টিচার শব্দের একটা ইলাবোরেশন পেয়েছি। TEACHER , T-Terrific, E-Energetic, A- Able, C - Cheerful, H- Hardworking, E- Enthusiastic, R- Remarkable। জীবনে অতীতে তাকিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। এরকম কোন শিক্ষক কি পেয়েছি যার সাথে এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সবগুলোই পাওয়া যায়? স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় উত্তর সব পর্যায় পার করে এসে শুধু একজনের কথা মনে পড়লো। আমাদের মামুন স্যার। না,তিনি কোন স্কুল কলেজ ভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন না। ছিলেন আমাদের কোচিং ক্লাসের শিক্ষক! খুব মেধাবী ছিলেন , ফার্স্টক্লাস পেয়েছিলেন, তবু প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে ঢোকেন নি , ঢুকবেনই বা কেন? প্রাইভেট পড়ালে অনেক গুণ বেশি ইনকাম হয়।বিশেষত যখন উনার ক্লাসে ব্যাচকে ব্যাচ তিল ধারণের জায়গা থাকতো না।-অবশ্যই এটা একটা অনুমান , ভুল হতেও পারে। হয়ত তাঁর অন্য কোন কারণ ছিল। তবু সিগনিফিকেন্ট ব্যাপার আমার কাছে এটাই যে, এত এত শিক্ষক শিক্ষিকার কাছে জীবনে পড়লাম আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য কিনা পেলাম কোচিং ক্লাসে পাঠদানকারী শিক্ষকের কাছে! এটাও অবশ্য আমি অস্বীকার করবো না, যে শিক্ষক তিনি যেখানেরই হোন , তার প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধাবোধ আছে। পড়াশোনা কোন কালেই ভালো লাগতো না, বেশি পড়তাম না। খুব উপভোগ্য মামুন স্যারের ক্লাসগুলোতে কিন্তু আমার ক্লাসেই শেখা হয়ে যেত, তাও আনন্দের সঙ্গেই। এমনিতে আমি খুব মুখচোরা, আগবাড়িয়ে বলা তো দূরের কথা, জিজ্ঞেস করলে অনেকসময় পারা জিনিসও বলতে থতমত খেয়ে যাই। কিন্তু ইনার ক্লাসে আনন্দ নিয়ে পড়া বলার জন্য হাত তুলতাম আর সবার আগে।উনি পড়াতেন কেমেস্ট্রি। পরীক্ষার আগে একসময় ভুলে সেকেন্ড পেপারের প্রিপারেশন নিয়ে ফেলি ফার্স্টের বদলে তবু যে এ প্লাস মার্ক পাই তার কারণ তার ভালো পড়ানো, আমার নিজের কোন কৃতিত্বই ছিল না।
তখন বয়স কত হবে- বারো সম্ভবত।একবার বই দিতে বেশ দেরি হলো। অনেকে আগের বছরের বই নিয়ে পড়া শুরু করলো।আমরা চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকলাম কবে বই আসবে। আমি পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে একটি জ্বালাময়ী পত্র লিখলাম আমাদের বই না পাওয়ার কথা নিয়ে। খুব কাঁচা হাতের বেশ বড় চিঠি তবু খুব অবাক করে দিয়ে চিঠিটা আসলেই ছাপা হয়ে গেল। লিখেছিলাম খুব লুকিয়ে লুকিয়ে, রাতের অন্ধকারে দরজা বন্ধ করে, ছাপা হবার পরে সবাইকে মহা গর্ব নিয়ে দেখাতে লাগলাম।ভাবটা এমন, না জানি কি বিশাল কাজ করে ফেলেছি! সবাই খুব উৎসাহ দিলো। কিছুদিনের মধ্যে আসলেই বই দেয়া হলো স্কুলে ।বাড়িতে পড়াতে আসতেন জাকারিয়া হুজুর , তিনি আমাকে নগরীর মশা সমস্যা নিয়ে লিখতে বললেন! কি সরল সেই দিনগুলো, মনে হতো লিখলে বুঝি আসলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়! যেমন করে আমাদের পিতামাতার কাছে সমস্যা জানাবার অপেক্ষা মাত্র, ব্যস মুসকিল আসান। কিন্তু নগরপিতারা আসলে মোটেই অত দয়াশীল নন।
এবার ঠিক বছর শুরুর দিনেই বই পেয়েছে শিশুরা। খুব আনন্দের কথা। আমাদের মত সময় নষ্ট করার প্রক্রিয়ায় ওদের যেতে হলো না। তবে ভাবছি অন্তত শুক্রবারটায় না দিলে কি হতো না? কি হতো যদি সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা ওদের ছুটির জন্যই ছেড়ে দেয়া হতো?
খুব ছেলেমানুষী ভাবনা, তাই না? কি করবো? আমি যে দিব্যি মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি বইগুলো নিয়ে ওরা বাড়িতে যাবার সাথে সাথে গার্জেনদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যাবে। কার্টুন চ্যানেলের উপর নিষেধাজ্ঞা নেমে আসবে। কোচিং , টিউটরের যাওয়া আসার পালা শুরু হয়ে যাবে। বছরের প্রথম দিন থেকে বাচ্চাগুলোর উপর চাপের রোলার কোস্টার চালানো আরম্ভ হয়ে যাবে।
আমার খুব মনে আছে, প্রথম যখন বই পেতাম, কি ভালো লাগতো নতুন বইয়ের পাতার ঘ্রাণ।অন্য বইয়ে আমার আগ্রহ ছিলো না, শুধু বাংলা বইটার গল্পগুলো সেদিন সেদিনই পড়ে শেষ করে ফেলতাম। তারপরে সহপাঠ। বইয়ের ছাপানো আমাদের দেশে সবসময় নিন্মমানেরই, অবহেলার, কাগজ বাজে, তাতে রং রস কিছু নেই। ছবিতে সহজ করে উপস্থাপনের , বাচ্চাগুলোর মন ভোলানোর, আকৃষ্ট করার মতো প্রায় কিছুই নেই। কঠমঠে বাক্য, শুধু নীরস শিক্ষণীয় বিষয়, কাজের কথা।তবু সেই নিন্মমানের হেলাফেলায় বাঁধানো বইতে একটা স্পট থাকলেও মন খারাপ হয়ে যেত। আগেই বলেছি, আমার আগ্রহ মূলত গল্প অংশটার প্রতিই ছিল।তবু যেই উৎসাহ নিয়ে প্রথম তার সাথে পরিচয় হতো, যখন ধারালো করে চুলচেরা কাটাছেঁড়া বিশ্লেষণের জন্য সেই গল্পগুলোরই লাইন তুলে দিয়ে বলা হতো, আলোচনা কর বা ব্যাখা কর, তখন আগের উৎসাহ আনন্দের লেশমাত্রও আর অবশিষ্ট থাকতো না। শিক্ষাগ্রহন একটি পরিশ্রমের বিষয় কিন্তু আমাদের দেশে এটা জোর করে একটি প্রাণান্তকর কষ্টের বিষয় করে ফেলা হয়েছে।
শীতের রাতে আমার পড়শী নিশুরা ভাই বোন মিলে ব্যাডমিন্টন খেলে,আরো অনেকেই খেলে। হাঁটতে বার হয়ে চোখে পরে কোর্ট কাটা, লাইট জ্বলছে , তার মধ্যে চঞ্চল শিশু কিশোরদের ছোটাছুটি।খুব ভালো লাগে। দুএকদিন থেকে আর নিশুকে দেখা যাচ্ছেনা কোর্টে ।তবে গাড়িতে দেখা যায়। কোচিং ক্লাসের আসা যাওয়ার ফাঁকে।শীতে অনেকের বাড়িতে আজকাল আর পিঠা হয়না, পরিবারের সবাই মিলে দলবেঁধে একসাথে সকালগুলোতে গল্পগুজব করে খাওয়ার আয়োজনের তো প্রশ্নই ওঠে না। কারোর বেশী ইচ্ছা লাগলে দোকান থেকে কিনে খায়। সেটা বাণিজ্যিক ফাঁকিবাজি পিঠা। মা যেমন পাটিসাপটা করেন, তাতে পুরু করে ক্ষীর দেয়া থাকে, ভাপা পিঠাগুলো তো এতো বড় হয় একটা খেতেই কষ্ট হয়, পেট ভরে যায়।দোকানের পিঠাগুলোতে পাটিসাপটায় পুর এত চিকন যে কিসের তৈরী তা-ই ভালো করে বুঝতে পারিনা। চিতই , ভাপা পিঠা গুলোর সাইজ ছোট ছোট । কয়েকটা খেয়ে ফেলা যায় একবসায়।এযুগে মায়েদের সময় নেই বানানোর,বাচ্চাকে নিয়ে স্কুল আর শিক্ষকের বাসায় দৌড়াচ্ছেন। বাবারা হয়ে গিয়েছেন সাংসারিক টাকা কামানোর মেশিন, বিশেষ করে বলতে গেলে সন্তানের পড়ারখরচ আয়ের।একার উপার্জনেও তা কুলাচ্ছে না, যোগান বাড়াতে মায়েরাও কাজে নেমেছেন। দশ বিশ হাজার টাকা প্রাইভেটে টিউটরের পিছনে যাওয়া কোন ব্যাপারই না। আর শিশুরা? তাদের ক্ষুদ্র অবসরে হাতে ট্যাব ধরিয়ে দিলই তারা খুশি। শিশুরা সচরাচর খুব অল্পেই খুশি হয়ে যায়। তাই তাদেরকে অভিভাবক, এই আধুনিক বাস্তববাদী নিষ্ঠুর সমাজ , বিশ্ব এত সহজেই ভুলিয়ে ফেলে। তারা জানতেই পারে না দুরন্ত শৈশব কি জিনিস, তা হারানো জন্য দুঃখ করার প্রশ্ন তাই সেখানে অবান্তর। ছোটবেলায় মা যখন নীরব দুপুর আর বিকেলের সন্ধিক্ষণটায় ঘুম পাড়াতে চাইতেন জোর করে -আমার জানালা গলিয়ে পালিয়ে খেলতে যাবার সময়গুলোর কথা, কষা কাঁচা কাঁচা পেয়ারা বরই ছিঁড়ে খেয়ে শেষ করে ফেলা আর কেউ শেষ করার আগেই, পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাওয়া, আবার সেটা লুকিয়ে ফেলা, টের পেলে আর আসতে দেবে না- কত বাঁদরামী, দুষ্টামীর ইতিহাস ।মনে পড়ে এখনকার বাচ্চাদের জন্য লম্বা জীবন কাটিয়ে ফেলা বুড়ো মানুষের মত একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। যদিও বয়সের হিসেবে এখনও আমকে তরুণী বলা যায় কোনমতে , তবু আজকাল যেখানে শিশুরাই বুড়িয়ে যাচ্ছে বা যেতে বাধ্য করা হচ্ছে সেখানে আমরা কোন ছাড়?
যে শিশুগুলির চমৎকার হাসি মুখ পত্রিকায় পাতায় এসেছে তা কি স্বতঃস্ফূর্ত নাকি তার আড়ালে শৈশব হারানোর বেদনাও মিশে আছে? সন্দেহ সন্দেহ লাগে।
প্রায়ই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে সমানে।এতই স্বাভাবিক আজকাল যে কোনটার প্রশ্ন আউট হয়নি জানলে অবাক আর অবিশ্বাস্য লাগে। কেউ আজকাল গোল্ডেন পেয়েছে জানলে সন্দেহ হয় সত্যি, অথেনটিক তো ? নাকি আগেই প্রশ্ন পেয়েছে বলে! একেবারে ছোট বাচ্চা মানুষ গুলো জীবনের শুরুতেই কি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে।জেএসসি, জেডিসি পিএসসির রেজাল্ট দিয়েছে। যারা এ প্লাস/ জিপিএ ফাইভ পায়নি , তাদের জীবনে গঞ্জনার শেষ নেই।অফিসের সামিয়া আপুর ভাইয়ের শুধু অংক মিস হয়েছে, মুখ কালো। বাকি সবগুলোয় যে সে সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়েছে তার কোন তারিফ নেই। আবার অ্যানি খালার ছেলেটি পেয়েছে সবগুলোতেই। তবু কেউ নিশ্চিত নই , সন্তুষ্ট নই।কি হবে ভবিষ্যতে? কারণ কত পাচ্ছে। ভুরি ভুরি। একটা পরীক্ষা শেষ হতেই এমনকি সফল হলেও আমরা তা উদযাপনের চেয়ে আবার আরেকটা টার্গেটে নাক মুখ গুজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। অথচ কেন এত কষ্ট, ভাবনা? ভার্সিটিতে সবচেয়ে নিচের গ্রেড পাওয়াদের মধ্যে ছিল আমার দুটি বান্ধবী অরিন আর সূচি। আজ ওরা বিসিএস ক্যাডার। মিতালী আপু- উনার গ্রেডও বেশ খারাপ ছিলো , ৪ এর স্কেলে ৩ এরও নিচে। তিনি দেশের বাইরে পড়ে এসেছেন, ভালো চাকরিতে চমৎকার কাজ করছেন, পিএইচডি করার জন্য আবার যাবেন। এরকম আরো অনেক আছে আশেপাশে যারা খারাপ ফল করেও উপরে উঠতে পেরেছে। তবে কেন আমরা শিশু, কিশোরদের স্বপ্নমাখা দিনগুলো ছিনিয়ে নিচ্ছি? থাকুক না , ধুলাকাদা মেখে আরো কিছুদিন জীবনের রং গুলোকে চিনে নিক। না হয়, কটা পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপই হলো। জীবনের বড় পরীক্ষায় পাস ফেল নির্ণয় করে দেবার সাধ্য কি এই সব অতি নগণ্য মূল্যায়ন টেস্টের?
আমাদের দেশে শিশুদের পড়া, পাঠ্যবিষয়, পরীক্ষা পদ্ধতি ও ব্যব্যস্থাপনা থেকে শুরু করে বড়দেরটা- কোথাও আশার আলো নেই। এখন ভার্সিটি গুলোতে পর্যন্ত একে একে পুনরায় পরীক্ষা দেবার সিস্টেম তুলে দেয়া হচ্ছে। অতএব যারা একবার পা পিছলে পড়বে কোনকারণে তার আর ঘুরে দাঁড়াবার কোন জো নেই। যত যুক্তিই দেয়া হোক , ব্যাপারটা ভাবতেই নৈরাশ্য বোধ হয়। একারণেই আমাদের দেশে একবার যার ঘাড়ে কোন ব্যর্থতার দায় চাপে যে তাকে উপরে টেনে তোলার বদলে বাতিল বলে ঘোষণা করে আরও নিচে চাপা দিতেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে এর মধ্যে থেকে অদম্য কিছু ছেলেমেয়ে বিশ্ব দরবারে জায়গা করে নিচ্ছে। আমরা খুব বাহবা দিয়ে ভাবছি, সব ঠিক আছে তাহলে।না হলে -এরা তো আমাদেরই শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই উঠে এসেছে, কেমন করে পারলো যদি গলদ থাকতোই? আসল কথা হলো, মরিয়া এই ছেলেমেয়েগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জোরে না, নিজের মনের তাগিদে উঠে এসেছে। আমাদের সৃজনশীল সহ প্রচলিত সব শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম কাজই হল, শিক্ষার্থীদের নিজের অন্তর্নিহিত সৃষ্টিশীলতাকে মেরে ফেলা,স্বপ্ন দেখা ,নিজের মতো নিজে কিছু করে দেখাবার ইচ্ছাকে খতম করে দেয়া। মাননীয় শিক্ষাব্যবসায়ীরা ঐ সব গুটিকয় সফল মুখ দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে চান তো তুলতে পারেন। তবে এছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই হবে না। একটু উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠলেই আমাদের শ্রেষ্ঠ মেধাবী ফুলের মত মুখগুলো চলে যাবে দেশের বাইরে, বেশীরভাগই। তাদের মেধায় বিশ্ব আলোকিত হবে ,আমরা রইবো সেই অন্ধকারে।কারণ আলোর উৎসটা থাকবে দূরে ,চোখের আড়ালে।যে চাষীর ছেলেটি কোনমতে জমিজমা বেচে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়েছে , যে গৃহপরিচারিকা মায়ের মেয়েটি ধারকর্জ করে কোনমতে হয়তো এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছে , তারপর আর পারেনি , বিয়ে হয়ে গেছে, যে মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান শ'খানেক জুতার তলা খইয়ে কোনমতে শুধু একটি কেরানির চাকরি বাগাতে পেরেছে, তারাই আসলে দেশের ভবিষ্যত।এদের যদি য্থার্থ মানুষ সম্পদ করে তোলা যায় তবেই দেশ আগাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:৫৫