কবি হেলাল হাফিজ ফেসবুকে বা গণমাধ্যমে এখন যতটা সহজলভ্য, বছর দুয়েক আগেও অতটা সহজলভ্য তিনি ছিলেন না। অনেকেরই ধারণা ছিল -- তিনি মারা গেছেন অথবা প্রবাসে আছেন, অনেকের মতো আমারও একই ধারণা ছিল। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে আকস্মিকভাবে একদিন জানতে পারলাম তিনি বেঁচে আছেন এবং প্রেস ক্লাবে নিয়মিত বসেন। যার কাছে জানতে পারলাম; তিনি আমাকে হেলাল হাফিজের ফোন নাম্বার দিতে পারেননি, পেরেছিলেন তার ছোট ভাই নেহাল হাফিজেরটা দিতে। নেহাল হাফিজকে কল করে হেলাল হাফিজের ফোন নাম্বার যোগাড় করেছি এবং প্রেস ক্লাবে গিয়ে তাকে খুঁজে বের করে ফেসবুকে তাকে নিয়ে পোস্ট দিয়েছি, তার ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নামিয়ে আমার আইডি থেকে প্রকাশ করেছি, তখন তার আইডিতে ফ্রেন্ডসংখ্যা ছিল ৩৪। এর পর থেকে আমার মতো অন্যরা জানতে পারলেন -- তিনি বেঁচে আছেন এবং এক প্রকারের আত্মগোপনে কিংবা স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা হেলাল হাফিজ আবার মানুষের সাথে মিশতে শুরু করলেন।
হেলাল হাফিজের কবিতায় হেলেন নাম্নী এক নারীর বহুল উপস্থিতি আছে, এই নারীকে কেন্দ্র করে তিনি বেশ কয়েকটি মর্মস্পর্শী কবিতা লিখেছেন। হেলেন ছিলেন তার প্রথম প্রেমিকা এবং হেলেনের ব্যাপারে তিনি অতিমাত্রায় সংবেদনশীলও ছিলেন, হেলেনপ্রসঙ্গ উঠলে তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে একসময়ে কান্নাকাটিও করতেন। নেহাল হাফিজ আগেই আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন আমি যেন হেলাল হাফিজকে হেলেনপ্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন না করি। প্রথম সাক্ষাতে তাকে আমি হেলেনপ্রসঙ্গে কিছু বলিওনি।
২০১২ সালের পহেলা মে নেহাল হাফিজকে আমি দ্বিতীয় দফায় কল করি এবং জানতে পাই হেলেনের মর্মান্তিক গল্প। হেলাল হাফিজের স্কুলজীবনে হেলেনের সাথে প্রেম হয়, তারা ছিলেন প্রতিবেশী। দীর্ঘ প্রেমের পর দুই পরিবারে ঘটনাটি জানাজানি হয়। হেলেনের বাবা ছিলেন দারোগা আর হেলাল হাফিজের বাবা স্কুলশিক্ষক। হেলাল হাফিজের বাবা দারোগার মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে চাননি, এ নিয়ে দুই পরিবারে বিরোধ ঘটে এবং হেলাল হাফিজ হেলেনকে বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা বললে হেলেনও নির্বিকার থাকেন। পরে হেলেনের বিয়ে হয় ঢাকার একটি সিনেমা হলের (সম্ভবত মুন সিনেমা হল) মালিকের সাথে।
হেলেনের বিয়ে হয়ে যাবার পর হেলাল হাফিজ দশ-পনেরো দিন কারো সাথে কোনো ধরনের কথা বলেননি। তার ভাবি তার বিয়ের জন্য তাকে কোনো মেয়ের ছবি দেখালেই তিনি বলতেন, 'ভাবি, এই মেয়েটা দেখতে ঠিক আমার মায়ের মতো।' এর পর তার ভাবি তাকে আর কোনো মেয়ের ছবি দেখাতে সাহস করেননি।
তীব্র দুঃখ বুকে চেপে নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় পাড়ি জমান হেলাল হাফিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেখাপড়াও করেছেন। ব্যতিক্রমী ও সহজবোধ্য কবিতা লেখার ফলে তার খ্যাতি ক্যামপাস থেকে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল দেশব্যাপী। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে'।
হেলেনের স্বামী বইমেলা থেকে অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি 'যে জলে আগুন জ্বলে' বইটিও কিনে বাসায় নিয়ে যান। হেলেন যখন দেখতে পেলেন বইটির পুরোটা জুড়ে বিধৃত আছে হেলেন-হেলাল প্রেমউপাখ্যান, আছে হেলালের কষ্টের ইতিবৃত্ত আর হেলেনের জন্য হেলালের শব্দে-শব্দে নিঃশব্দ হাহাকার; তখন ক্রমশ তার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। হেলেনের স্বামী দেশে-বিদেশে হেলেনের উচ্চচিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও হেলেন আর ভারসাম্য ফিরে পাননি। একপর্যায়ে স্বামীর কাছ থেকে হেলেন তালাকপ্রাপ্ত হন।
হেলেন এখন নেত্রকোনায় আছেন। এখন তিনি বদ্ধ উন্মাদ। নেহাল হাফিজের ভাষ্যমতে -- হেলেনকে এখন শেকল পরিয়ে ঘরে বেঁধে রাখতে হয়, ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় ওষুধ খাইয়ে; অন্যথায় তিনি ঘরের আসবাবপত্র ভাংচুর করেন।
পঁয়ষট্টি পেরুনো হেলাল হাফিজ আজও বিয়ে করেননি। যখনই তাকে জিজ্ঞেস করেছি বিয়ে না করার কারণ, তিনি জবাবে বলেছেন -- 'আমি যে কাউকে বিয়ে করিনি, তা নয়; বরং আমাকেই কেউ বিয়ে করেনি!'
কবিরা এই সমাজের অত্যন্ত নিগৃহীত একটি সম্প্রদায়। আর্থিক অনটন থেকে সব ধরনের অনটন কবিকে সদাসর্বদা ঘিরে রাখে। কবিদের ব্যাপারে অনেকেই বিভ্রান্ত। অনেকেরই ধারণা কবিমাত্রই বহুগামী; নারীদের ধারণা -- কবিরা নারীবেষ্টিত থাকেন, অতএব কবিতাকে ভালোবাসা গেলেও ব্যক্তি কবিকে ভালোবাসা যাবে না। এসব ধারণা আর পালটা-ধারণার জাঁতাকালে পড়ে কবি শেষতক নিঃসঙ্গই থাকে, জনতার মাঝে নির্জনতা তাকে ঘিরে রাখে অকটোপাসের মতো। কবির দুঃখ অনুধাবন করতে পারে, কবি ছাড়া এমন ব্যক্তির পরিমাণ নগন্য।
ব্যক্তি হিশেবে কবি হয়তো তুচ্ছ, কিন্তু কবিদের অলৌকিক ক্ষমতা প্রবল। কোনো নারী যদি কবিতার সমঝদার হয়, কবিকে যদি সে এক মুহূর্তের জন্যেও ভালোবেসে থাকে, ভালোবাসার পর যদি সে বঞ্চিত বা প্রতারিত করে কবিকে; তা হলে তাকে নিয়ে কবির রচিত কবিতা একসময়ে তার (ঐ নারীর) জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবেই। ঐ কবিতা ঐ নারীর স্বাভাবিক জীবনকে পরবর্তীকালে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে, মানসিক যন্ত্রণায় জীবদ্দশাতেই সে অজস্রবার মারা যাবে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হেলাল হাফিজের হেলেন।
একেকটি কবিতা একেকটি বঞ্চনার ফসল। বঞ্চনাই কবির কবিতাকে ঋদ্ধ-সিদ্ধ-সমৃদ্ধ করে। তাই বলে কবিকে পদে-পদে বঞ্চিত করতে নেই। মাত্রাতিরিক্ত বঞ্চনা কখনোই ভালো ফল নিয়ে আসে না। কবিকে যে লাগামহীনভাবে বঞ্চিত করে, তার চারিদিকে সদা ঘুরে বেড়ায় হেলেনের শেকল!
গ্রন্থ : প্রিয়াঙ্গনে রণাঙ্গনে
আখতারুজ্জামান আজাদ