প্রাচীন ও মধ্যযুগের অবসানে আধুনিককালে ইংরেজের এই উপমহাদেশে আগমন, প্রথমে বণিক বেশে পরে রাজদন্ড হাতে, বাংলায় তাদের প্রভুত্ব বিস্তার, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, সীমিত নগরায়ণ, পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুপ্রবেশ প্রভৃতি তার সকল দোষগুণ নিয়ে বাঙালি বুর্জোয়ার উদ্ভব সূচিত করলো। এর ফলে শিক্ষিত নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত বাঙালির চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ডের পথ বেয়ে বাঙালি সংস্কৃতির একটা রূপান্তর ঘটলো। কিন্তু সে রূপান্তরে সমন্বয় আর থাকলো না। তাছাড়া প্রধানত রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক কারণে গত উনিশ শতক জুড়ে, এমন কি বিশ শতকেরও কিছুটা পর্যন্ত, উপরোক্ত রূপান্তর বাঙালি মুসলমানের জীবনকে ইতিবাচকভাবে স্পর্শ করলো না। ফলে এ যাবৎ লোক-ঐতিহ্যভিত্তিক সমন্বিত বাঙালি সংস্কৃতির যে ধারা গড়ে উঠেছিল তার বিকাশের পথে পথে বাধার প্রাচীর তৈরী হতে শুরু করলো। রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশ বিশ শতকের প্রথম দিক থেকেই শিক্ষিত নগরকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যবোধকে উদ্দীপ্ত করতে শুরু করেছিলো। বঙ্গভঙ্গ আইন ও তা বাতিল করার আন্দোলন, বাঙালি মুসলমানের সর্বক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা ও তজ্জনিত ক্ষোভ, সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত অমুসলমান নেতৃবর্গ কর্তৃক প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন ও সমস্যা সমাধানে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থতা, জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার প্রভৃতি বিষয় ওই বাধার প্রাচীরকে দৃঢ় করে তোলে। সব ধর্মেরই সার কথা মানুষে মানুষে ভালবাসা ও মিলন। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বে হিন্দুত্ব ও ইসলামের মধ্যে স্থূল বাইরের দিকের বিভেদকে সামনে নিয়ে আসা হলো, জীবনাচরণের ক্ষেত্রেও তুচ্ছ বহিরঙ্গের গরমিলগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হলো, অন্তর্গত তাৎপর্যময় যথার্থ মিলগুলো উপেক্ষিত হলো। আর প্রত্যাশিতভাবেই, উপনিবেশবাদী বিদেশী ইংরেজ শাসকবর্গ তাদের কূটবুদ্ধিজাত ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতি অনুসরণ করে এই প্রক্রিয়ায় ইন্ধন জোগালো। গভীর দুঃখে বিদ্রোহী কবি নজরুল হাসির গান লিখলেন,
বদনা-গাড়ুতে পুনঃ ঠোকাঠুকি, রোল উঠিল ‘হা হন্ত!’
ঊর্ধ্বে থাকিয়া সিঙ্গী-মাতুল হাসে ছিরকুটি দন্ত!
মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা, মন্দির পানে হিন্দু;
আকাশে উঠিল চির-জিজ্ঞাসা, করুণ চন্দ্রবিন্দু।
প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারার ফলে শিক্ষিত নগরকেন্দ্রিক মুসলমানদের চিত্তে বুর্জোয়া বিকাশ রেনেসাঁর পথ না ধরে রিভাইভালিজমের পথে অগ্রসর হলো। যেখানে মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমান কবি বাংলা ভাষাকে নিজের ভাষা জ্ঞান করে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করলেন, কাহিনীর পাত্রপাত্রী হিন্দু কিংবা মুসলমান তা নিয়ে মাথা ঘামালেন না, নিঃসংকোচে লোকাচারকে তাদের রচনায় স্থান দিলেন, সেখানে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কতিপয় শিক্ষিত বিত্তশালী অভিজাত বংশীয় বাঙালি মুসলমান তাদের মাতৃভাষা নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের জন্ম দিলেন। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি? সে কোন ভাষাকে আকঁড়ে ধরবে? তা কি বাংলা, না আরবি, না ফারসি, না উর্দু? ইসলামী সংস্কৃতির একটা অস্পষ্ট কৃত্রিম আদর্শের ছবি এঁকে তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে হিন্দু পৌত্তলিকতার নিদর্শন আবিস্কার করলেন। মিলন ও সমন্বয়ের স্থানে দানা বাঁধতে শুরু করলো বিরোধ ও বিচ্ছিন্নতা। আমরা কি বাঙালি, নাকি বাঙালি মুসলমান, এবং যদি বাঙালি মুসলমানই আমাদের যথার্থ পরিচয় হয়, তাহলে আমরা কি আগে বাঙালি ও পরে মুসলমান, নাকি আগে মুসলমান পরে বাঙালি। এটা যেন প্রকৃতই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের বিষয় হতে পারে। এই রকম ‘আগে ডিম, না আগে মুরগি’ জাতীয় কৃত্রিম বিতর্কের অবতারণা করে, অযৌক্তিক অগ্রাধিকারের প্রশ্ন তুলে প্রতিক্রিয়াশীল, আত্মাভিমানী ও অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ বাঙালি সংস্কৃতির পরিচ্ছন্ন স্রোতধারাকে আবিল করে তুললো। এ যাবৎ নানা বৈচিত্র্যের মধ্যেও যার একটা অখন্ড রূপ ছিলো তা খণ্ডিত হলো। অনিবার্যভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশেও বাঁধা পড়লো। অবশ্য বাংলার গ্রামজীবনের গভীরে, যাবতীয় বিচ্চিন্নতামুখী নাগরিক তৎপরতা উপেক্ষা করে, এক ধরনের ঐক্যস্রত তখনো প্রবাহিত হয়ে চলেছিলো। সমন্বিত বাঙালি সংস্কৃতির সেই রূপ আমরা ঘুরেফিরে প্রত্যক্ষ করি লালনসহ বহু বাউল সাধক ও লোক কবিদের রচনায়। তাছাড়া কোনো কোনো নগরকেন্দ্রিক ব্যক্তিও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। শিল্প সাহিত্যের ভুবনে এ পসঙ্গে সহজেই বিদ্রোহী কবির নাম মনে পড়ে। তাঁর অজস্র কবিতা ও গানে বিভেদ সৃষ্টিকারী আচারসর্বস্ব অনুষ্ঠানিকতাপুর্ণ ধর্মের প্রসঙ্গ তীব্র ব্যঙ্গ ও আক্রমণের সন্মুখীন হয়েছে। তার জায়গায় হিন্দু-মুসলমান উভয়ের পুরাণ, ইতিকথা, ধর্ম ও ইতিহাস থেকে আহরিত অনবদ্য উপমা রূপক প্রতীক চিত্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশিত হলো সুস্থ সমন্বিত বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল এক ছবি। অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ হলেও এখানে আরেকটি ধারার উল্লেখও অসঙ্গত হবে না। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের ঢেউ এক সময়ে বাংলাদেশেও এসে পৌঁছায়, এবং সেই বিপ্লবের তরঙ্গাভিঘাতে, বিশেষভাবে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে, বাঙালির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সংবলিত একটা নতুন ধারাও যুক্ত হয়েছিলো। আর তার সুস্থ কল্যাণমুখী প্রগতিশীল মানবতাবাদী চিন্তাধারা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই।
কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে মূলধন করে প্রণীত দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রসার, তৎকালীন সর্বভারতীয় নেতৃত্বের ক্ষীণ দৃষ্টি, ঔদার্যের অভাবজনিত চূড়ান্ত ব্যর্থতা, বিপুল নিরক্ষর ধর্মভীরু গণমানুষের সাময়িক অন্ধ ভাবাবেগ, বাঙালি মুসলমানসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠির সঠিক আত্মপরিচয় আবিষ্কারে অপারগতা, সুবিধাবাদী শ্রেণীর ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধি, সর্বোপরি ইংরেজের কূট-রাজনীতির ফলে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ খণ্ডিত হলো। বাংলাদেশও দ্বিখণ্ডিত হয়ে তার এক অংশ পরিণত হলো ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিম বাংলায়, অন্য অংশ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল পূর্ব বাংলায় বা পূর্ব পাকিস্তানে। রাষ্ট্রীয় ও নাগরিকত্বের পরিচয়ে বাঙালি বিভক্ত হয়ে গেল, তবে সাংস্কৃতিক বিভাজন রাজনীতির সহজ সূত্র ধরে ঘটে না, তার একটা নিজস্ব যুক্তি থাকে। কিন্তু পাকিস্তানের নয়া উপনিবেশবাদী শাসককুল সে সত্য স্বীকার করেন নি। শোষণের স্বার্থে তারা পশ্চিম বাংলার বাঙালি ও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটা দুর্ভেদ্য স্থায়ী পার্থক্য গড়ে তুলতে চান। সংস্কৃতির একমাত্র নিয়ামক শক্তি হিসেবে তারা তুলে ধরেন ধর্মকে। বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে নানাভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলো। তারা বলতে চেষ্টা করলেন যে বাঙালি সভ্যতা বলে কিছু নেই, আছে হিন্দু সভ্যতা ও মুসলমানের সভ্যতা।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের একান্ত বশংবদ গভর্নর মোনেম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম থেকে মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক বাদ দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। হিন্দু দেবদেবীদের কথা বলা হয়েছে, হিন্দু সমাজের চিত্র পরিবেশিত হয়েছে, এ জাতীয় হাস্যকর কুযুক্তির অবতারণা করে তারা বহু শ্রেষ্ঠ বাংলা সাহিত্যকর্মের অবমূল্যায়নে ব্রতী হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি পাঠক্রমে গ্রিক দেবদেবীদের নানা কিচ্ছাকাহিনী ও পৌত্তলিক পরিবেশের বহু গল্প-নাটক-ইতিহাসের মধ্যে কিন্তু তারা আপত্তিকর কিছু দেখলেন না। অথচ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আপত্তি তোলা হলো। বলা হলো, রবীন্দ্রনাথকে খুব বড় করে দেখা ঠিক হবে না। বস্তুতপক্ষে তিনি আমাদের কবি নন। প্রয়োজনবোধে তাঁকে বর্জন করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করবার চেষ্টা করা হলো নজরুলকে, যে নজরুলকে বাঙালি মুসলমানদের একটা ধর্মান্ধ অংশ একদা কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিল। মানবতাবাদী, চিরবিদ্রোহী, জাত-অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, বাঙালির সুস্থ জীবনবাদী সমন্বিত সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ ধারক নজরুলকে তুলে ধরা হলো অবিশ্বাস্য খণ্ডিতরূপে, শুধু মুসলমানের কবি বলে। পূর্ব পাকিস্তানের কিছু বাঙালি সংস্কৃতিসেবীও সেদিন হয় ভ্রান্তি, অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি, কিংবা নেহাতই সঙ্কীর্ণ আত্মস্বার্থবুদ্ধির কারণে উক্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেন। সেদিন সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত হাওয়ায় সম্বিত হারিয়ে তারা নজরুলের কবিতা ও গানের সর্বজন পরিচিত পঙ্ক্তিমালা পর্যন্ত পরিবর্তন করতে এগিয়ে আসেন। এই সব ঘৃণ্য উদ্যোগের ফলে কবির বিখ্যাত গান ‘চল চল চল’ – এর ‘নব জীবনের গাহিয়া গান/সজীব করিব মহাশ্মশান’ হলো ‘নব জীবনের গাহিয়া গান/সজীব করিব গোরস্থান।’ তাঁর অনবদ্য শিশুতোষ কবিতা ‘প্রভাতী’র ‘জয়গানে ভগবানে তুমি বর মাগো রে’ হলো ‘জয়গানে রহমানে তুমি বর মাগো রে।’ সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার মোহে অন্ধ হয়ে কিছু কিছু বাঙালি মুসলমান এই পথেই তাঁদের একটা স্বতন্ত্র জাতীয়তা আবিষ্কারের চেষ্টা করলেন। এ সব প্রয়াস ছিল নির্বোধ, যুক্তিহীন ও হঠকারী।
পাকিস্তানি শাসনের এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খুবই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন। বাংলা ও উর্দুর মিশ্রণে তিনি একটা নতুন পাকিস্তানি ভাষা উদ্ভব করার চেষ্টার কথা বলেছিলেন। তাছাড়াও পাকিস্তানি দুঃশাসনের আমলে সুস্পষ্ট অসাধু উদ্দেশ্য থেকে বাংলা বর্ণমালা, বানান, ব্যাকরণ প্রভৃতির সংস্কার, বাংলা ভাষা সরলীকরণ, রোমান ও আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রবর্তন প্রভৃতি উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে ও সেই সূত্রে সাহিত্যকে দুর্বল ও বিকৃত করে, বাঙালি সংস্কৃতিকে পঙ্গু ও খণ্ডিত করে, এবং ওই পথ ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সমূলে উৎপাটিত করার একটা সার্বিক অপপ্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু ওইসব প্রয়াস সফল হয় নি। যে প্রগতিশীল গোষ্ঠির মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা সক্রিয় ছিল তারা প্রথম থেকেই এসব উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করেছে। এ প্রসঙ্গে ১৯৫২ সালের গৌরবদীপ্ত বাংলা ভাষা আন্দোলনের কথা বিশেষভাবে স্মর্তব্য। কিন্তু আমরা অনেকে হয়তো তার আগের কিছু কিছু তাৎপর্যময় ঘটনার কথা সব সময়ে মনে রাখি না। ১৯৪৪ সালের দিকে কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে বাংলা ভাষার সপক্ষে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এরপর ১৯৪৭ সালের ৫ই আগস্ট গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে একটি সংগঠন জন্মলাভ করে এবং পূর্ব বাংলার সরকারী ভাষা ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি করে। এটিই ছিল পূর্ব বাংলার মুসলমান জনগণের সর্বপ্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন। ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সংগঠনও ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ নামক একটি নতুন গঠিত ছাত্র সংগঠনও বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জোরদার আন্দোলন শুরু করে। এ প্রসঙ্গে ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সদম্ভ উক্তির বিরুদ্ধে কতিপয় শ্রোতার তাৎক্ষণিক সোচ্চার প্রতিবাদ জ্ঞাপন এবং তারও কিছুদিন আগে মন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে ঢাকা জিলা বোর্ড হলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সপক্ষে গণহরতাল প্রভৃতির কথা অবশ্য স্মরণীয়। এইসব আন্দোলনই চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংহতিকরণে ২১শে ফেব্রুয়ারীর বাংলাভাষা আন্দোলনের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য ‘৫২ এর পরও বাঙালির ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী শাসক-শোসকদের চক্রান্ত থেমে যায় নি। সেদিন শাসকগোষ্ঠী জিকির তুলেছিল যে মেয়েদের কপালে টিপ পরা, উৎসব অনুষ্ঠানে আলপনা আঁকা, মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, পয়লা বৈশাখ, বর্ষবরণ, নবান্ন উৎসব প্রভৃতি পালন করা হিন্দুয়ানি। এর মধ্যে যে হিন্দুত্ব বা মুসলমানিত্ব কিছুই নেই, এগুলি যে নিতান্তই বাঙালিত্বের বহিঃপ্রকাশ, বাঙালি জীবনধারার সহজ অংশ, এ সত্যটি তারা সজ্ঞানে উপেক্ষা করেন। কিন্তু প্রগতিশীল বাঙালি সংস্কৃতিকর্মীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে, যারা প্রায় সবাই মুসলমান এবং ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদের চক্রান্তসমূহ ব্যর্থ হয়। এরই ফলে বাংলা বর্ণমালার পরিবর্তে আরবি বা রোমান হরফ চালু হয় নি, বাতিল হবার পরিবর্তে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসনামলেই সারা বাংলাদেশে পরম উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়, বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি পায়, এবং সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, জীবনধর্মী, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশ লাভ করে। বাঙালি সংস্কৃতির দীপ্ত চেতনাকে আশ্রয় করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারার স্ফুরণ ঘটে। তারপর ধাপে ধাপে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ওই প্রগতিশীল ধারাসমূহ আরো উজ্জ্বল ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
যে সমস্ত গ্রন্থপঞ্জি থেকে রেফারেন্স নেয়া হয়েছে:
* বাঙালির ইতিহাস: ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়
* বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ডক্টর আবদুর রহিম
* বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য: ডক্টর আহমদ শরীফ
* মুসলিম বাংলা সাহিত্য: ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক
* বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন: ডক্টর অতুল সুর
* বাংলা সাহিত্যের কথা: ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
* সাংস্কৃতিকী: ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
বাংলা ও বাঙালির বিবর্তনের পথ পরিক্রমা ( ১ম পর্ব )
বাংলা ও বাঙালির বিবর্তনের পথ পরিক্রমা ( ২য় পর্ব )
বাংলা ও বাঙালির বিবর্তনের পথ পরিক্রমা ( ৩য় পর্ব )