১।
কে যেন ম্যাসেজের পরে ম্যাসেজ পাঠিয়ে যাচ্ছে। দুত্তোরি। রাতের সুনিদ্রা সুন্দর একটি স্বপ্ন ভেঙে গেল রশিদ মিয়ার। টুং টাং শব্দে ঘোরলাগা চোখ মুছে স্ক্রিনে দিকে তাকায় সে। এক রাশি প্রেমার্ত ক্ষুদে বার্তা। ভালোবাসার ভাবালুতা পরতে পরতে মেশামেশি কিছু রঙিন জরির ওড়াওড়ি ওগুলোতে। কিন্তু দেখে ওর অনুরক্তি নয়,কেবল বিরক্তিই জাগে।কার মনে এত রঙ ,এমন আরামের ঘুমটা মাটি করে দিল? ঘটনা কি? মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আবছা আবছা স্মৃতি মনে পড়ে ওর। ওহ হো! আজ যেন কি তারিখ? ৮ ডিসেম্বর। প্রতিবছরই এই দিনে ওর ফোনে এরকম ম্যাসেজ পাঠায় কোন এক পাগলে।ভুলেই গিয়েছিল সে আবার মনে পড়লো। মোবাইলটা ধুপ করে রেখে কপালে বিরক্তির ঢেউ মুছে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লো সুখী নিরুদ্বিগ্ন মানুষ রশিদ মিয়া।নাহ, নম্বরটাকে ব্লক করে দেয়া দরকার- ভাবনাটা পুরোপুরি জমাট বাঁধার আগেই সুপ্তির আশ্রয় নেয় তার চোখের পাতাদ্বয়।
আর কোন উৎপাত করে নি ,তাই নম্বরটাকে নিষিদ্ধ করে দেবার কথা সে পরদিন সকালের ব্যস্ততায় বরাবরের মতই ভুলে যায়।
---
সুহৃদ উদাস চোখে হাতের মুঠোফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রতিবছর অনন্যাকে সেই বিশেষ দিনটিতে সে এতে চিঠি লেখে । সাদা রঙের পর্দায় কালো কালো অক্ষরের নাচন কি বোঝাতে পারে কেমন রক্ত লাল হয়ে ক্ষরিত হয় তার অনুভূতিগুলো?অনন্যা আগেও বোঝে নি , বুঝবেও না সম্ভবত। তবু হয়ত বুঝতে পারে ভেবে সে গত দশ বছর ধরে এভাবে পাঠিয়ে চলেছে। কঠিন পাথরেই কখনো কখনো ফুল ফোটে তো !
২।
প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিল আশিষ। ওর পিছু পিছু ওরা আসছে।হাতে উদ্যত ছোরা, রিভলবার। ধরতে পারলেই ওকে হত্যা করবে, নিশ্চিত জানে। প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে তাই। এত ভয় সে জীবনে কখনো পায়নি । ছুটছে ছুটছে ছুটছে। এই ধরে ফেলবে, ফেললো - আবার মুহূর্তেই ওদের মাঝখানের দূরত্ব বেড়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে একপর্যায়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়লো সে। ওকে লুকাতে দেখতে পায়নি ওরা।খুঁজছে এদিক ওদিক তাকিয়ে। কোথায় গেল , এই মাত্রই তো ছিল। একটা জলজ্যান্ত মানুষ তো হাপিশ হয়ে যেতে পারে না। নিঃশ্বাস চেপে চুপ করে বসে থাকে আশিষ।ওর হৃদপিন্ডের ছন্দিত শব্দটাকেও মনে হয় বড় বেশী, কোনভাবে যদি এটাকেও লুকিয়ে ফেলা যেত, নিজেকে ঝোঁপের সাথে মিশিয়ে নিজেও একটা ঝোঁপ হয়ে যেতো পারতো!
---
মরিয়ম বানু খুব চিন্তা করছেন।এত দেরী হয়ে গেল, ছেলেটা এখনও আসছে না কেন? কোনদিন তো এমন হয়না। একটা কথা মনে পড়ে অকস্মাৎ তার শরীর অবশ হয়ে আসে। ওদের খপ্পরে পড়ে যায়নিতো? সর্বনাশ। উদ্বেগে অস্থির হয়ে ভাবেন, একটা ফোন করা যাক।যখন তখন ফোন করলে ছেলে খুব বিরক্ত হয়। পইপই করে বলে দিয়েছে , কোন সমস্যা হলে নিজেই জানাবে। জরুরী কাজে আছে, এখন কথা বলার সময় হবে না। তবুও , না হয় একটু রাগ করলোই।তার মন তো ঠান্ডা হবে।ডায়াল করলেন তিনি।
---
আশিষ শব্দটা শুনে প্রথমে টেরই পায়নি কোথা থেকে আসছে। সেকেন্ড পরে বুঝতে পেরে আতঙ্কে সে নীল হয়ে যায়। ওরা শুনে ফেলেছে, নিশ্চয়ই শুনে ফেলেছে। শব্দ অনুসরণ করে এখনই আসবে।তবু বৃথাই সে ব্যাগ হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে।আহ! দরকারের সময় মানুষ নার্ভাস হয়ে সহজ জিনিসটাও সহজে করতে পারেনা। যান্ত্রিক শব্দের সাথে সাথে দূরে চলে যাওয়া লোকগুলোর মানবিক পায়ের শব্দও ক্রমে মিশে যেতে থাকে।মচমচ করছে শুকনো পাতারা , ভারী জুতার আক্রোশে ওদের কাতর ধ্বনি ক্রমশ আরও নিকটতর হচ্ছে-
৩।
মেয়েটি বন্দিনী। সে রাপুনজেলের গল্প পড়েনি , তাই জানে না তাকেও কারো অপেক্ষায় থাকতে হবে। অথবা বাস্তবে তার টাওয়ারসম উঁচু বন্দিশালায় হয়ত রূপকথারা পৌঁছাতে পারে না। তাকে নিজে নিজেই পালানোর পথ বের করে নিতে হবে। ভিতরে ভিতরে ছটফটে কষ্ট নিয়ে মেয়েটি বাইরে স্থিরভাবে বসে থাকে,বাইরের সবুজ প্রান্তরের দিকে চেয়ে, পৃথিবীর সমস্ত তৃষ্ণা বুকে ধরে। দিনের পরে দিন সে ইতিউতি উঁকি ঝুঁকি দেয়া প্রজাপতিটার দিকে তাকিয়ে থাকে ঈর্ষাকাতর মনে। আরেকটা গিরগিটিও আসে। তার পরিবর্তনশীল রং দেখে সে ভাবে অমন ভোল পাল্টে পাথুরে দেয়ালের সাথে মিশে মিশে সে যদি যেতে পারতো! সতর্ক প্রহরীর চোখ এড়িয়ে।চুপি চুপি অলক্ষ্যে। প্রতিরাতে শোবার আগে তীব্র থেকে তীব্রতর হয় তার প্রার্থনা।' প্রভু, মুক্তি দাও।'
অবশেষে ঈশ্বর দয়া করলেন।
---
কোন এক সুন্দর সকালে ঘুম ভেঙে লম্বা সুতোর মত দেহটা নিয়ে হেঁচড়ে হেঁচড়ে বিশাল বিছানাটা থেকে নামে মেয়েটি। আজ আর তার প্রাত্যহিক কাজের তাড়া নেই। নিজেকে গুছিয়ে গুটিয়ে নিয়ে অনায়াসলব্ধ দক্ষতায় উঠে যায় ছাদে। একটা ছোট্ট কালচে পোকা দেখছে তার সূক্ষ হয়ে ওঠা চোখ । পেট পুরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে সে। গুটি গুটি ভাবে, সাতরঙা বিস্তৃত ডানার ভাঁজ খোলে। বার দুয়েক নেড়ে চেড়ে আড়মোড়া জড়তা ভাঙে। অনভ্যস্ততা কাটিয়ে ওঠে ।তারপরে খোলা জানালা দিয়ে নিচে ঝাঁপ দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৩২