বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলে দেখতে পাই, বাংলা ভাষার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত এবং কবিদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি। দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখতে পাই, মোগল সম্রাট আকবরের আমলে। বৈশাখ মাসকে প্রথম মাস নির্ধারিত করে সম্রাট আকবর যে সৌরবৎসর প্রবর্তন করেন, বাংলা ভাষাভাষী জনসাধারণ সর্বতোভাবে তা গ্রহণ করে। এখনও বাঙালির গৃহে সেই পঞ্জিকা অনুযায়ী পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাদেশে তার মাটি, পরিবেশ ও পরিপার্শ্ব থেকে প্রাণরস আহরণ করে একান্তভাবে দেশজ ও লোকজ ঐতিহ্যলালিত হিন্দু-মসুলমান নির্বিশেষে একটা ইন্টিগ্রেটেড বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। সম্প্রদায়ভেদে, শ্রেণীভেদে, ধর্মভেদে, পেশাভেদে কিছু কিছু আচার-অনুষ্ঠান ও জীবনযাপন রীতির ক্ষেত্রে উপর স্তরে দৃষ্টিগ্রাহ্য বিভিন্নতা থাকলেও মৌল স্তরে নিবিড় ঐক্য ছিল। ব্যাপক গ্রামীন জনগোষ্ঠির আবেগ অনুভূতির ক্ষেত্রে তলের দিকে বিদ্যমান ওই মৌলিক ঐক্যই তখন সমাজকে বেঁধে রেখেছিল, তার সুস্থতা সুনিশ্চিত করেছিল, এবং নানা বিচিত্র ও আকর্ষণীয় সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ সম্ভব করে তুলেছিল। বাঙালির লোকসঙ্গীত, লোকগাঁথা, লোককাব্য, বাউল সাধনা ও গ্রামীণ মেলাসহ নানা লোকউৎসবের মধ্যে আমরা তা লক্ষ্য করি। ধর্মীয় উগ্রতা ও রাজনৈতিক কূটবুদ্ধি-সৃষ্টি ভেদবুদ্ধি তখনও তেমন প্রতিষ্ঠা লাভ করে নি। কিছুটা উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রথম দেখা পাই সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলের (সপ্তদশ শতাব্দী) কবি আবদুল হাকিমের রচনায়। বাংলা ভাষার প্রতি এক শ্রেণীর মুসলমানের বিরূপতা দেখে ক্ষুব্ধ কবি লেখেন,
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে-সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতাপিতামহক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।
উক্ত পংক্তিগুলোর আগের পংক্তিগুলোতে কবির মধ্যে ধর্মীয় সমন্বয়-সাধনের প্রেরণাও দেখতে পাওয়া যায়।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপ নিরঞ্জন।।
সর্ব বাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
কবি আবদুল হাকিম রচিত কবিতাটি নানাদিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত বাংলাভাষা-বিদ্বেষীদের তিনি বেজন্মা বলে গালি দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা ভৌগলিক জাতীয়তাবাদী চেতনার সাথে মিশে গেছে। তাই তিনি দেশীভাষা বিরোধীদের দেশ ত্যাগ করে বিদেশে চলে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। তৃতীয়ত তিনি 'নিরঞ্জন'কে সর্বধর্মের ও মতের মানুষের ঈশ্বর এবং সর্বজ্ঞরূপে প্রচার করেছেন। তিনি গোটা বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলকে বোঝাবার জন্যে 'বঙ্গদেশ' শব্দটিও ব্যবহার করেছেন। তাঁর আগের কোনো বাঙালি কবির রচনায় এ ধরনের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেশাত্মবোধের নিদর্শন নেই বলেই পণ্ডিতগণের অভিমত। কবি আবদুল হাকিমের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই ঊনবিংশ শতাব্দীর বাউল কবি লালন শাহের গানে।
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন ভাবে, জাতের কিরূপ দেখলাম না এ নজরে।
যদি সুন্নাত দিলে হয় মুসলমান, নারী লোকের কি হয় বিধান
বামুন চিনি পৈতেয় প্রমাণ, বামনী চিনি কিসেরে।
কেউ মালা কেউ তসবী গলায়, তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়
যাওয়া কিংবা আসার বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কারু রে।
লালনের এ গানের মধ্যে যুগপৎ সমন্বিত জাতীয়তাবাদ ও বিশ্বমানবতাবাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখতে পাই। বলা বাহুল্য, এটি বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতির একটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
সাহিত্য ক্ষেত্রে জাতি গঠনের কার্যে সজ্ঞান সাধকদের মধ্যে সৈয়দ সুলতান একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। সৈয়স সুলতান ছিলেন সুফি মতাবলম্বী পীর। কোরানে আছে, পৃথিবীতে এমন জাতি নেই যাদের কাছে তাদের নিজ ভাষাভাষী নবী প্রেরণ করা হয় নি। সৈয়দ সুলতান ঐ মূল সূত্র অবলম্বন করেই নিরাকার সর্বশক্তিমান একেশ্বরবাদী মুসলমান, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নানা প্রকার প্রতীক-পূজারী সর্বভূতে ঈশ্বরবাদী এবং নিরাকার নির্গুণ নির্বিকার পরম সত্যে বিশ্বাসী ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য সাধনের জন্য তাঁর রচনায় ব্রাক্ষণ, বিষ্ণু, মহেশ্বর, শ্রীকৃষ্ণ প্রমুখের অবতার বা নবী এবং ঋক, যজু, স্যাম এবং অথর্ব এই চারটি আসমানি কিতাবের প্রাপকরূপে স্বীকৃতি দেন। এই সমন্বয় সাধনের প্রেরণা থেকেই মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি চন্ডীদাস বাঙালি জনসাধারণকে লক্ষ্য করে দৃঢ় স্বরে ঘোষণা করেন; শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবও ওই সময়েই ঘটে। শ্রীচৈতন্য চতুর্বর্ণীয় ব্রাক্ষণ্য ধর্ম অস্বীকার করে জাত-ধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষের বোধগম্য, আনুষ্ঠানিকতাবর্জিত, প্রেম ভক্তিবাদী মানবিক ধর্ম প্রচার করেন। চন্ডীদাস এবং শ্রীচৈতন্যের মতের সাথে ইসলাম প্রচারকারী মুসলিম সুফী সাধকদের মতের মিল আছে। সুফি দরবেশগণ কতকটা শ্রীচৈতন্যের মতোই যথাসম্ভব আনুষ্ঠানিকতাবর্জিত সর্বেশ্বরবাদী দর্শন সংশোধিত ইসলাম প্রচার করেন। সর্বেশ্বরবাদী মতের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই মহর্ষি মনসুরের 'আনল হক' - 'আমিই সত্য' ঘোষণার মধ্যে। এ মত পোষণের অপরাধে তিনি এবং সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার প্রবর্তক শেখ শিহাবুদ্দীন বাগদাদের শরীয়তপন্থি শাসকগণ কর্তৃক প্রাণদন্ডে দন্ডিত হন। তাঁরা সে দন্ড গ্রহণ করেন, তবু মত পরিবর্তন করেন নি।
ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাংলাদেশে ইসলামের সুফি মত বেশি প্রসার লাভ করে। সুফি মতের ইসলামের সাথে বাংলার মূল সুরটির তেমন বিরোধ নেই। সুফি মতের ইসলাম সহজেই বাংলার প্রচলিত যোগমার্গ এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধনমার্গের সাথে একটি আপোষ করে নিতে সমর্থ হয়েছিল। আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতে, আধ্যাত্মিক ও মারফতি সাহিত্যে ইরানের সুফি প্রভাবও রয়েছে এবং বাউল মুর্শিদা ছাড়াও নিছক দার্শনিক তত্ত্ব এখানে কম মেলে না। বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ের কারণ বোধ হয় এই যে, মানুষের হৃদয়ানুভূতিতেও মননের এমন একটি স্তর আছে, যেখানে সব ভেদাভেদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমাদের দেশের সাধকগণ অতি মাত্রায় আচারবর্জিত ও মর্মনিষ্ঠ। তাই এমন নির্বিচার সমন্বয় সম্ভব হয়েছে। সাহিত্যবিশারদের মন্তব্যের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলা যেতে পারে যে, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে পল্লীবাংলার কৃষিজীবী মানুষের পক্ষে যথাসম্ভব সমন্বিত সামাজিক জীবন যাপন করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। এক মাঠে হালচাষ, একই ধরনের ফসল উৎপাদন, মূলত একই ধরনের আহার্য গ্রহণ, এক হাটে হাট-বাজার, এক ঘাটে স্নান প্রভৃতি করার ফলে দৈনন্দিন বাস্তব জীবনে সমন্বয় সাধিত হতে বাধ্য। সুফি দরবেশ সাধক সন্ন্যাসী বাউল বৈরাগী প্রভৃতি ধর্ম সংস্কারকগণ এই পরিবেশগত বাধ্যবাধকতার সাথে সহযোগিতা করেছেন। "মানুষের ধর্ম" বক্তৃতামালার এক স্থানে রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত মধ্যযুগের উপমহাদেশের কবি রজ্জবের দুটি পঙক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। রজ্জব বলেছেন, 'সব সাঁচ মিলৈ সো সাঁচ হৈ, না মিলে সো ঝুঁট। জন রজ্জব সাঁচী কহী ভাবই রিবিন ভাবই রূধ।' অর্থাৎ 'সব সত্যের সঙ্গে যা মেলে তাই সত্য, যা মিলল না তা মিথ্যে। রজ্জব বলছে, এই কথাই খাঁটি, এতে তুমি খুশি হও আর রাগই কর।
সংকর জাতের বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের এক ভাষাভাষী লোক যখন এক গ্রামে অভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যে বসবাস করে, তখন 'সব সত্যের সঙ্গে যা মেলে' তেমন সত্যকে অবলম্বন করেই জীবনযাপন করতে হয়। এভাবে বংশপরস্পরাগত জীবনযাপনের মধ্যেই জাতিক চেতনা দানা বাঁধে। এই সমন্বয়ের মধ্যে বহু পরস্পরবিরোধিতা, এমনকি, বহু অসত্য হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু পল্লীবাসী সাধারণ মানুষ সেগুলো নিয়েই আপন আপন আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী সাংসারিক জীবনযাপন করে।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও বাঙালি সমাজের এই সমন্বিত জীবনযাপনের প্রমান পাই। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত ও সম্পাদিত 'ময়মনসিংহ গীতিকা'র কাহিনী-কাব্যগুলোর রচনাকাল নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু স্পষ্টত মুসলিম আমলে রচিত কাহিনীগুলোতেও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণীর মানুষকে সংসারী সাধারণ মানুষের দোষে গুনে ভূষিত করা হয়েছে। দরিদ্র ও উৎপীড়িতের প্রতি সহানুভূতি এবং শ্রেণী-স্বার্থান্ধ সমাজপতি এবং জালেম শাসকশ্রেণীর প্রতি লেখকের ঘৃণাকে যদি জাতীয়তাবোধ বলা যায়, তাহলে 'ময়মনসিংহ গীতিকা'র পালাগান রচয়িতাগণকে বাঙালি সমাজের হিতৈষী মানবতাবাদী বলতেই হয়। 'ব্রাক্ষণকুমার হইল চন্ডালের দূত' এবং পরে মুসলমান 'পীরের অদ্ভুত কাণ্ড সকলি দেখিয়া, ককে'র পরাণ গেল মোহিত হইয়া। তারপর 'জাতি ধর্ম সকলি ভুলিয়া পীরের প্রসাদ খায় অমৃত বলিয়া' প্রভৃতি উক্তির মধ্যে একটি সমন্বিত জাতির উপাদান দেখতে পাই। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেছেন, 'পূর্ব ময়মনসিংহে সেনরাজ প্রতিষ্ঠিত ব্রাক্ষণ্য ধর্ম ও সংস্কৃত শাস্ত্রের প্রভাব পৌঁছায় নাই। এই জন্য সপ্তদশ এমন কি অষ্টাদশ শতাব্দীর ছড়াগুলিতে ব্রাক্ষণ্য প্রভাব অথবা সংস্কৃতের আনুগত্য বিশেষরূপে দেখিতে পাই না। পূর্ব ময়মনসিংহের সাহিত্য বঙ্গদেশের অপরাপর অংশের সহিত্যের মত নহে। এখানে শাস্ত্রের অনুশাসন বাঙালির ঘরগুলোকে আটাআটি করিয়া বাঁধে নাই। এখানে পাষাণচাপা অত্যাচারের ফলে প্রেম বিদ্রোহের সৃষ্টি হয় নাই, এখানে ঘরের জিনিষকে শিকল দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টা দেখা যায় নাই। এই জন্য গীতিকাগুলির সর্বত্র দেখা যায় পুরুষ ও নারী নিজেরা বিবাহের পূর্বে পরস্পরকে আত্মদান করিয়াছেন, তারপরই বিবাহ হইয়াছে।' আরও একটু যোগ করে বলতে পারি যে, বহুকাল হতে বাংলাদেশে প্রচলিত লোককাহিনীগুলোও একই প্রমাণ দেয়। বাংলার সকল লোককাহিনী মানুষ, ভূত, প্রেত, দেও-দেওনী রাজা উজীর কোতোয়াল অথবা রাজপুত্র কোতোয়াল পুত্রের কাহিনী। এগুলোতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প নেই। রেভারেন্ড লালবিহারী দে রচিত 'Folk Tales of Bengal' - এর বাংলা ভাষায় প্রকাশিত অন্যান্য লোককাহিনীর সংকলনগুলো তার প্রমাণ।
আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের জনসাধারণের গান-বাজনা, তাল, সুর, লয় এবং নৃত্য ও বাদ্যযন্ত্র প্রায় অভিন্ন। ভাটিয়ালি সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চলের স্বর; ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, জারি, মেয়েলি গান, কবিগান, বাউল, মুর্শিদা, মারফতি প্রভৃতি জাতীয় গীত সকল বাঙালি সানন্দে উপভোগ করে। নির্ধারিত কয়েকটি ধর্মানুষ্ঠান এবং মৃতের সৎকার-পদ্ধতি প্রভৃতি ব্যতিরেকে বাকি সকল প্রকার উৎসব মেলা প্রভৃতিতে সকলের সমাবেশ হয়। দেশীয় খেলাধুলা - লাঠি খেলা, তরবারি ও রামদা'র খেলা, হাডুডু, দাইরা প্রভৃতি সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের ক্রীড়া, বাসগৃহের সকল নির্মাণ-কৌশল, ভিতরের আসবাব, নকশি কাঁথা, শয্যা, তৈজসপত্র, কৃষিজ যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি অভিন্ন। ধর্মীয় বিধানের বিশেষভাবে নিষিদ্ধ কয়েকটি দ্রব্য ব্যতিরেকে ধর্ম-নির্বিশেষে সকল বাঙালির খাদ্যতালিকা ও পাক প্রণালী অভিন্ন। বারবণিতা এবং বারবণিতালয়ে যারা যাতায়াত করে তাদের জাতকুল ধর্মভেদ নেই। অভিজাত শ্রেণীর দরবারী পোশাক ছিল। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাকি সকল বাঙালির পোশাক পরিচ্ছদ এখন হতে এক শতাব্দী আগেও ছিল নেংটি, গামছা, ধূতি, চাদর, লুঙ্গি, ফতুয়া, খড়ম ইত্যাদি। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি পল্লী রমণীর পোশাক পরিচ্ছদ, অলংকারপত্র, প্রসাধন দ্রব্য প্রভৃতি আগেও অভিন্ন ছিল। কিঞ্চিৎ উন্নতির পর, এখনও প্রায় অভিন্ন।
পূর্ববর্তী আলোচনা হতে আমরা কতগুলো সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে পারি -
ক) চর্যাপদ রচিত হওয়ার পর, যে কারণেই হোক, কমপক্ষে আড়াই শ' বছর বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয় নি বললেই চলে; অন্তত তার কোনো প্রমাণ নেই;
খ) স্বাধীন সুলতানি আমলে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের নামকরণ হয় 'বাঙ্গালা' এবং অধিবাসীরা বাঙালি পরিচয় লাভ করে;
গ) স্বাধীন সুলতানি আমলেই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে সাহিত্য রচনা শুরু হয়। সুলতানগণ হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মাবলম্বী সাহিত্যকর্মীর পৃষ্ঠপোষকতা করেন;
ঘ) বহিরাগত হলেও বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ বাংলাদেশকে স্থায়ী বাসভূমিরূপে গ্রহণ করেন। সুতরাং রাজনৈতিক কারণে হলেও এ দেশবাসী জনসাধারণের সমর্থন ও সহযোগিতা তাঁদের কাম্য ছিল। এ কারণেই হয়তো তাঁরা বাংলা সাহিত্যের চর্চায় উৎসাহ দিতেন। কেননা, জাতিগত চেতনা-সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্থাপনের সর্বোত্তম মাধ্যম ভাষা। স্মরণীয় যে, গৌড়-লক্ষণাবতীর অধিপতি ও এ দেশের স্থায়ী অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও পাল ও সেন রাজগণ বাংলা ভাষা নির্মাণকার্যে সহায়তা করেন নি;
ঙ) নানা মত দর্শন ও ধর্ম বিশ্বাসের সংমিশ্রণজাত সুফিবাদে বিশ্বাসী ধর্মপ্রচারকগণের প্রচারের ফলেই এ দেশের জনসাধারণ ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বাংলাসহ উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও দেবমূর্তি ও মন্দির ভাঙ্গার দৃষ্টান্ত আছে; কিন্তু তরবারির ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করার দৃষ্টান্ত বিরল। যদি তাই হতো, তাহলে মুসলিম শাসনামলের কেন্দ্রীয় রাজনীতি এবং সংলগ্ন প্রদেশগুলোতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখতে পাওয়া যেত। প্রত্যন্ত প্রদেশ বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হতো না;
চ) স্বাধীন সুলতানি আমলেই শ্রীচৈতন্যের মতো হিন্দু ধর্ম সংস্কারক, সাধু সন্ন্যাসী এবং প্যানথিস্ট মতবাদী মুসলমান সুফিসাধকগণ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে যথাসম্ভব আচার-অনুষ্ঠানবর্জিত এক প্রেমভক্তিবাদী সমন্বিত লোকধর্ম প্রচার করেন। এই লোকধর্মে ব্রাক্ষণ্য ধর্মের মানুষে মানুষে কৃত্রিম ভেদ প্রথা বর্জিত হয়। ইসলাম ধর্মে তো তত্ত্বীয় বিচারে সকল মানুষের মর্যাদা সমান-পৃথিবীতে মানব জাতি আল্লাহতালার খলিফা বা প্রতিনিধি।
উপরি-উক্ত সমন্বয় প্রক্রিয়া মোগল রাজত্বের শেষাবধি (বাংলার নবাবি আমলসহ) অব্যাহত থাকে। আবদুল হাকিম, আলাওল, ভারতচন্দ্র প্রমুখের রচনায় তার প্রমাণ পাই। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই সমন্বয় প্রক্রিয়ার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় কবীর, খাজা মইনুদ্দীন চিশতি প্রমুখের প্রতি হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মালম্বীর শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যে। উচ্চকোটি শ্রেণীতে হিন্দু মুসলমানের বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়। আকবর হতে শুরু করে প্রায় সকল মোগল সম্রাটের রাজপুত মহিষী ছিল। এদের কোনো একজনকে বলপূর্বক মোগল হেরেমে আনা হয় নি। সুতরাং এই অনুসিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, বাঙালি হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষের আত্মপরিচয়ের সূত্রপাত হয় স্বাধীন সুলতানি আমলে। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে আত্মপরিচয়ের বৈশিষ্ট্য-অর্থাৎ বাঙালির বাঙালিত্বের চেতনা আধুনিক জাতীয়তাবাদী চেতনার কাছাকাছি এসে পৌঁছে।
যে সমস্ত গ্রন্থপঞ্জি থেকে রেফারেন্স নেয়া হয়েছে:
* বাঙালির ইতিহাস: ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়
* বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ডক্টর আবদুর রহিম
* বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য: ডক্টর আহমদ শরীফ
* মুসলিম বাংলা সাহিত্য: ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক
* বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন: ডক্টর অতুল সুর
* বাংলা সাহিত্যের কথা: ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
* সাংস্কৃতিকী: ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
বাংলা ও বাঙালির বিবর্তনের পথ পরিক্রমা ( ১ম পর্ব )
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:০৯