বেশ কিছুদিন ধরেই সুন্দরবনের World Ranking নিয়ে বেদম অস্থিরতা খেয়াল করছি সবার মাঝে । ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে গুটলু পুটলুরাও বেশ উত্তেজিত। বড়দের অগোচরেই তারা পটাপট sms করে যাচ্ছে মোবাইল দিয়ে ! :-& :-& :-&
গতকাল রাতেই হঠাৎ করেই এই অস্থিরতার মাত্রাটা লাফ দিয়ে অপটিমাম লেভেলে চলে গেলো ! Shocking News ক্যাপশনে একটা কমন পোস্ট ছড়িয়ে পড়লো নেটে,তাতে জানানো হলো- World Ranking-এ সুন্দরবন নাকি ১৩ নম্বরে চলে গেছে! শুরু হলো হইচই, কি করা যায়, কি করেছি, দেশের প্রতি কর্তব্যবোধ কার কেমন তা নিয়ে লেগে গেলো তর্ক ! অনেক আপু আবার অতি মাত্রায় কষ্টে আপ্লুত হয়ে কেঁদেই ফেললেন ! অবস্থা দৃষ্টে মনে হলো,আদপেই আমাদের গোটা জাতি বেশ shocked হয়ে পড়েছে ! এবং এই শকটা সবচাইতে বেশি পেয়েছে আমাদের তরুণ সমাজ!
World Ranking -এ সুন্দরবন ১৩ নাম্বারে চলে যাওয়ায় "shocked" আমাদের সেই তরুণ সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই আমার এই লেখা -
দেশে এই মুহুর্তে "Shocked" হওয়ার মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটছে,যেগুলোর জন্যে মানবতা ও মনুষ্যত্ব চরমভাবে লাঞ্চিত হচ্ছে । আমরা তার কয়টার খবর রাখি? আঁতেল প্রজাতির কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে উদাহরণ চাইতে পারেন । উদাহরন স্বরূপ বলা যেতে পারে -
১. দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ভিন দেশী কোম্পানিকে লিজ দেয়া এবং তার প্রতিবাদ করায় ছাত্র শিক্ষক নির্বিশেষে সাধারণ জনতার উপর সরকারী পেটুয়া বাহিনীর অসভ্য, বর্বর নির্যাতন চালানো,
২. দাদাদের অস্ত্র বহনের জন্যে দাদাদের ব্যাংক থেকে দাদাদেরই দেয়া চড়া সুদের অর্থ ঋণ নিয়ে তাদেরই লোকবল,যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল ব্যবহার করে দেশের বুকের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট সড়ক নির্মাণ,
৩. মিমাংসিত ভূমি পুনরায় জরিপের নামে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ সিলেটের বিবির হাওর দাদাদের হাতে তুলে দেয়র চেষ্টা করা,
৪. অকৃত্রিম বন্ধুত্ব ও নিখাদ ভাতৃত্ববোধের উজ্বল নিদর্শন স্বরূপ ফেলানির লাশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা,
৫. জাতির মূলমন্ত্র সংবিধানকে ইচ্ছে মতো কেটে ছিড়ে "সঙ-বিধান" বানানো ,
৬. পিলখানায় ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তার খুনের তদন্ত রিপোর্ট গায়েব করে দেয়া এবং বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে CIDর কাস্টডিতে অসংখ্য Eye-witness বিডিয়ার জওয়ানের গুম-খুণের বিচার না হওয়া, উপরন্তু, এই ঘটনার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার অপরাধে ৩৭ জন সেনাকর্মকর্তাকে বাধ্যতা মূলক অবসরে পাঠানো,
৭. RABএর দৌরাত্নের শিকার পঙ্গু লিমনের বিরূদ্ধে একের পর এক চার্জশিট প্রদান,
৮. ইডেন-ঢাবির বোনদেরকে সরকারি মন্ত্রী-এমপি ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতাদের ভোগ্যপণ্য বানানো এবং সেই ঘটনা বিস্ময়কর ভাবে ধামাচাপা দেয়া,
৯. ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় অবৈধ নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকের হাতে ছাত্রী নিগ্রহ এবং তার বিচার চাওয়ায় ক্ষমতাসীনদের রক্ত চক্ষু প্রদর্শন ,
১০. OMSএর ট্রাকের পেছনে একটু একটু করে দীর্ঘ হতে থাকা অসহায় নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের লাইন ....
এভাবে লিখতে থাকলে পোস্ট শেষ করা কষ্টকর হয়ে পড়বে !
World Ranking -এ সুন্দরবন ১৩ নাম্বারে চলে যাওয়াতে আমরা যে মাত্রায় অস্থির হয়ে পড়েছি,তা সত্যিই বিস্ময়কর ! আমাদের ফোকাসিং পয়েন্টটা থাকার কথা কোথায়,আর আমরা ফোকাস করছি কোথায় ! সুন্দরবনকে আমরা ভোট দেবো -ভালো কথা, অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করবো ভোট দিতে- ঠিক আছে । কিন্তু সে জন্যে এত অস্থিরতা, Shocked হয়ে shocking status দেয়া,কান্নাকাটি জুড়ে দেয়া কতটুকু যুক্তি সঙ্গত? আমাদের কি মনে হয়না, "Shocked" হওয়ার জন্যে উপরের এমন কয়েকটা কারণ অধিক উপযুক্ত? সুন্দরবনের backward ranking-এর ঘটনাটি কি এগুলোর চাইতেও বেশি "Shocking" আমাদের কাছে? কই , এগুলো নিয়েতো এত হইচই করিনা আমরা ! অতি মাত্রায় Shocked হয়ে দেইনা shocking status কিম্বা wall post ! অথচ এই বাংলার আনাচে কানাচে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে এবং প্রতিনিয়ত ঘটছে ,যেগুলো বরাবরই থেকে যাচ্ছে আমাদের অগোচরে ! বহির্বিশ্বের কথা নাহয় বাদই দিলাম ।
আজ আমরা যেই সুন্দরবনকে 7 wonders ranking প্রথম বানানোর জন্যে এত উতলা, সেই সুন্দরবন যে দুর্নীতিপরায়ণ বন কর্মকর্তা আর বনদস্যুদের করাল গ্রাসে একটু একটু করে নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে খবর কি আমরা রাখি? সেখানকার জেলে বাওয়ালিরা কতোটা মানবেতর জীবন যাপন করছে, তা কি আমরা জানি?সুন্দরবন কিম্বা এর অধিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে আমরা কয়টা SMS করি? কয়টা স্ট্যাটাস কিম্বা ওয়াল পোস্ট দেই ফেসবুকে?
যদিও এই সেভেন ওয়ান্ডার্স অর্গানাইজেশনের World Ranking প্রদানের যথার্থতা এবং এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে ,তারপরও ধরে নিলাম আমাদের জান-প্রাণ দিয়ে করা SMS-এ প্রথম ৭-এ চলে গেলো সুন্দরবন ।
তারপর ???
আমরা কি পারবো বিশ্বের অন্যতম সপ্তাশ্চর্য খ্যাত এই সুন্দরবন দেখতে আসা ট্যুরিস্টদের পর্যাপ্ত আতিথেয়তা এবং নিরাপত্তা দিতে? যদি ব্যর্থ হই, তবে সে দুর্নামের কৃষ্ণ তীলক কি সুন্দরবন তথা সমগ্র জাতির ললাটে লেপ্টে যাবেনা ? আমাদের দেশ দেখতে এলে পর্যটকদের আমরা কি দেখাবো? রাস্তার ধারে অসংখ্য বস্তি ? পথে পথে ঘুরে ফেরা অসংখ্য অর্ধউলঙ্গ ভুখা শিশু ? OMSএর দীর্ঘ লাইন? কে দেবে তাদের নিরাপত্তা ? ধর্ষক,ঘুষখোর ভুড়ি সর্বস্ব পেটুয়া পুলিশ বাহিনী ? হাহ ! এইসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায় আমাদের ? আমরা টি এস সির চত্বরে বসে ভাবি- কি সুন্দর এই দেশ ! ক্যান্টনমেন্টের জলপাই সুরক্ষায় থেকে বলি- কি দারুণ নিরাপত্তা ! হরেক রকম ম্যেনুর খাবারে সাজানো ডাইনিং-এ বসে ভাবি, আহা , দেশের সব কিছু কত সস্তা ! গ্যালাক্সি ট্যাব হাতে নিয়ে বলি ,দেশ ডিজিটাল প্রযুক্তির পথে আলোর গতিতে দৌড়ে চলছে ! কোটি টাকা ঘুষে লাইসেন্স পাওয়া ওয়াই ম্যাক্স দিয়ে নেটে ঢুকে ভাবি, ওহ ... জীবন কতইনা গতিশীল !
কম্পিউটারের সামনে বসে মনে হয় - এই তবে বেলা, এবার বিশ্ব করবো জয় ! পত্রিকার লাল কালির আচ্ছাদনে অসংখ্য সত্য আড়াল করা শিরোনাম আর টিভি স্ক্রিনে দৌড়ে চলা লীড নিউজ পড়ে ভাবি- ইসস ! দেশটার নাড়ি-নক্ষত্রের খবর আমাদের নখদর্পনে ! কি বিচিত্র আমাদের চিন্তা ধারা ! কত অস্বচ্ছ আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গি !!
এভাবে লিখে গেলে শুধু হতাশাই জন্ম নেবে , জমা হবে নিস্ফল ক্ষোভ । নিস্ফল ক্ষোভ পোষা আর দিবা স্বপ্ন দেখা- একই মানের নির্বুদ্ধিতা ।
Yo Yo-ডিজুস সভ্যতা আর কনসার্ট-আধুনিকতার মোহে পড়ে এটা ভুলে গেলে চলবেনা, আমরা সেই সে জাতি- স্বাধীনতার সূর্যউদয় দেখতে যাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে নয় মাসের নিকষ কালো রাত্রি,এ ভূমিতে আসার জন্যে স্বাধীনতাকে পাড়ি দিতে হয়েছে রক্তস্নাত ৫৭ হাজার বর্গমাইল, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তঋণে বাধা এই ভূমির বুকে আজ আমরা দাড়িয়ে আছি ! আমরা যোদ্ধা জাতি-জানি রক্ত দিতে ,পারি পর্বতপ্রমাণ অন্যায়ের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়াতে !
আসুন,সব ধরনের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক অন্যায়ের বিরূদ্ধে শক্ত হাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলি । জানাই দৃপ্ত কন্ঠে জোরালো প্রতিবাদ । এর জন্যে পল্টন কিম্বা জিরো পয়েন্টে গিয়ে রাজনৈতিক ব্যানারের নিচে শুয়ে পড়তে হবে-এমন কোনো কথা নেই । শুরু করি চোখের সামনে ঘটা অন্যায় গুলোর সমবেত প্রতিবাদ দিয়েই । তাতে যদি সময় ক্ষেপণ হবে বলে মনে হয়,যদি ভয়ে কাঁপে বুক, তবে অন্তত এই সচেতনতা ছড়িয়ে দিন তাদের মাঝে,যাদের বুকে হিম্মত আছে অন্যায়ের বিরূদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর ।
কেউ ভোট দিক বা না দিক, World Ranking-এ থাকুক কি না থাকুক,এই ধরার বুকে সৌন্দর্য্যের আধাররূপে এই সুন্দরবন আমাদেরই গর্বের অংশ হয়ে থাকবে । বরং, আপনার দু-টাকা মূল্যের sms দিয়ে ততোধিক ভোটিং-এর পরিবর্তে সচেতনতার বাণীগুলোকে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে দিন মুঠোফোনের কোনো বার্তায়,কিম্বা ভার্চুয়াল জগতের কোনো দিগন্তে ! তাতে যদি ঘুমন্ত মনুষত্ব জেগে ওঠে আমাদের,যদি অবচেতন বোধ গুলো পায় সাড়া,তাহলেই দেশ হবে সবচাইতে বেশি লাভবান । উপকৃত হবে পুরো জাতি ! তাকিয়ে থাকবে গোটা বিশ্ব !!
[এই লেখাটির প্রকাশের কিছুদিন পরেই NTV-এর সাংবাদিক ওজায়ির ইবনে ওমর ভাইয়ের এক খানা বিশ্লেষণমূলক পোস্ট পাই,যাতে এই World Ranking of heritages এর অসারতা নিয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে । ওজায়ির ভাইয়ের পোস্টের লিঙ্ক] এখানে দেয়ার প্রাসঙ্গিকতা বোধ করছি ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ২:৪৬