বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের ন্যায় রাশিয়ান ফেডারেশনের মুসলমানরা মঙ্গলবার পবিত্র ঈদ-উল-আযহা উদযাপন করেছেন। রুশ, তাতার এবং ককেশীয় অঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত স্বশাসিত প্রজাতন্ত্রগুলোতে এ উৎসব’কে “কুরবান বাইরাম” নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ভেড়া বা বকরী কোরবানী।
প্রতিবারের মত এবারও আগে থেকেই নিয়ত ছিল ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করার। ঈদ কাজের দিনে পড়ে যাওয়াতে একটু বিপাকে পড়তে হয়। এমনিতেই মস্কোতে বসে দেশীয় ঈদের আমেজ অনুভব করা কঠিন। তারপর মরার ওপর খাঁড়া ঘা। নামাজের জন্য বসের কাছে মলিন মুখে অর্ধবেলা ছুটি চাইবার প্রত্যাশা বড্ড বিরক্তিকর। ঈদ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হলে অবশ্য অন্য কথা। বাসাতে টুকটাক ভোজন আয়োজনও সম্ভব হয়ে ওঠে। এবার কর্ম দিবসে পড়ে যাওয়াতে ভোজন আয়োজনের আশা ত্যাগ করতে হল।
আগের দিন অর্থাৎ সোমবার অফিস ছুটির পর থেকেই মনটা খারাপ। অর্ধবেলা তো ছুটি পাওয়াই গেল না। তবে শুধু নামাজের সময়টা বরাদ্দ হল। আমার কাছে তাতেই বা কম কিসে! সাধারণত কর্ম দিবসে ঈদ হলে বাংলাদেশ দূতাবাসে যাই নামাজ আদায় করতে। কারণ সেখানে নামাজের পর হালকা খানাপিনার ব্যবস্থা থাকে প্রতি ঈদে। “আজ ঈদ, আজ সেমাই খাইব” সেমাই ছাড়া ঈদ যে নিরামিষ হয়ে যাবে, এর মূল আকর্ষণে। দূতাবাস আমার বাড়ী থেকে প্রায় এক ঘণ্টার পথ। তাই এবার সেখানে যাবার হাই রিস্ক নিলাম না। মস্কোতে চারটি কেন্দ্রীয় মসজিদগুলোর মধ্যে একটির অবস্থান বাড়ীর এবং অফিসের মাঝামাঝি। সেখানেই যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সাধারণত বাইরে কোথাও গেলে আলোকচিত্রগ্রহণযন্ত্রটি সর্বদা সঙ্গীরূপে সাথেই থাকে। তবে এবার খুব তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বেমালুম সেটার কথা ভুলে যাই। এমনিতেই আগের দিন থেকে মনটা খুব উদাস, চঞ্চল এবং অস্থির ছিল।
এই মসজিদটিতেই নামাজ আদায় করেছি। ছবিঃ ইন্টারনেট
যাহোক বাড়ীর নিকটবর্তী মসজিদটিতেই গেলাম পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করতে। কেন্দ্রীয় মসজিদগুলোতে যাওয়াটা হালকার ওপর রিস্ক হয়ে যায়। এর আগেও বেশ ক’বার যাওয়া হয়েছে। কোনকালেও মহলের ভেতর জায়গা জোটে নি। ভোর পাঁচটা থেকেই ভেতরের সব জায়গা দখল হয়ে যায়। মসজিদ সংলগ্ন খোলা আকাশের নীচে নামাজ সারতে হয়েছে। তার ওপর সেদিন হালকা বৃষ্টিপাতের আভাস ছিল। সকালে মেঘলা আকাশকে সাথী করে দোয়া-দুরুদ পড়তে পড়তে চলে গেলাম আল্লাহ্র নাম নিয়ে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল এবং আল্লাহ্র নামে বের হওয়াতে কোনও প্রকার ঝামেলা, বিড়ম্বনা ব্যতিরেকেই নামাজ আদায় সুন্দরভাবে সম্পন্ন হল। তারপর দুঃখভরাক্রান্ত মনে ছুটলাম অফিস পানে।
যারা ভোর পাঁচটা থেকে জায়গা দখল নিতে পারে নি, তাদের ভাগ্য ছিল এরূপ। ছবিঃ ইন্টারনেট
রাশান ফেডারেশনের মুসলিম অধ্যুষিত স্বশাসিত যেমন তাতারস্তান, চেচনিয়া, দাগীস্তান, বাশকিরস্তান প্রভৃতি অঞ্চলগুলোতে সরকারী ছুটি থাকে। সেটা যে দিনই হোক না কেন। তেমনিভাবে বৌদ্ধদের উৎসবগুলোতেও তাদের অধ্যুষিত স্বশাসিত যেমন বুরিয়াতিয়া, সাখা (বৈকাল হ্রদ) প্রভৃতি অঞ্চলগুলোতে সরকারী ছুটি বরাদ্দ থাকে। আমি যে সংস্থায় কর্মরত সেখানে অনেক তাতার, বৌদ্ধ কাজ করে। তাদের ভাগ্যও আমার অনুরূপ। এবার অফিসে তাতার ফুডই আহার করতে হল সবাইকে আনন্দের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। প্রায় সব ধর্মরেই মিলন মেলা। সব ধর্মের উৎসবই হয়ে ওঠে সর্বজনীন।
বাংলাদেশ দূতাবাস, ছবিঃ ইন্টারনেট
রাশান ফেডারেশনের রাজধানী মস্কোর কেন্দ্রীয় মসজিদগুলোতে হাজার হাজার মুসুল্লিরা সকালে পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করেন। এখানকার প্রায় সব সরকার অনুমদিত মসজিদগুলো তাতার দ্বারা পরিচালিত। সেখানে তাতার এবং রুশ ভাষায় বয়ান হয়। মস্কোতে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশ মূলত হয় বাংলাদেশ দূতাবাসে নয় অল রাশান এক্সিবিশন সেন্টারে অবস্থিত কিরগিজ ভবনে নামাজ আদায় করেন। এর মূল কারণ, সেখানে নামাজ এবং বয়ান অনুষ্ঠিত হয় মাতৃ ভাষায়। যা সবারই বোধগম্য।
কিরগিজস্তান প্যাভিলিয়ন। সোভিয়েত সময়ে প্রজাতন্ত্রটির ঐতিহ্য এবং বৈজ্ঞানিক অর্জনগুলো প্রদর্শিত হত। এখন ইলেক্ট্রনিক ও পোশাক মার্কেট। জুমার দিনে এবং দুই ঈদে নামাজের স্থান।
নামাজ আদায় করতে মাত্র দু’ঘণ্টা সময় বরাদ্দ ছিল। আবার কোরবানিতে শরীক হওয়া! নাহ, এবার কোরবানিতে শরীক হতে পারি নি। তাতে দুঃখ নেই। দেশে আমার নামে কোরবানি হচ্ছে। সেখানেই সন্তুষ্টি এবং পরিতৃপ্তি। এখানে আমরা বাঙালি মুসলমানেরা যেভাবে কোরবানি দেইঃ মস্কোর আউটার সার্কেলের বাইরে অর্থাৎ শহরতলীতে প্রছুর গবাদিপশুর ফার্ম আছে। যেগুলোর অধিকাংশ রাশান মুসলমানদের মালিকানাধীন। তাদের সাথে আগেই কথাবার্তা বলা থাকে। নামাজ শেষে সেখানে কোরবানি দেওয়া। পুরো মুসলিম রীতি বজায় রেখে সব কিছু সম্পন্ন করা হয়। জবাহ, মাংস কাটাকুটি থেকে শুরু করে সব কিছু। মস্কোর কেন্দ্রীয় মসজিদগুলোর বাউনডারির ভেতর পর্দার অন্তরালে কোরবানি অনুষ্ঠিত হয়। গোশতর বেশিরভাগ অংশ এবং টাকাপয়সা বিতরন হয় মস্কোর মুসলিম এতিমখানাগুলোয়। এ ক্ষেত্রে আমরা বাঙালি মুসলমানরাও পিছিয়ে নেই।
ইমাম সাহেব - বাংলাদেশের বাঙালি মসুলমান। পুরো নামাজ পড়িয়েছেন দেশী স্টাইলে। তাতার জাতি দ্বারা পরিচালিত মসজিদগুলোতেও তাদের ভাষায় নামাজ পড়ানো হয়ে থাকে। ধন্যবাদ ইমাম সাহেব। ঠিক ওপরের এবং এই ছবি গত বছর তোলা।
বিগত বছরগুলোতে রাশান ফেডারেশনে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ১৯৮৯ সালে এই দেশটিতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল এক কোটি বিশ লাখ। ২০০২ সালে রাশিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি চল্লিশ লাখ। অবশ্য অনেকে মনে করেন, রাশিয়ায় মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় বিশ মিলিয়ন বা দুই কোটি। এদের মধ্যে দেড় মিলিয়ন বাস করেন শুধুমাত্র মস্কোতেই। ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে রাশিয়ায় মুফতি কাউন্সিলের প্রধান রাবিল গাইনুদ্দিন দেশটিতে ২৩ মিলিয়ন বা দুই কোটি ত্রিশ লাখ মুসলমান রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়া প্রজাতন্ত্রগুলোর অনেক মুসলমান রাশিয়ায় অভিবাসন করায় এ বিষয়টিও দেশটির মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে লক্ষ্যণীয় ভূমিকা রেখেছে। ইসলাম ধর্মই রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম।
সবার জীবনেই ছোটবেলার ঈদ আর বড় বেলার ঈদের পার্থক্য থাকে। একজন শিশু ঈদের দিনে যে আনন্দ উচ্ছ্বাস নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, বড় হলে সে মানুষটির ভেতর সেই আনন্দ উচ্ছ্বাস আর থকে না। একটা শিশু ঈদের দিন সকাল বেলা যে অনুভূতি নিয়ে পোশাক পড়ে ঘুরে বেড়ায়, সেলামী প্রাপ্তি, সমবয়সীদের সাথে আনন্দে খেলায় মেতে ওঠাঃ বড় হলে সে মানুষটিই সেই অনুভূতি নিয়ে আর এসব কাজ করে না।
ঈদ আসলে ছোটদের। জামা কাপড় পাওয়া, কে কটা পেল, সেসব লুকিয়ে রাখা, কত যে প্রস্তুতি তাদের। ঈদের রাতটা যখন বেড়ে যেতে থাকে, তখন তারাই দুঃখ পায় সবচেয়ে বেশি, ইস! ঈদটা চলে গেল। বড়দের ঈদে আনন্দের চেয়ে দায়িত্বটা বেশী। তারা তো সকাল বেলা নামাজ সেরে, কোরবানির সমস্ত কাজ সেরে এসে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে কি করবেন, আর বুঝতেই পারেন না। সারাটা বছর শুধু কাজ আর কাজ, আজকের দিনটা একটু গড়িয়ে নেবেন নাকি! নাহ, তা কি করে সম্ভব? এখানে আমার বেলাতে অন্তত নয়।
ত্যগের মহিমায় উদ্ভাসিত ও আনুগত্যের উজ্জ্বল মহিমার ভাস্বর পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। ত্যাগ ও খুশির বার্তা নিয়ে আসা দ্বিতীয় এই বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব।
ঈদ মোবারক ও শুভ কামনা সবাইকে