“Be the change that you wish to see in the world.”
বদলে যাও, বদলে দাও...নিজেকে বদলাও। সামাজিক পরিবর্তন আনতে হলে সমাজের বিভিন্ন উপাদানের পূর্বে নিজেদের চিন্তাচেতনার পরিবর্তন আনা আবশ্যক। নারী হোক বা পুরুষ হোক, উভয়েরই একটা বিশেষ সমস্যা আছে...তারা একে অপরকে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ফেলতে পছন্দ করে (অবলা, স্বার্থপর জাতি ব্লা ব্লা ব্লা)! কিন্তু একবারের জন্য হলেও একটু ভেবে দেখুন তো, আমরা একে অপরকে ছাড়া চলতে পারি কিনা? আমি পুরুষ অধ্যুষিত সমাজের পক্ষে সাফাইও গাইছি না কিংবা নারীবাদী কোন কথাও বলছি না...আমি সমাজে উভয়ের গুরুত্বের কথা বলছি। এক দেড়শ বছর আগে মেয়েরা অসূর্যস্পর্শ্যা ছিল কিংবা তাদের জীবন শুধুমাত্র হেঁসেলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। আজকে মুক্তির স্বাদ কী গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে শুধুই মেয়েদের ইচ্ছাবলে? এখানে মায়ের পাশাপাশি বাবা, ভাই কিংবা স্বামির কী কোন ভূমিকা নেই? পুরুষ কখনও পিতা হিসেবে, কখনও ভাই হিসেবে, আবার কখনও স্বামী হিসেবে এগিয়ে এসেছে...অপরপক্ষে নারী মা হিসেবে, বোন হিসেবে, স্ত্রি হিসেবে পুরুষদের বিভিন্ন পদক্ষেপের সাথী যুগ যুগান্তর ধরে হয়েছে। জগত সংসার শুধু নারী কিংবা শুধু পুরুষ দিয়ে নয়...উভয়ের সাহায্যেই চলে। গাহি সাম্যের গান...দুজনের একজোট হওয়ার মাধ্যমেই সমবন্টন সম্ভব কিংবা সামাজিক পরিবর্তন...ক্ষমতায়নের আলগা বুলি আওড়ানোর মধ্যে দিয়ে নয়। আজকে এই ধরনের থিমের উপর তৈরিকৃত সিনেমা এবং সেই পরিবার নিয়ে আলোচনা করবো যার মূলভাব অনেকেরই চিন্তা চেতনা কিছুটা হলেও বদলে ফেলতে সক্ষম।
দঙ্গল--- দ্য সিনেমা:
মহাবীর সিং ফোগত...সাধারণ দেখতে এই মানুষটা তার কুস্তিগির হবার স্বপ্ন ত্যাগ করে আর্থিক সমস্যার কারণে। মহাবীরের একটাই স্বপ্ন...দেশের জন্য গোল্ড মেডেল জেতা। সে নিজে তা পূরণ করতে ব্যর্থ হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সে স্বপ্নটার বাস্তবায়ন দেখতে চায়। এই কারণে সন্তান হিসেবে সবসময়ের জন্য ছেলের দাবি করে। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় তার ঘর আলো করে আসে কন্যা সন্তান... একটা নয়, দুটো নয়, চার চারটে। মহাবীর নিজের আজন্ম লালিত স্বপ্নটাকে দিনের দিন মেরে ফেলতে বাধ্য হয় এভাবেই। কিন্তু একদিন তার মেয়েদের সামান্য কাজে আবারও সে সম্ভাবনার নতুন পথ দেখতে পায়...কথা কাটাকাটির জের ধরে বড় মেয়ে গীতা আর মেজ মেয়ে ববিতা পাড়ার দুই ছেলেকে বেদম পেটানো পেটায়। মহাবীর তার মেয়ে দুটোর মধ্যে নিজের কুস্তিগির হবার স্বপ্নটা যেন আবারও নতুন করে দেখতে শুরু করে। তাদেরকে কুস্তিগির বানানোর জন্য সে উঠে পড়ে লেগে যায় এবং সমাজ সংসারের প্রতি মুখ ঘুরিয়ে সে এক নতুন বিপ্লবের সূচনাতে নামে। দঙ্গলে অর্থাৎ কুস্তির ময়দানে সে তার মেয়েদেরকে অংশগ্রহণ করায় ছেলেদের প্রতিপক্ষ হিসেবে! এরপর?? এরপরে এক নিরব বিপ্লব আসে...যা একইসাথে অসাধারণ এবং প্রেরণাদায়ক হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে
কেন দেখবেন দঙ্গল:
১) প্রথম কারণ...আমির খান। পেশিবহুল ভার্সেস মেদবহুল...দুই ধরনের আমির খানেরই দেখা পাবেন। এবং বিশ্বাস করুন, তার অভিনয় দেখে আরও একবার মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না।
২) অনেকে দঙ্গলের সাথে সুলতানের সামঞ্জস্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন। দুটো মুভিই আমি দেখেছি এবং উভয় মুভিকে বিবেচনা করে বলছি, দঙ্গল-সুলতানের আসমান জমিন ফারাক। সুলতানে ফিকশন পার্ট, প্রেম আবেগ সংক্রান্ত বিষয় বেশি ছিল...কিছু কিছু জায়গা অতিরিক্ত মনে হয়েছিলো। কিন্তু দঙ্গলে তা নেই। বাবা এবং দুই মেয়ের স্বপ্ন এবং তাদের সংগ্রামের গল্প আছে এতে যা ফিকশনালাইজড না।
৩) মনোমুগ্ধকর গান, আইটেম নাম্বার, ঝাঁ চকচকে লোকেশন, প্যানপ্যানানি গল্প ছাড়াও যে একটা দারুণ পর্যায়ের সিনেমা হতে পারে... দঙ্গল তা আরও একবার প্রমাণ করেছে।
৪) এখানে একমাত্র স্টার পারফর্মার... আমির খান। এ বাদে আমির খানের স্ত্রি-র চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন সাক্ষী তানোয়ার, তিনি হিন্দি সিরিয়াল ইন্ডাস্ট্রির অত্যন্ত পরিচিত এবং প্রিয় মুখ হলেও বড় পর্দাতে এর আগে উল্লেখযোগ্য কোন কাজ করেননি। পুরো সিনেমার অ্যাক্টিং ক্রু বলতে গেলে একদমই সাদামাটা। কিন্তু তাদের একেকজনের অভিনয় জাস্ট অসাধারণ...মিস্টার পারফেকশনিস্ট এবং সিনেমার পরিচালক এক্ষেত্রে প্রশংসার দাবিদার।
৫) গল্প...ইন্ডিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এখন বায়োগ্রাফি তৈরি করার ধুম পড়ে গেছে। এক্ষেত্রে বায়োগ্রাফির মানুষটি কে হবে সেটা নির্বাচন করা যথেষ্ট কঠিনই বলা যায়। মহাবীর ফোগতের মতো মানুষের গল্প অনেকেরই ধর্তব্যের বাইরে থেকে যেত হয়ত...কিন্তু দিনশেষে যখন এই গল্পটা রুপালি পর্দায় তুলে ধরা হয়, আর কিছু না হলেও সাধারণ ঘরের অসাধারণ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা মানুষগুলো নতুন করে প্রেরণা পায়। প্রেরণা সৃষ্টিকারী মানুষটার এই গল্প সিনেমার সব থেকে শক্তিশালী অংশ।
৬) অ্যাথলেটিকরা আমাদের উপমহাদেশের সবথেকে অবহেলিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের মাথার মধ্যে তিন চারটা বিশেষ প্রোগ্রাম লাইফটাইম ডিউরেশনে ইন্সটল হয়ে গেছে...এই চৌহদ্দির বাইরেও যে কিছু আছে আমরা তা ভাবতে চাই না। দঙ্গলে এই জিনিসটা আরেকবার দেখাবে। অ্যাথলেটিকরা জানছে তারা অবহেলিত, তারা বুঝছে তাদের মূল্য দেবার মত কেউ নেই...তারপরেও দেশের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানটা এনে দেবার জন্য তারা জান প্রাণ লাগিয়ে দিচ্ছে...আমার দেশ, আমার গর্ব! আমাদের উপমহাদেশের এই অবহেলিত প্রেক্ষাপটের সাথে এক উজ্জ্বল স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি দঙ্গলে আছে।
৭) ডায়লগ...সিনেমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। হরিয়ানার স্থানীয় অ্যাক্সেন্টে পুরো সিনেমার প্রতিটা ডায়লগ বলা হলেও...কিছুই বুঝছি না বা এটা কী বললো এমন কিছু মনে হবে না। বলিষ্ঠ শব্দের অনন্যসাধারণ ব্যবহার আছে এতে...Mari choriyan choro se kam he ke!!
দঙ্গল— দ্য রিয়েল রেসলার’স:
মহাবীর সিং ফোগত হরিয়ানার ভিওয়ানি জেলায় হিন্দু জট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি কুস্তিগির ছিলেন এবং আর্থিক সমস্যার কারণে এক সময় তিনি কুস্তি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। স্ত্রি দয়া শোভা কৌর এবং চার মেয়ে গীতা, ববিতা, রিতু এবং সঙ্গিতা নিয়ে তার সংসারটা আর দশটা সাধারণ মানুষের সংসারের মতোই ছিল। জমিজমার বিরোধের কারণে মহাবীরের ভাইয়ের মৃত্যু ঘটলে তার দুই সন্তান ভিনেশ এবং প্রিয়াঙ্কাও তাদের সাথে থাকতে শুরু করেছিল। মহাবীরের স্বপ্ন ছিলো দেশের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে গোল্ড জিতে আনা। সৌভাগ্যক্রমে তার সন্তান গীতা, ববিতা এবং ভাইজি ভিনেশ সেটা করে দেখিয়েছে। এছাড়া রিতু জাতীয় পর্যায়ে গোল্ড মেডেল এবং সঙ্গিতা ও প্রিয়াঙ্কা এজ-লেভেল চ্যাম্পিয়নশিপে সাফল্য অর্জন করেছে। ভাই বোন সবার কোচ মহাবীর নিজেই ছিলেন। গীতা ফোগত ভারতের প্রথম ফ্রিস্টাইল রেসলার যে কমনওয়েলথ গেমসে (২০১০ সালে) গোল্ড জিতে নিয়েছিলো এবং প্রথম নারী রেসলার হিসেবে অলিম্পিকে যাবার সৌভাগ্যও অর্জন করেছিল। ছোট বোন ববিতা ২০১০ সালে কমনওয়েলথ গেমসে সিলভার মেডেল জিতে নিয়েছিল এবং ২০১৪ সালের কমনওয়েলথ গেমসে গোল্ড মেডেল। দঙ্গল সিনেমাটা মূলত তৈরি হয়েছে মহাবীর সিং ফোগত, গীতা ফোগত ও ববিতা কুমারী ফোগতের জীবনের গল্পের উপরে। এখানে ভিনেশ, রিতু, সঙ্গিতা এবং প্রিয়াঙ্কার ক্যারিয়ারের ব্যাপারে তেমন কিছুই দেখানো হয়নি। তাদের পারিবারিক এবং ক্যারিয়ারের ঘটনা অনেকটা সাদামাটা শোনালেও বিষয়গুলো এতটাও সহজ ছিলো না তাদের পক্ষে। মহাবীর যে সমাজ থেকে উঠে এসেছে সে সমাজের অনেকেরই ধারণা ছিল, মেয়ে সন্তান হলে তাকে যেমন তেমনভাবে মানুষ করতে হবে, তাকে দিয়ে বাড়িঘর ঝাড় দেবার কাজ করাতে হবে, তাকে ভবিষ্যতে বিয়ের জন্য তৈরি করতে হবে এবং ১৪ বছর বয়সে ঘাড় থেকে বিদায় করতে হবে। মহাবীর সিং ফোগত সেই বদ্ধমূল সমাজেরই একটা নির্দিষ্ট ধারণার পরিবর্তন এনেছিল। তার সমাজে মেয়েদের কুস্তি লড়ার প্রচলন ছিল না...সে নিজের চার মেয়েকে এবং দুই ভাইজিকে সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর জন্য তৈরি করেছিল। মহাবীর নিজে স্টেট চ্যাম্পিয়ন ছিলেন এবং নিজের মেয়েদের কোচ হবার জন্য তিনি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি শ্রম দিয়েছিলেন প্রচুর পরিমাণে যাতে তার মেয়েরা অন্য কারো জন্য প্রেরণাদায়ক হতে পারে। ব্যাপারগুলো তার জন্য এতটাও যে সহজ ছিলো তা নয়, বিভিন্ন ধরনের মানুষকে তার বোঝাতে হয়েছিলো যে কেন মেয়ে সন্তানকেও সমঅধিকার দিয়ে মানুষ করা উচিত। উপযুক্ত পাত্রের সাথে বিয়ে দেয়া বাদেও তাদের জন্য যে আরও কিছু কর্তব্য রয়েছে তা করে দেখিয়েছে মহাবীর। একসময় সে তার মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য একা হয়ে পড়েছিল, তারপরেও হাল ছাড়েনি একবারের জন্যও...সে তার মেয়েদেরকে জয়ী বানিয়েছে, সাথে নিজেও জিতেছে এক নিরব বিপ্লবের খেলায়।
মহাবীর সিং ফোগত
গীতা কুমারী ফোগত
ববিতা কুমারী ফোগত
ফোগত পরিবার
**** এই লেখা সম্পূর্ণ রূপে আমার… পূর্বের কোন লেখার সাথে মিলে গেলে তা একান্তই co-incidence….no resemblance. আশা করি পোস্টটি ভালো লাগবে !!!!