লেখাটি সোনার বাঙলাদেশ ম্যাগাজিন থেকে কপি করা। পড়ার পর ভাবলাম শেয়ার করি। আশা করি ভালো লাগবে
গ্রীনউইচ না মক্কা ?
আল মামুন
পবিত্র কা'বা ঘরের অদুরে, স্কাইস্ক্রেপার আবরাজ আল-বাইতের শিখরে রমজানের শুরুতেই চালু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘড়ি Makkah Clock. লন্ডনের বিগবেন ঘড়ির চেয়ে ছয়গুন বড় এই ঘড়ি, ১৩৬ বছর ধরে প্রচলিত Greenwich Mean Time (GMT) কে Makkah Time (MT দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে গন্য করা হচ্ছে। সৌদি সরকার আশা করছে, গ্রীনউইচের বিকল্প হিসাবে মক্কা একদিন বিশ্বে প্রতিষ্ঠা পাবে।
প্রথমেই প্রশ্ন জাগতে পারে GMT কি ? GMT কি সেটা বুঝতে হলে আমাদের Greenwich Meridian সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। Greenwich Meridian হল একটি কাল্পনিক মধ্যরেখা, যা পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে শুরু হয়ে গ্রীনউইচ রাজকীয় মানমন্দিরের (Royal Observatory, Greenwich) মধ্য দিয়ে এন্টার্কটিকা হয়ে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত। গ্রীনউইচ মধ্যরেখায় দ্রাঘিমার (Longitude) মান হল শূণ্য ডিগ্রী। এই গ্রীনউইচ মধ্যরেখাই পৃথিবীকে পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধে দু’ভাগ করেছে। ১৮৮৪ সালে ওয়াশিংটনে ২৫টি দেশের একটি সম্মেলনে, গ্রীনউইচ মেরিডিয়ানকে মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করা হয়। গ্রীনউইচ রাজকীয় মানমন্দিরে মাপা সময়ই হলGreenwich Time, বা Universal Time নামেও পরিচিত। গ্রীনউইচ মেরিডিয়ানের ঠিক উল্টো দিকে অর্থাৎ ১৮০০ দ্রাঘিমা বরাবর প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে টানা হয়েছে International Date Line, এই রেখা অতিক্রম করলে তারিখ বদলে যায়।
আজ থেকে দু’বছর আগে, ২০০৮ সালে কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিম বিজ্ঞানী ও মুফ্তিদের একটি আর্ন্তজাতিক সম্মেলন --"Mecca: The Center of the Earth, Theory and Practice". এই সন্মেলনে গ্রীনউইচের বদলে মক্কাকে কেন্দ্র করে সময় গননা করার আহ্বান জানানো হয়। সন্মেলনের বক্তারা মক্কাকে Global Meridian হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষে যুক্তি ও প্রমান তুলে ধরেন। মক্কা হল পৃথিবীর কেন্দ্র এবং আধিপত্যের জোরেই বৃটেন ও পশ্চিমা শক্তি গ্রীনউইচকে বিশ্বের উপর চাপিয়ে দিয়েছে বলে সম্মেলনের বক্তারা দাবী করেন। তবে মক্কাকে পৃথিবীর কেন্দ্র বলাটা ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে, কারণ আমরা জানি, পৃথিবীর কেন্দ্র বা Core ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত। আমার মতে, পৃথিবীর বুকে মক্কার বিশেষ অবস্থানকেই দোহা সম্মেলনে পৃথিবীর কেন্দ্র বলে ধারণা দেয়া হয়েছে ।
পৃথিবীর মানচিত্রে মক্কার বিশেষ অবস্থানের পক্ষে প্রচলিত কিছু প্রমান এখন তুলে ধরছি। প্রকৃতিতে, মানুষের দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, DNA, গাছ পালা, মানব ইতিহাসের বিখ্যাত চিত্র ও স্থাপত্যকর্ম থেকে শুরু করে এমনকি মহাশূন্যের গ্যালাক্সির গঠনেও একটি বিশেষ ধ্রুবকের সন্ধান পাওয়া যায় যাকে বলা হয় Golden Ratio. এই ধ্রুবকের মান হল 1.6180. নিঁখুত সৃষ্টির (Perfect Design) জন্য এই অনুপাত ব্যবহৃত হয় বলে এটাকে অনেকে Divine Ratio বলে থাকেন। হিসাব করে দেখা গেছে মক্কা থেকে দক্ষিণ মেরু এবং মক্কা থেকে উত্তর মেরুর দুরত্বের অনুপাত (12348.32 km/7631.6 km) হল Golden Ratio অর্থাৎ 1.6180. আবার উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু এবং মক্কা থেকে দক্ষিণ মেরুর মধ্যেকার দুরত্বের অনুপাত (19980km/7631.6 km) nj 1.6180, সেই Golden Ratio. তাই মুসলিম বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীর Golden Mean Point হল মক্কা।
Phi Matrix নামক একটি কম্প্যুটার সফ্টওয়্যার, গ্রাফিক ডিজাইনে Golden Mean Point (GMP) নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই Phi Matrix সফ্টওয়্যারেই পৃথিবীর দ্বি-মাত্রিক ম্যাপ বসিয়ে দেখা গেছে পৃথিবীর GMP হল মক্কা। কুরআনেও এর ইঙ্গিত রয়েছে বলে দাবী করা হয়। সুরা আল ইমরানের (৩ঃ৯৬) ৯৬ নাম্বার আয়াতে বেক্কা (মক্কার আদি নাম) শহরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতে যতগুলি অক্ষর রয়েছে তার Golden Mean হল ৪৭/১.৬১৮ = ২৯। আর উক্ত আয়াতের শুরু থেকে বেক্কা শব্দটি পর্যন্ত সব ক’টি অক্ষরের যোগফল হল ২৯, তার মানে বেক্কা বা মক্কা, আয়াত ৯৬ এর Gi Golden Mean Point এ অবস্থান করছে।
কানাডিয়ান ইসলামিক কংগ্রেসের জন্য ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Dr. Len Guelke পৃথিবীর একটি নতুন মানচিত্র তৈরী করেছেন। তাঁর মতে, গোলকাকৃতিক পৃথিবীর প্রচলিত দ্বি-মাত্রিক মানচিত্রে পৃথিবীর আকারের সঠিক প্রতিফলন ঘটেনা, তাই দু’টি স্থানের মধ্যেকার দুরত্বের মাপে কিছুটা বিকৃতি থাকে। কিন্তু ডঃ লেনের তৈরী এই মানচিত্রে মক্কা থেকে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের দুরত্ব সরল রেখায় নিপুণভাবে মাপা যায়। এই নতুন ম্যাপ থেকে যে বিস্ময়কর তথ্য বেরিয়ে আসে তা হল, পানির ভাগ বাদ দিলে পৃথিবীর সমগ্র স্থলভাগের কেন্দ্র হল মক্কা শহর। মক্কার পক্ষে মুসলিমরা এমনি আরো অনেক যুক্তি/প্রমান উপস্থাপনা করে থাকেন। তবে বিরুদ্ধবাদীদের মতে, মক্কার ঠিক উল্টো দিকে পৃথিবীর অন্য পৃষ্ঠে, মক্কার মত একটি জায়গা পাওয়া যাবে যা Golden Ratio'র সব শর্ত পূরণ করবে।
বিশ্বের মুসলিমরা যদি শত বছরের পুরোনে গ্রীনউইচের জায়গায় মক্কাকে প্রতিস্থাপনের দাবী করেই থাকেন, তবে সেই দাবীকে আমি অযৌক্তিক বলে মনে করিনা। কারণ গ্রীনউইচ মেরিডিয়ান হল এটি কাল্পনিক রেখা যা কিছু দেশের সহমতের ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল, আর সমগ্র বিশ্ব একই সাথে গ্রীনউইচকে গ্রহন করেণি। যেমন ফ্রান্স ১৮৮৪ সালের মেরিডিয়ান সন্মলেনে ভোটদান থেকে বিরত থাকে এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত ফ্রান্সের ম্যাপে প্যারিস মেরিডিয়ান ব্যবহৃত হয়। প্যারিস ছাড়া অন্যান্য যে সব মেরিডিয়ান প্রচলিত ছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল ব্রাসেল্স, আলেক্জান্ড্রিয়া, গিজার পিরামিড, জেরুজালেম, রোম, ওয়াশিংটন ডিসি, ষ্টকহোম, ইত্যাদি। তাই নতুন একটি মেরিডিয়ান চালু করার প্রস্তাবে আমি দোষের কিছু দেখিনা। তবে ধর্মীয় কারণে মুসলিমদের কাছে মক্কার যে রকম গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে, অমুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছে মক্কা একই ধরণের মূল্য পাবে এমন ভাবাটা হবে মারাত্মক ভুল। তাই ধর্মীয় আবেগ নয় বরং একুশ শতকের বাস্তবতা, পরাশক্তির ক্ষমতার বলয় ইত্যাদির উপর নির্ভর করবে প্রস্তাবিত নতুন মেরিডিয়ানের সফলতা।
গ্রীনউইচ মেরিডিয়ানের বদলে একটি নতুন মানদন্ড চালু করলে সমগ্র বিশ্বের নৌ/বিমান পরিবহন, জিপিএস, স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব পড়বে। বিশ্বের তাবৎ ভৌগলিক পরিসংখান ও তথ্য যাবে বদলে। উল্লেখ্য, গ্রীনউইচ ভিত্তিক IDL প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু মক্কা ভিত্তিক আর্ন্তজাতিক তারিখ রেখা যাবে ( IDL ) কানাডা ও আমেরিকার মধ্য দিয়ে, ফলে কানাডা ও আমেরিকায় একই সাথে দু'টি দিনের সৃষ্টি হবে। পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকা এটা খুব সহজেই মেনে নেবে বলে মনে হয়না। তাই আদৌ এই পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন আছে কিনা তা মুসলিম বিশেষজ্ঞ সমাজকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।
গ্রীনউইচ মেরিডিয়ানকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চাপিয়ে দিয়েছে বলে দোহা সন্মেলনে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তা আমার কাছে পুরোপুরি গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি। এটা অনস্বীকার্য, ১৮ শতকে জোর্তিবিদ্যা ও নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে বৃটেন অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। আর যদিও গ্রীনউইচ মেরিডিয়ান মূলতঃ চালু হয় ১৮৫১ সালে, কিন্তু দেখা গেছে, ১৮৮৪ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জাহাজের মানচিত্রে গ্রীনউইচ মেরিডিয়ান নির্দেশিকা হিসাবে ব্যবহৃত হচিছল। ফলে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দীদের ডিঙিয়ে গ্রীনউইচ সহজেই আর্ন্তজাতিক সমর্থন লাভ করে। তাই মক্কাকে গ্রহনযোগ্য করে তুলতে হলে প্রথমে আরব ও মুসলিম বিশ্বকেই তাদের সরকারী মানচিত্রে গ্রীনউইচের বদলে মক্কা মেরিডিয়ান প্রতিস্থাপন করে বিশ্বকে দেখাতে হবে। তবে দুঃখ জনক হলেও সত্য, জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা একুশ শতকের মুসলিম বিশ্ব পশ্চিমা প্রযুক্তির উপর এতোই নির্ভরশীল যে, মক্কা মেরিডিয়ানের সফলতা নিয়ে অনেকেই এখন সন্দিহান। তবে চেষ্টা করে দেখলে দোষের কি? সভ্যতার উত্থান-পতন হল জগতের স্বাভাবিক রীতি। তাই আগামী কোনো একদিন মুসলিম সভ্যতার যে পুনরুউত্থান হবেনা সেই ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায়না। কে জানে - তখন হয়ত মক্কা পৃথিবীর মূল মধ্যরেখা হিসাবে সমগ্র বিশ্বের স্বীকৃতি পাবে।
এই সংক্রান্ত একটি ভিডিও
http://www.youtube.com/watch?v=19zUWMCJTnE
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৮:৩২