করে হাঁটতে পারেনা ! অবশেষে ক্লান্ত হয়ে রাজা রণে ভঙ্গ দিলো । তবে ততদিনে সে তার আদি হাঁটার ভঙ্গি বেমালুম ভুলে গেছে ! একই অবস্থা প্রজা-কাকদের । নিজেদের থ্যাপ-থ্যাপে ভঙ্গি , আর ময়ূরের লাফ দিয়ে নেচে নেচে হাটার পদ্ধতি - এই দুইয়ের সংমিশ্রনে বিদঘুটে একটা ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে কাক-রাজ ভাবলো - "আহ , বেশতো ! স্বজাতির হন্টন প্রক্রিয়ায় এক নতুন মাত্রা যোগ করা গেছে !" সেই থেকে ময়ূরকে অনুকরণে ব্যর্থ 'কাক-পাখি' বিকৃত ভঙ্গিমায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলে ।
নির্বোধ পশু-পাখিদের অসভ্য সমাজ থেকে ফিরে আসি বুদ্ধিমান মানবজাতির সুসভ্য সমাজে । মজার ব্যাপার হলো, ধরার সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান প্রানীদের হাতে গড়া এই সভ্য সমাজেও নির্বোধ পশুপাখিদের মতো কিছু অসভ্য আচার-অভ্যাস বিদ্যমান । অন্ধ অনুকরনপ্রিয়তা তেমনই একটা অভ্যাস ।
বিশেষ দিনগুলোকে বিশেষ ভাবে উদযাপন করা মানব সভ্যতার একটি অন্যতম বৈশিস্ট্য । এমনই একটা বিশেষ দিন হচ্ছে - নববর্ষের প্রথম দিন, বিশেষত ইংরেজী বর্ষের প্রথম দিন । এই দিনটা পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশ জাক-জমকের মধ্যদিয়ে পালিত হয়ে আসছে বহু আগে থেকেই । বছরের প্রথম দিনটাকে সাদরে সম্ভাষণ জানানোর জন্যে অনেকদিন ধরেই চলে তাদের তোড়জোড় । যেমন, এবারে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে "New Year Eve Fire Works" - ইভেন্টের জন্যে অস্ট্রেলিয়ানরা প্রায় এক বছর ধরে কাজ করেছে । নববর্ষের রাতে তারা পুড়িয়েছে বিলিয়ন ডলারের আতশ বাজি ! ফায়ার ওয়ার্কসের পাশাপাশি ঐ রাতে পশ্চিমা দেশগুলোর স্ট্রিটগুলোতে চলে স্ট্রিট ড্যান্স, লেজার শো, ডিজে পার্টি, লাইভ কনসার্ট । বারগুলোতে অবাধ মদ্যপান আর হরদম আড্ডা , এবং অতপর : বহুগামী রাত্রি যাপন । আমাদের অনেকের কাছেই এই জীবনধারা বা আচার-ব্যবস্থা অসভ্য হলেও এগুলো তাদের সমাজে নতুন কিছু নয় । কারণ এটাই তাদের পশ্চিমা সংস্কৃতির স্বকীয় রূপ, এটাই তাদের সভ্যতা ।
সংস্কৃতি আমদানী ও রফতানী যোগ্য , সভ্যতা সংক্রামক । আর তাই পশ্চিমাদের সেই সভ্যতার ছোঁয়া ইউরোপ আমেরিকার সীমানা পেরিয়ে আমাদের গায়েও লেগেছে । তবে সে ছোঁয়ার ফলাফলটা অনেকটা কাকের রিমিক্স স্টাইলে হাঁটার মতোই বিদঘুটে ! পশ্চিমাদের অনুকরণে আধুনিকতার চর্চা করতে গিয়ে আমরা এখন থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করি অভিজাত পাড়ার বার আর পাঁচ তারকা হোটেল গুলোতে মদ খেয়ে, Dj party-তে ঢলাঢলি করে ! সেই সব ডিজে পার্টিতে যারা আসেন,তাদের স্বল্প বসন ও নিজেদের উপর অল্প মাত্রার নিয়ন্ত্রণ দেখে আপনার মনে হতেই পারে - এরা আধুনিক যুগে বাস করা কিছু আদিম মানুষ ,যাদের জীবনযাপন পদ্ধতি পশুপাখিদের মতোই অসভ্য ! এদের বাচন-ভঙ্গি, পোশাক, জোজো মার্কা চুল-দাড়ির স্টাইল, কান-ভ্রুর উপরে ফুটো করা দুল দেখলে কিম্বা অবিরাম হিন্দি/ "র" "র" মার্কা ইংরেজী বোল শুনলেও যে কোনো স্বাভাবিক চিন্তা সম্পন্ন মানুষ ভিরমি খেতে পারেন ।
যাদের সামর্থ্য বা দৌড় একটু কম,তাদের জন্যে আছে TSC,রবীন্দ্র সরোবরের রাত্রিকালীন কনসার্ট । নিজেদের নেটওয়ার্কের বেহাল দশা থাকলেও লাখ লাখ টাকা খরচ করে সেইসব কনসার্টের স্পন্সর হয় এয়ারটেলের মতো "দাদায়ী কোম্পানি"গুলো ! কনসার্টের মাঝে চলে হাতের ব্যায়াম এবং কনসার্ট শেষে পৌরষত্বের প্রদর্শনী ও নারীত্বের পরিচর্যা । বোরখা পড়ার দরুণ নারী অধিকার বিনাশের আশঙ্কায় আশঙ্কিত নারীবাদী নেত্রীদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরগুলো এই ক্ষেত্রে মেনী বিড়ালের মতোই ম্রিয়মান থাকে ! অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক । কারণ এদের সন্তানরাই এমন "আনন্দমুখর" রাতগুলোতে সবার পরে ঘরে ফেরে ।
এই হলো বর্তমান অবস্থাচিত্র , এভাবেই এগিয়ে চলছে আমাদের ডিজুস জেনারেশন, নির্মিত হচ্ছে রিমিক্স সভ্যতা ।
সভ্যতার এই রিমিক্সে ইদানীং আবার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে । সংস্কৃতির অবাধ আদান-প্রদানের নামে আমরা এখন উপলক্ষ্য পেলেই "বাইরে" থেকে শিল্পী ভাড়া করে নিয়ে আসি ! সাথে আসে আইটেম গার্ল, চিয়ারার । স্টেডিয়ামের খোলা মাঠ কিম্বা অভিজাতহোটেল গুলোতে হাজার টাকায় টিকিট কেটে সংস্কৃতির সেইসব "আদান-প্রদান" উপভোগ করতে যায় আমাদের এলিট শ্রেনীর বুভুক্ষু তরুণ-তরুণী সন্তান থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিরা পর্যন্ত ! থার্টি ফার্স্ট নাইটের এইধরনের শোগুলোতে গভীররাত পর্যন্ত "বিদেশী শিল্পীদের" কান ফাটানো, চোখ জুড়ানো ও মন ভরানো শারীরিক প্রদর্শনী দেখে উত্তেজিত অবস্থায় বাড়ি ফেরার পথে উঠতি বয়েসী অনেকেই "একটু বেসামাল" হয়ে পরদিন পত্রিকার শিরোনামে আসে । দেশের অসংখ্য অসঙ্গতির খবর চোখ এড়িয়ে গেলেও থার্টি ফার্স্ট নাইটের এই কেলেঙ্কারির খবর দেশের নাম করা দৈনিকগুলো শিরোনামে দিতে বেশ স্বাছন্দ্য বোধ করে । কিন্তু এই কেলেঙ্কারি ও অধ:পতনের পেছনের সংস্কৃতির "আদান-প্রদান"-মূলক যে ঘটনাগুলো দায়ী, সেদিকে এরা কদাচিতই আলোকপাত করে ! অবশ্য এটাও স্বাভাবিক । এইসব "এন্টারটেইনিং ইভেন্ট"-গুলোতে ম্যানেজমেন্ট ফার্মগুলো টিকিট বিক্রির ধান্দায় যে বিজ্ঞাপনগুলো দেয়, সেগুলোর মূল্যমান একেবারে ফেলনা নয় বৈকি !
১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গমাইলের (দাদাদের দয়ায় কিছু কমে গেছে মনে হয় !) এই ছোট্ট দেশটার সন্তান আমি । তাই উপমহাদেশের অন্যসব দেশ ধরে টানাটানি না করে আমার আলোকপাত এই দেশ, জাতি এবং সমাজকে কেন্দ্র করেই । আমাকে কেউ এর জন্যে "কুয়োর ব্যাঙ" বলে টিটকিরি দিলেও আমার কিছু যায় আসেনা । ভিনদেশী সভ্যতার ছোঁয়ায় তরান্বিত হওয়া সামাজিক প্রগতিশীলতাকে আশেপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে মিলিয়ে বুঝে/মেনে নেয়ার মতো "মডারেট" ও "মডার্ন" চিন্তাধারার সাথে আমি পরিচিত নই । সেজন্যে আমাকে কেউ "ব্যাক ডেটেড" "সংকীর্ণমনা" "কুপমন্ডুক" বললেও আমি নিরুপায় । তবে একটা কথা ঠিক, আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার নামে নিজের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বিকৃত করে স্বীয় স্বকীয়তাকে বিসর্জন দেয়াটা কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই গ্রহনযোগ্য নয় । অথচ আমরা তাই করছি !
কিছুদিন আগে এক বড় ভাইয়ের দাওয়াত পেয়ে তার বোনের বিয়েতে গিয়ে খেয়াল করলাম, সেখানে বর-কনের মঞ্চের সামনে একটা বিশাল জায়গা খালি রাখা হয়েছে । উদ্দেশ্য - সেখানে ছেলেমেয়েরা গানের সাথে সাথে নাচবে ! খানিক পর উচ্চগ্রামে হিন্দি গানের সাথে সাথে অদ্ভুত স্টাইলে কিছু ছেলে মেয়ে নেচেও দেখালো ! পাশে থাকা এক আপুকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ইন্ডিয়াতে নাকি এভাবেই বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো হয় । তার তথ্যসূত্র বুঝতে আমাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি ! এরই মধ্যে সখী-সখা পরিবেষ্টিত হয়ে বর-কনে প্রবেশ করলো দৃশ্যপটে । বরের পরনে কমপ্লিট স্যুট । কনের শাড়ি পড়ার ধরণ দেখে মনে হলোনা, এভাবে বাঙ্গালী মেয়েরা বিয়ের শাড়ি পড়েছে কোনো কালে ! পুরো ব্যাপারটা কে কিভাবে দেখছিলো জানিনা , তবে আমার কাছে একে জগাখিচুড়ি বলে মনে হয়েছে । উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি কি সুক্ষ্ণ ভাবে আমাদের সমাজে চেতনাগত আগ্রাসন চালাচ্ছে - সম্প্রতি আলোচনায় আসা কিছু লীভ টু গেদারের ঘটনার মত এটাও তারই একটা প্রমাণ । এই অভিজ্ঞতার সব চাইতে মজার দিকটা হলো , আমাদের কাছে "অনুকরণযোগ্য" হিসাবে একমাত্র পশ্চিমা এবং ভারতীয় সভ্যতার বিভিন্নদিক গুলোই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে । মনে হয় যেনো পৃথিবীতে শুধু এই দুই কিসিমের সভ্যতাই বিকশিত হয়েছে আজতক !
আমাদের দেশে একশ্রেনীর কলামিস্ট আছেন,যারা বিদেশের মাটিতে বসে প্রায়ই "দেশ গেলো , দেশ নিলো" টাইপ কলাম লিখে দেশের জন্যে আহ-উহ করেন !দেশেও এমন অনেকেই আছে । তাদের বেশিরভাগেরই লেখনীর মূল বিষয়বস্তু থাকে - মৌলবাদী দল, জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী, বাংলাদেশের কল্পিত তালেবানকরণ প্রক্রিয়া । ইদানীং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাতে নতুন মাত্রা হিসাবে স্থান পেয়েছে । এখন সরকার ও এর দলীয় নেতা কর্মী ও সমমনা চিন্তাবীদদের কথা শুনলে মনে হয়, দেশে বর্তমানে যুধাপরাধিদের বিচার ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই ! আমরা অবশ্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি চাই, কিন্তু সেটাকে ব্যবহার করে আর সমস্ত অস্পৃশ্যতা, অসঙ্গতি ও অন্যায়গুলোকে উপেক্ষা করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? ভুলে গেলে চলবেনা, ৭১-এ হানাদারবাহিনী ও তাদের দোসরদের পৈশাচিকতায় শহীদ হাওয়া যে মানুষগুলোর আত্মার শান্তির জন্যে আজ আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইছি, সেই মানুষগুলো কিন্তু একটা মুক্ত-স্বাধীন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন বুকে নিয়েই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল ৪০ বছর আগে ! অথচ তাদের সেই স্বপ্ন-সাধের ভবিষ্যত প্রজন্মের আজ এই বেহাল দশা দেখে সেই শহীদআত্মাগুলো কি খুব স্বস্তিতে আছে স্বপ্নলোকের ওপারে ? আমাদের পরগাছা সদৃশ বুদ্ধিজীবি, নীতিহীন নীতিনির্ধারকরা বা ফাপড়বাজ কলামিস্টরা কি পারে না তারুণ্যের এই অধপতনের বিরূদ্ধে দৃপ্ত কন্ঠে সোচ্চার হতে ?
লেখার শুরুতে "কাক-পাখিদের" হন্টন প্রক্রিয়ার ইতিহাসের উপর ঈশপের গল্প থেকে খানিকটা রম্য আলোকপাত করেছিলাম । ময়ূরের অনুকরণ করতে গিয়ে এদের জীবনে কি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে এবং সেটা কিরকম কিম্ভুতকিমার - সেটা বোঝানোই ছিলো ঐ আলোকপাতের উদ্দেশ্য । আসলে প্রকৃতির ধারাটাই এমন । কেউ যখন তার সহজাত স্বকীয়তাকে অবহেলা করে অন্যের আদর্শকে অন্ধভাবে আকড়ে ধরতে চাইবে, তখন নিশ্চিত ভাবেই সেটা তার জন্যে অকল্যাণ বয়ে আনবে । আমি বলছিনা, অন্য সভ্যতা বা সংস্কৃতি থেকে আমরা কিছুই নিতে পারবোনা । আমরা অবশ্যই আমাদের সমসাময়িক সভ্যতাগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারি,তাদের সংস্কৃতির ভালো দিকগুলোকে নিজেদের জীবনে চর্চার মাধ্যমে আরো উৎকর্ষ সাধন করতে পারি, কিন্তু তাই বলে আধুনিকতা কিম্বা প্রগতিশীলতা লাভের আকাঙ্খায় ভিনদেশী সংস্কৃতির নোংরা দিক গুলোকে গ্রহণ করলে তাতে আমাদের সমাজ পূর্বাপেক্ষা অসভ্য বৈ সভ্য হবেনা । আসলে স্বকীয়তাহীন আত্মবিলুপ্ত D juice সভ্যতা কাকের রিমিক্স হন্টনের মতোই কদাকার ও হাস্যকর !
বি.দ্র: পাখা আছে এবং উড়তে সক্ষম, তবুও তেলাপোকাকে পাখি বলা না গেলেও কাক অবশ্যই পাখি । পাখি হিসাবে পরিচিতি পাওয়া এদের মৌলিক অধিকার । একই ভাবে, স্বাধীনদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে যে কোনো ভাষায়, যে কোনো পোশাকে যে কোনো সভ্যতার চর্চা করা অনেকের কাছে মৌলিক অধিকার মনে হতেই পারে ! আমরা সবার সব ধরনের অধিকারের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল, আর তাই এই লেখাতে কাককে "কাক-পাখি" বলা হয়েছে ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:৩৫