ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক লোকজন এবং আমাদের সমসাময়িক প্রজন্ম সবাই হয়তো সুশান্ত পালের ব্যাপারটা জানেন। কিন্তু এই গণ্ডির বাইরের অনেকের কাছেই ব্যাপারটা ঘোলাটে। তাদের অনেকেই আমাকে ফেসবুকে নক্ করে বা ফোন করে কি হয়েছে তা জানতে চাচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্যেই আজ গরুর রচনা স্যরি ‘সুশান্ত পালের’ নামে রচনা লেখা শুরু করলাম।
প্রথমে তার পরিচয় দিয়ে নেই। তিনি চুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করেছেন। তিনি যথেষ্ট মেধাবী এবং ভালো বক্তা। ৩০তম বিসিএসে তিনি রেকর্ড সংখ্যক মার্ক পান এবং প্রথম হয়ে ‘কাস্টমস অফিসার’ হিসেবে জয়েন করেন। তিনি ‘ক্যারিয়ার আড্ডা’ নামক বিভিন্ন সভা সেমিনার করে বেড়ান। সেসবে সেমিনারে তিনি বিসিএসের প্রতি মোটিভেশনাল বক্তব্য রাখেন পাশাপাশি সদম্ভে নিজের বিজ্ঞাপন করেন। আর করবেন ই না বা কেন? সভা সেমিনার আয়োজন করতে যত লক্ষ টাকাই লাগুক তা তো তিনি নিজেই দেন। এখানে একটু খটকা আছে। একজন সরকারী অফিসার এত্তো এত্তো টাকা কোথায় পান?
নিজের বিজ্ঞাপন করতে করতে অবশ্য তিনি ভালোই সফল। যেখানে যান যুবক যুবতীরা ঘিরে ধরে। ফেসবুকে অলরেডী প্রায় আড়াই লক্ষ ফলোয়ার। যেকোন পোস্ট দিলেই নিমিষেই হাজার হাজার লাইক, কমেন্ট, শেয়ার। পত্রিকাগুলোর পড়াশোনা সেকশনটায় প্রায়ই উনার লেখা, বিসিএস বিষয়ক সাজেশন্স প্রকাশিত হয়।
অবশ্য উল্টোটাও হয়। অনেকেই তার ঘোর বিরোধী। তার নিজের ইউনিভার্সিটি চুয়েটের বেশিরভাগ ছাত্র তাকে উন্মাদ এবং অসামাজিক হিসেবে মনে করেন। তিনিও প্রায় কথায় চুয়েটের শিক্ষকদের অপমান করতে ছাড়েন না। সাধারণত ফেসবুকেই তিনি নিয়মিত স্ট্যাটাস দেন। তার কথার সাথে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই তিনি তাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করে ব্লক করে দেন। চুয়েটের এক ছাত্রের মতে চুয়েটের প্রায় এক হাজার ছাত্রকে তিনি ফেসবুকে ব্লক করে রেখেছেন। তবে মেয়েরা এক্ষেত্রে যথেষ্ট ছাড় পান।
উনার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ইদানিং তিনি বিয়ে করলেও অনেক আগে থেকেই পরনারীর প্রতি তার ভক্তি অপরিসীম। ফেসবুকে উনাকে নক্ করে উত্তর পাওয়া ছেলের সংখ্যা নগণ্য হলেও মেয়েদের তিনি নক্ করে কথা বলেছেন, উত্তপ্ত যৌনালাপ করেছেন এরকম প্রমান অসংখ্য। এইতো মাত্র সেদিন আমার এক পরিচিতা উনার এক পোস্টে কমেন্ট করেছে আর ওমনি তিনি নক্ করে বসলেন। শুধু তাইনা, এটাও জানালেন তিনি তখন ঢাকায় ছিলেন, সময় পেলে যেন তার সাথে দেখা করে। তার কাছে কোন মেয়ে বিসিএসের পরামর্শ চাইলে তিনি পরামর্শের বিনিময়ে অন্য কিছু দাবি করে বসতেন। হুট করেই চ্যাটে চুমু দিয়ে দিয়েছেন বা আরও অশ্লীল কথা বলেছেন এমন স্ক্রীনশটও এখন ভাইরাল।
ঢাবির ছাত্রী বিয়ে করে নিজের বউ এবং ভার্চুয়াল হাজার হাজার প্রমিলা ফলোয়ার নিয়ে দিনকাল ভালোই চলছিলো। বছর খানেক আগে সুশান্ত পাল বিশালাকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেমিনার করতে চাইলো। যার জন্য দুই লক্ষ টাকা সে নিজেই দেবে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ মানুষ তার আসল রূপ জানে। অনেকেই প্রতিবাদ করলো যাতে সুশান্ত পাল না আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার করা হলো না। অপমানিত হয়ে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন।
আমরা ভাবলাম সব সেখানেই শেষ। কিন্তু সেই ছাই চাপা তুষের আগুন এতদিন নিরবে জ্বলেছে কে জানতো? সেই আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো ইদানিং। তিনি ফেসবুকে একটা নোট লিখলেন। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দোজখ, ছাত্রদের অমানুষ, আর ছাত্রীদের কুত্তি বলে সম্বোধন করলেন। যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই তার গল্পে সেটাই ছিলো উপজীব্য। তার বক্তব্য ছিলো খুবই অশালীন, অশ্লীল এবং নোংরা। আল্লাহ্ ভালো জানেন তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামে চালিয়ে দিয়েছেন কিনা।
তার নোংরামিগুলো লিখতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে তবুও নমুনাটা দিচ্ছি।
"তার মতে ঢাবিতে অতিমাত্রায় র্যাগিং হয়। বড় ভাইয়েরা প্রতিবন্ধীদের অযথা নির্যাতন করে। বই খাতা ছুড়ে ফেলে দেয়। শীতের সময় সারারাত নগ্ন করে বাইরে দাড় করিয়ে রাখে। গেস্টরুমে সবার সামনে মাস্টারবেশন করতে বাধ্য করে। আবার চায়ের সাথে সেই বীর্য মিশিয়ে জোড় করে খাইয়ে দেয়।"
ওয়াক থু!
কিন্তু বাস্তবে সবাই জানে এগুলো সবকিছুই বানোয়াট। ঢাবির ইতিহাসে কখনোই কাউকে র্যাগ দেয়া হয়নি, আমার বিশ্বাস কক্ষনো দেয়া হবেও না। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার যখন মাত্র দ্বিতায় বর্ষে উঠলাম তখন আমাদের হলের নেতা আমাদের কাউকে র্যাগ না দিতে কঠোরভাবে হুশিয়ারি দিয়েছিলেন।
যখন ভর্তি পরীক্ষা হয় তখন পরিচিত অপরিচিত অনেক জুনিয়র পরীক্ষা দিতে আসে। রুমে দুজন অতিথি এলে আমাদের শোবার জায়গা থাকে না। সবাইকে আমরা চিনি না তবুও থাকতে দেই। রুমে তাদেরকে ঘুমাতে দিয়ে আমরা হয়তো একটা রাত ছাদে আড্ডা দিয়ে বা টিএসসি পলাশী হাটাহাটি করে কাটিয়ে দেই। ছাত্ররা যাওয়ার সময় বলে, "ভাইয়া অন্য ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে গেলে যেখানে র্যাগ খাওয়ার ভয় থাকে সেখানে ঢাবিতে এসে পুরাই উল্টা চিত্র দেখলাম। সত্যিই ঢাবি শ্রেষ্ঠ।"
-তাহলে উনার গল্পে আর বাস্তবতায় এতো আকাশ পাতাল ফারাক কেনো?
-কেনো আবার? ওইতো জমানো ক্ষোভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সেমিনার করতে না পারার অপমান।
তখন আমরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তার ফেসবুকের পোস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারের প্রতিবাদ করি। কিছুক্ষন পর যখন পোস্টটা সবার নজরে এলো এবং সবাই প্রতিবাদ আর নিন্দা জানাতে শুরু করলো, তিনি পোস্টটা একাধিকবার সংশোধন করলেন এবং শেষমেষ মুছে ফেললেন। কিন্তু ফেসবুকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার গ্রুপে সবাই যখন প্রতিবাদ জানানো শুরু করলো, তিনি নিজের ভুল স্বীকার করে একটা পোস্ট দিলেন। কিন্তু বাস্তবে এই ক্ষমা চাওয়া আর “জুতা মেরে গরু দান করা” একই ব্যাপার।
কিছুক্ষন পর তিনি বেশ কিছু ছাত্রকে ফোন করে ভুল স্বীকার করলেন এবং বারবার কি করণীয় তা জানতে চাচ্ছিলেন। একে ওকে ফোন করে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছিলেন। একজন দুজনকে ম্যানেজ করা সহজ কিন্তু হাজার হাজার মানুষ; ঢাবির সাবেক ছাত্রছাত্রী সবাইকে হিসাব করলে এ সংখ্যা কয়েক লক্ষ। এই লক্ষাধিক মানুষকে ম্যানেজ করা খুব কঠিন। আর ব্যাপারটা যেহেতু ঢাবিকে অপমান করা সেহেতু কঠিন না, এককথায় অসম্ভব।
এরইমধ্যে কিছু মেয়েকে পাঠানো তার কিছু সেক্সচ্যাট প্রকাশিত হয়ে গেলো। এবার যেন “জ্বলন্ত আগুনে ঘিঁ” পরলো। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো যে তার বিরুদ্ধে আইসিটি আঈনের আওতায় মানহানি মামলা করা হবে। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর প্রফেসর আমজাদ আলী স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের এডমিনদের সকল প্রমানের হার্ডকপি সহ দেখা করতে বললেন।
আজকে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মিলিত হয় এবং সুশান্ত পালের বিচার দাবি করে মানববন্ধন করে। সেইসাথে প্রক্টর স্যারের সাথে দেখা করলে প্রক্টর স্যার ছাত্রছাত্রীদের মামলা করার আশ্বাস দেন এবং উপাচার্য প্রফেসর ড. আ. আ. ম. স. আরেফিন সিদ্দিক স্যারের সাথে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানান।
ছাত্রদের দাবি তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বাতিল করা হোক পাশাপাশি সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক। এরকম উন্মাদ মানুষ যখন দেশের কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন তখন দেশের লাভের জায়গায় ক্ষতি হয়ার সম্ভাবনাই বেশী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটা একটা জাতির প্রাণ। পৃথিবীতে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যা একটা দেশের জন্মে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে। দেশের যেকোন ক্রান্তিলগ্নে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য আর বাংলাদেশের ঐতিহ্য ভিন্ন নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই বাংলাদেশের আরেক রূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং এ এক নম্বর নয়, কিন্তু বাংলাদেশীর সবার মনের র্যাঙ্কিং এ এক নম্বর।
আর সামান্য একজন মানুষ তিনি কিনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন! আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, প্রশাসন, শিক্ষক, দেশের জনগণ এটা মুখ বুজে সহ্য করবে?
-অসম্ভব।
তাকে শাস্তি পেতেই হবে। এমন শাস্তি যাতে আর কোনদিন কোন সুশান্ত পাল বা অন্য কোন হরিপাল শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোন ব্যাক্তির বিরুদ্ধে কোন মনগড়া কথা না বলতে পারে। শাস্তি কিন্তু কোন প্রতিশোধ নয়, শাস্তি হল একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন। এবার যদি কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন না হয়, তাহলে হয়তো এরকম হাজার হাজার সুশান্ত পাল জন্ম নেবে। যারা যেই প্লেটে খাবে, সেই প্লেটেই মলত্যাগ করবে। এদের মধ্যে কয়েকজন হয়তো দেশের খেয়ে বিদেশের দালালি করবে, দেশের দুর্নাম রটাবে।
এদের তারটা শুরুতেই কেটে দেয়া ভালো না?
এ বিষয়ে আরও নিউজ পড়তে এখানে দেখুন
সুশান্ত পালকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করলো ঢাবি শিক্ষার্থীরা
সুশান্ত পাল বিষয়ে হার্ডলাইনে ঢাবি
সুশান্ত পালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে ঢাবি প্রশাসন
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবর
মানববন্ধনের ভিডিও
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১:০৯