জাতীয়তাবোধের উৎপত্তি হয় এক 'বোধ' থেকে এবং এই এক 'বোধ' গড়ে ওঠে বহু কিছু ভিত্তি করে। তার মধ্যে ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি ও ভৌগলিক আবেষ্টন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রধানত এসব ভিত্তি করেই একটি অঞ্চলের মানবগোষ্ঠী সচেতনভাবে নিজেদের এক মনে করে, অন্যদের চাইতে স্বতন্ত্র বিবেচনা করে এবং স্বনির্ধারিত পথে নিজেদের বিকশিত করে তুলতে চায়। গোষ্ঠী সচেনতা হিসাবে জাতীয়তাবাদ তাই একটি মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক সত্য, কিন্তু এই সংজ্ঞা জাতীয়তাবাদের জটিলতা ও বহুমাত্রিকতার পরিচয় পুরো স্পষ্ট করে তুলে ধরে না। আধুনিক যুগের জাতিরাষ্ট্র শুধুমাত্র কোনো জনগোষ্ঠির এক বোধ ও ইচ্ছার ভিত্তিতেই সৃষ্ট হতে পারে না, তাকে অপেক্ষা করতে হয় অনুকূল পরিবেশের জন্য, সুযোগের জন্য, সমাজের ঐতিহাসিক লগ্নের জন্য। যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার সংগ্রামী বিকাশের ফলে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, তা ওই রকম ইতিহাসের জীবন্ত শক্তিসমূহের একটি ফসল, একটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ধারণার বাস্তব রূপায়ণ।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে এই অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। সাংস্কৃতিক চেতনার বিষয়টি অনেক সময়ে নানা বিতর্ক ও বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। সংস্কৃতি বলতে কি বুঝায়? সংস্কৃতি সম্পর্কে মানুষের ধারণা সব সময়ে একই রকম থাকেনি। তবু নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তা এখন একটা জায়গায় সংহত হয়েছে। কোনো এক সময়ে সংস্কৃতির নির্মাতা বা নিয়ামক হিসাবে রক্ত বা রেসিজম বা জাতিতত্বকেই গুরুত্ব দেওয়া হতো। হিটলার বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসাবে বিশুদ্ধ নর্ডিক আর্য জাতির কথা বলেছিলেন। অন্য কোনো এক সময়ে জলবায়ু, ভৌগোলিক পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ প্রভৃতিকে সংস্কৃতি গঠনের প্রধান উপাদানরূপে বিবেচনা করা হয়েছিল। সংস্কৃতি গঠনেও সেই সূত্রে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বিকাশে সামাজিক আচার-আচরণ, ধর্মীয় রীতিনীতি, জীবিকার উপায়, শিল্প-সাহিত্য-ললিতকলা, পালা-পার্বণ-উৎসবাদিসহ জীবন উপভোগের যাবতীয় ব্যবস্থা যে বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল সে সত্যের প্রতি আগে তেমন দৃষ্টি দেওয়া হয় নি।
বর্তমানে মনোবিজ্ঞানী, আচরণবাদী, সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতত্ব বিশেষজ্ঞগণ যে ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেন আমরাও তাকেই গুরুত্ব দেই। অর্থাৎ কোনো একটি জনগোষ্ঠির আচার-আচরণ, ধর্মবিশ্বাস, জীবিকা অর্জনের পদ্ধতি, সামাজিক উৎসবাদি, সংস্কার-কুসংস্কার, তাদের জীবনের হাজারো উপকরণ ও উপাচার, তাদের ভাষা সাহিত্য সঙ্গীত চিত্রকলা নৃত্য ইত্যাদি মিলে তার সংস্কৃতি নির্মিত হয়। এসব কিন্তু সর্বদা সমান গুরুত্বপূর্ণ কিংবা সমান প্রভাববিস্তারী হয় না। কোনো কোনো সময়ে সংস্কৃতির উপরোক্ত উপাদানসমূহের মধ্যে একটি বা বিশেষ কয়েকটি উপাদান অন্যান্য উপাদানগুলোর চাইতে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে; সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠির সার্বিক সংস্কৃতি নির্মাণে মূখ্য ভূমিকা পালনকারী হয়ে উঠতে পারে। এর পেছনে কাজ করে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার যোগসাজস ও অবস্থান। এরই ফলে কালপ্রবাহের বিশেষ কোনো লগ্নে সংস্কৃতিই হয়ে ওঠে একটি জনগোষ্ঠির জাতীয়তাবাদী চেতনা উন্মেষের ও বিকাশের মৌল স্তম্ভ। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে।
কোনো জনগোষ্ঠির সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে একগুঁয়েমির বশবর্তী হয়ে কোনো বিশেষ উপাদানকে মূখ্য বলে চিহ্নিত করলে, সর্বাবস্থায় সর্বকালের জন্য কোনো একটি মাত্র উপাদানকে নিরঙ্কুশ অগ্রাধিকার দিলে, বিভ্রান্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় এবং তার ফলে জন্ম লাভ করে নানা অশুভ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। বর্তমান বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল তখন পাকিস্তানি নয়া উপনিবেশবাদী শাসকগোষ্ঠী এই ভুলটিই করে। তারা সেদিন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের তথা বাঙালিদের সংস্কৃতি প্রসঙ্গে এই অঞ্চলের ভাষা, ভৌগোলিক পরিবেশ, অতীত ইতিহাস, দীর্ঘদিনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যলালিত আচার-আচরণ প্রভৃতিকে উপেক্ষা করে শুধু ধর্মকে অতি গুরুত্ব দিয়েছিল। শুধু ইসলাম ধর্মকে কেন্দ্রীয় স্তম্ভ করে তারা পাকিস্তানি সংস্কৃতি ও পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ফলে দৃষ্টিভঙ্গি ঘোলাটে হয়, বিভ্রান্তি প্রশ্রয় পায়, অন্ধ গোঁড়ামি প্রবল হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে উপনিবেশবাদী শোষণের স্বার্থে, ইসলামের প্রতি ভালবাসার কারণে নয়, তার শাসকচক্র সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির স্বাভাবিক স্রোতধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। ইতিহাসের আয়রনি এখানে যে, তাদের জঙ্গি কর্মকাণ্ড বাঙালিকে আরো প্রতিবাদী করে তোলে, তার সাংস্কৃতিক চেতনার একটা নতুন সংগ্রামী দ্যোতনা যুক্ত করে এবং তার জাতীয়তাবাদী বিকাশকে তরান্বিত করে। সে ইতিহাস ও তার চূড়ান্ত পরিণাম তথা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের কথা সর্বজনবিদিত।
বর্তমানে কোনো জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রেই সংস্কৃতির আদি, অকৃত্রিম, বিশুদ্ধ ও অবিমিশ্র রূপ অকল্পনীয়। বাঙালি মুসলমানের ক্ষেত্রে নানা রকম গ্রহণ-বর্জন ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই তার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি বৌদ্ধদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাঙালি মুসলমানের ধর্ম তথা ইসলাম তার সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়, এমন কি সর্বপ্রধান উপাদানও নয়। ইসলামের মৌলবাদী রূপ তো কোনো উপাদানই নয়। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিশেষে বাঙালির সংস্কৃতি, বিশেষভাবে তার ভাষা ও সাহিত্যগত চেতনা তার জাতীয়তার অন্যতম আশ্রয়। তবে এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার যে, সমন্বয়ই সুস্থ জাতীয়তাবোধকে বিকশিত ও শক্তিশালী করে। সুস্থ জাতীয়তাবোধের ঝোঁক সর্বদাই গ্রহণের দিকে, তবে এই গ্রহনকে অবশ্যই হতে হবে সুবিবেচনাপ্রসূত। নির্বিচারে বর্জন ও কঠোরভাবে গবাক্ষ রুদ্ধ করে রাখলে তার ফল ভালো হয় না। একমাত্র উগ্র ও আগ্রাসী জাতীয়তাবাদই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আত্মধ্বংসী ও বর্জননীতি অনুসরণ করে।
ইতিহাসের গতিধারার গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে একটি মানবগোষ্ঠীর যে জাতি-পরিচয় ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে সে সম্পর্কে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি কৌতূহলোদ্দীপক মন্তব্য আছে। " সাংস্কৃতিকী" গ্রন্থে বাঙালি সংস্কৃতির আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, আকারে যেমন, প্রকৃতিতেও তেমনি বাঙালি ভারতীয় বটে। বাঙালি তাহার আধুনিক সংস্কৃতিতে হয়তো চার আনা ইউরোপীয়, তাহার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে সে কতটা ইউরোপীয় হইবে-এবং আট আনা ভারতীয়, বাকি চার আনা সে বাঙালি এবং এই চার আনার মধ্যে আবার কতটা ভারতীয়ত্বের বিকার-বাকিটুকু খাঁটি বাঙালি অর্থাৎ গ্রাম্য বাঙালি। উপমহাদেশ ভাগ হবার পূর্বে এই মন্তব্য করা হলেও এর অন্তর্নিহিত সত্যটুকু আজও আলোকসঞ্চারী। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যের সূত্র ধরেই আমাদের আরেকটি বিষয়েও সচেতন থাকা দরকার। বাংলাদেশে যেখানে শতকরা প্রায় আশি জন লোকের বাস পাড়াগাঁয়ে এবং যারা প্রধানত কৃষিজীবী সেখানে ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতির মূল ধারক ও বাহক পল্লীগ্রাম ও তার জনগণ। সকল সীমাবদ্ধতা ও অপূর্ণতা সত্ত্বেও লোকজ ঐতিহ্যপুষ্ট গ্রামীণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আমাদের আরো অনেক বেশি মনোযোগী ও অনুরাগী হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সংস্কৃতি বিষয়ক যাবতীয় আলোচনায় আমরা সাধারণত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিক মানুষের সংস্কৃতির কথাই বলি, যার জন্ম ও অবস্থান শহরে, যা প্রধানত মানস সংস্কৃতির ইতিহাসই বহন করে। জীবিকাগত বা বাস্তব উপকরণগত সংস্কৃতি সম্পর্কে যা অতি অল্পই অবহিত।
জাতিগত ও বাস্তব উপকরণের অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং তার হাত ধরে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণের বিষয়টি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। অর্থনৈতিক বিকাশধারা যখন ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে ইতিবাচকভাবে স্পর্শ করে তখনই সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। তখন পল্লী ও নগরের ব্যবধান হ্রাস পায়, লোক-সংস্কৃতির সঙ্গে নগর-সংস্কৃতির একটা স্বাভাবিক যোগসূত্র গড়ে ওঠে এবং তখন বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গেও তার রাখিবন্ধন ঘটে।
যে সমস্ত গ্রন্থপঞ্জি থেকে রেফারেন্স নেয়া হয়েছে:
* বাঙালির ইতিহাস: ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়
* বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ডক্টর আবদুর রহিম
* বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য: ডক্টর আহমদ শরীফ
* মুসলিম বাংলা সাহিত্য: ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক
* বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন: ডক্টর অতুল সুর
* বাংলা সাহিত্যের কথা: ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
* সাংস্কৃতিকী: ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
বাংলা ও বাঙালির বিবর্তনের পথ পরিক্রমা ( ১ম পর্ব )
বাংলা ও বাঙালির বিবর্তনের পথ পরিক্রমা ( ২য় পর্ব )
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:২৪