লেখাটা আসতে যেমন টাইম নিচ্ছিল তাতেই ঝামেলার প্রথম ইংগিতটা পাচ্ছিলেন শামসেদ জামান। প্লটটা মাথার মধ্যে এসে ঘুর ঘুর করছে, খোঁচাচ্ছে অনেক দিন ধরেই , কিন্তু লিখতে গেলেই স্রেফ খাতা পত্র নিয়ে কলমের ডগা কাগজে ছুঁইয়ে বসে থাকা। কিছুতেই যুতসই আকারে বেরিয়ে আসছে না। এমন সমস্যার মাঝে লেখকদের যেতে হয়ই বা। কিন্তু যা তখন ছিল শুধু লিখে ফেলার অপেক্ষায় ,এখন তা আর অতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নেই। দারুন একটা অবশম্ভাবী হিট গল্প লেখার তৃপ্তি নয়, তঁর এখন সাথী হয়েছে মৃত্যুর হাতছানি।এ বিপদ থেকে কখনো কি তিনি উদ্ধার পাবেন? এমনকি বাঁচবেন কালকের দিনটাও পর্যন্ত??
'বল, শালা, তুই কেমনে এইসব জানলি?ভাবছস তুই ই বেশী চালাক আর বাকি বেবাকতে বেকুব তাই না? কদম আলীরে তাহলে তুই এখনও চিনবার পারিস নাই.......।'
অসহায় চোখে আড়মোড়া বাঁধা অবস্থায় কদম আলীর দিকে তাকিয়ে থাকেন হতবিহবল শামসেদ জামান। পুরোপুরি বানানো গল্পটা যে তাঁর জন্য এমন বিপদ দেকে আনবে সেকথা কে এমনকি কল্পনা করারও সামর্থ রাখে?
শালার লেখালেখির খেতা পুড়ি! তুমুল জনপ্রিয় লেখক শামসাদ সাহেবের নিজের রুটিরুজির যোগান দেওয়া কাজটার উপরই প্রচন্ড আক্রোশ জাগে।
একবার যদি এই বিপদ থেকে বের হওয়া তকদিরে থাকে আর কোনদিনও এ জীবনে তিনি কলম ছোঁবেন না-মনে মনে সুকঠিন প্রতিজ্ঞা করে ফেলেন । দরকার হলে বাপদাদার পৈতৃক পেশা চাষবাসে ফিরে যাবেন তাও ভালো ।অবশ্য যদি তা করার জন্য তিনি বেঁচে থাকেন!
'আবার কয় আমি কিছু জানি না???ভালো মত একটা ডলা খাইলে সব কথা বের হয়ে আসবে। বল তুই এইসব কিভাবে জানলি। আর কে আছে তোর সঙ্গে যে এইসব খবর তর কাছে লিক কইরা দিছে?'
শামসাদ সাহেব শরীরে অনর্থক কতগুলো জখমের চিহ্ন নিয়ে মেঝেতে পড়ে থেকে আকুল হয়ে ভাবতে থাকেন, এই বিপদ থেকে বাঁচার উপায় কি।কদম আলীর রক্ষিতা মেয়েটাকে সে খুন করে লুকিয়ে ফেলেছিল বাঁধের নিচের ঢালু জায়গাটাতে।একাজে তার সহযোগী ছিল তার খাস ডান -বাম দুই হাত- এক্কেবারে নিজের লোক আক্কাস আর জসিম।তারাই কদম আলীর এককালীন প্রিয়তমা মর্জিনার লাশটাকে আঠারো টুকরো করে মাটির তলায় শুইয়ে দিতে তাকে সাহায্য করেছিল। আঠারো- সংখ্যাটাও কদম আলীর নিষ্ঠুরতার আরেকটা চিহ্ন - ঠিক আঠারো বছর বয়সই হয়েছিল মর্জিনার। তা বয়স এত কম হলে কি হবে- গোস্তাকি তার ছিল বেশী- সে শরীফকে ভালোবেসে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।শরীফকে কদম এমনভাবে সরিয়েছে যে কাকপক্ষীও টের পায় নি। একাই করেছে কাজটা। মুশকিল হছে শামসাদের গল্পটাতে মর্জিনা ও আক্কাসের নামধাম সব মিলে যাওয়া। মায় আঠারো টুকরার ব্যাপারটাও কিভাবে কিভাবে হুবহু মিলে গেল? শামসাদ জামান তো ভেবে পান না। এতখানি মিলের পর তাঁকে একজন অচেনা কদম আলীর সামনে এভাবে বাঁধা পড়তে হবে তা আর অবাক কি -বিশেষত যখন এতখানি মিলে গেছে।সন্দেহটা করাই স্বাভাবিক- তিনি নিজে কদমের জায়গায় থাকলেও এই ই করতেন। তার মত এক সন্ত্রাসী ওঁর মত এক লেখকের লেখা সম্পর্কে কেমন করে জানতে পারলো সেটা অবশ্য প্রশ্নবিদ্ধ - যাকে দেখলে মনে হয় কুকর্ম করে পাওয়া টাকার সংখ্যা গোনার মধ্যেই তার অক্ষর জ্ঞান সীমাবদ্ধ। তবে বেশ জনপ্রিয় শামসাদ সাহেবের গল্প সম্পর্কে জানা সত্যিই অসম্ভব নয় , আজ সবকিছুই সবখানে ছড়িয়ে যায় -কোন কিছুই গোপন থাকার স্কোপ কম। একটু বেশীই কম, এমনকি এই কদম আলীর কাছেও -হাস্যকর রকমের বেকায়দা শুয়ে শুয়ে তিক্তমনে ভাবলেন শামসেদ জামান। তথ্য এত দ্রুত ছড়িয়ে যাবার আধুনিক যুগটাকে মনে মনে অভিসম্পাত করলেন তিনি।
কদম আলীর মনে ভাবনার ঝড় চলছে। এই লোকটা নির্ঘাত হয়ত খুনের বা মাটিচাপার ঘটনার সময় ওখানেই ছিল,হয়ত কেন , নিঃসন্দেহে- নাহলে ঘটনার এত নিঁখুত বর্ণনা সম্ভব না একেবারেই। নাকি জইস্যাটা বিট্রে করেছে?কেননা মর্জিনা আর আক্কাসের নাম লেখাটায় আছে কিন্তু জসিমেরটা নেই। নাহ, শরীফের নামও নেই। কিন্তু ঘটনার হুবহু মিল।কেমন করে?সে ষড় করে বলে দেয় নি তো কাউকে ? যেখান থেকে এই পাবলিক সব জানতে পেরেছে? কানে কানে গিয়ে এর কাছে উঠেছে ব্যাপারটা?যেভাবেই হোক চাল্লু মাল সন্দেহ নেই- কেমন গল্পের মাঝে ঢুকিয়ে সব সত্য বলে দিল!
কেমন করে এত মনধাম পর্যন্ত মিলে গেল শামসাদ জানেন না। মর্জিনা আর আক্কাস যথাক্রমে তাঁর বাড়ির কাজের মেয়ে আর দারোয়ানের নাম।বেশ একটা ওয়ার্কিং ক্লাস ভাব থাকবে ভেবে তিনি ও'দুটো নাম বেছে নিয়েছিলেন। কোন কুক্ষণ যে ছিল সেটা!রিয়েলিস্টিক করার চিন্তা থেকে একেবারে রিয়েলের সাথে মেলানো হয়ে যাবে কে জানতো।
দুঃসময়ে ঘোরতর নাস্তিকও বিপ্রতীপ আস্তিক হয়ে ওঠে। মাঝে সাঝে জুমার সময় হাজিরা দেয়া শামসাদ সাহেবও কায়মনোবাক্যে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে থাকেন।
কিছুতেই শত অত্যাচারেও নাটের গুরু -যে খবরটা লিক করেছে সেটা শামসাদ জামানের কাছ থেকে না বের করতে না পেরে ক্ষেপে যায় কদম আলী। একটু অবাকও হয়। এইসব পুতু পুতু সারাজীবন আরামবিলাসী মানুষজন এত সহ্য করেও চুপ থাকতে পারে কে জানত ? নাকি লোকটা আসলেও কিছু জানে না? ঘটনা স্রেফ মিলে গেছে? নাহ , এতখানি মিল কিভাবে হয়?
সংশয় মুহুর্তের জন্য উঁকি দিয়েই আবার চলে যায় কদমের মন থেকে। নিশ্চয় সব জানে সে । নিজে দেখেছে অথবা কারো কাছ থেকে জেনেছে। চোখের সামনে দুঁদে দারোগা খবিরুদ্দিনের চেহারা ভাসে তার। সবাইকেই হাত করা যায় না টাকা বা শক্তি দেখিয়ে, একেও পারেনি কদম। বহুদিনের পুরানো দুশমনি তার এর সাথে।আঁকশি দিয়ে অনেক পাকড়ানোর চেষ্টা আজতক বিফল করে দিতে পেরেছে কদম।তাকে ধরতে পারলে দারোগার প্রমোশন আর ওর চোদ্দশিক ,কে জানে হয়ত ফাঁসি। মর্জিনার গায়েব হবার খবরটা জানাজানি হয়েছে আগেই । সাথে বিখ্যাত লেখক ও লোকাল মানুষ শামসেদ জামানের লেখা- বোকা নয় দারোগা, দুইয়ে দুইয়ে চার করে নেবে।সব বের করে এবার লটকে দেবে কদমকে। কে জানে একেই হয়ত সাক্ষী খাড়া করে দেবে। ঘটনা পুরো জানে সে- একেবারে অক্ষরে অক্ষরে গল্পের সাথে মিলে গেছে। যাই হোক যদি দেখে থেকে তাহলেও আর যদি অন্য কেউ বলেও থাকে তাহলেও বটে শামসাদকে বেঁচে থাকতে দেয়া ঠিক না। পালের গোদাকে-অন্য কেউ হয়ে থাকলেও সেটা কদম আলী পরে ঠিক বের করে নেবে। কিন্তু সব অবস্থায়ই শামসাদ মরবে। পকেটে হাত দিয়ে খুদে রিভলবারটা বের করে আনে সে-নিঁখুত নিশানা তার , আর এত কাছ থেকে মিস হবার ত কোন প্রশ্নইও ওঠে না। চেয়ারে বসেই শামসাদের দিকে ওটা তাক করে সে।
........................লেখক আশফাক জামিল লিখে চলেছেন একমনে। শেষটা নিয়ে তার ভাবনা হচ্ছে তার গল্পরে মূল চরিত্র শামসাদকে মরতে হবে। পাঠকে বেশ একটা ধাক্কার মত খাবে। নিজের কাল্পনিক লেখার জেরে লেখক হত্যা- বেশ একটা ইউনিক প্লট । এ গল্প হিট না হয়ে যায় না। আর পাবলিক গল্পটল্প পড়ে ধাক্কা খতেই ভালো বাসে।আগেকার লুতু পুতু প্রেমভালোবাসার গল্পের যুগ আর নেই এখন।
'দেখি কি লিখছ?'
পারভেজ আহমাদের স্ত্রী প্রিয়াংকা পাশ থেকে উঁকি দেয় ওঁর খাতার উপর।
'শেষটা কি রাখলে? না না তুমি আগে যেমন বলেছিলে ওভাবে তোমার লেখাটার ক্যারেক্টার লেখক আশফাককে দিয়ে শামসেদকে তুমি মারতে পারবে না, আমি তোমাকে দেবই না। এই গল্পরে শেষটা তোমাকে বদলাতেই হবে বুঝেছো? '
'আচ্ছা জুলুমতো, লেখকের লেখার স্বাধীনতায় একি অত্যাচার! '-বলে মৃদু হাসেন পারভেজ। প্রিয়াংকা তার বউই শুধু না , একনিষ্ঠ অনুরাগী পাঠকও বটে। প্রতিটা নতুন পাতা লেখা হবার সাথে সাথে সে পড়ে ফেলে।
'তুমি একজন লেখক হয়ে আরেকজন লেখককে তোমার লেখায় মেরে ফেলবে? ভেবে দেখ তার জায়গাটায় তুমিও তো থাকতে পারতে।নিজেকে শামসাদের জায়গায় চিন্তা করতে পারো তুমি?
পাঠককে ধাক্কা দিতে চাইলে অন্য ভাবেও দেয়া যায়।'
'শোন নেগেটিভ এন্ডিং এর লেখাই লোকে বেশী খায়।'
'আরে না পজিটিভ হলেও ভালো লেখার দাম লোকে দেয় ঠিকই ।পজিটিভ হলেও তোমার এ গল্প মানুষের পছন্দ হবে।'
সাহিত্য সমালোচক হিসেবে প্রিয়াংকা মন্দ নয়, তার মতামতের গুরুত্ব দিয়ে তিনি আগেও ঠকেননি। এককাজে দুকাজ, ওয়াইফকে সন্তুষ্ট রাখা হাজবেন্ডের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণও বটে- কর্তব্য ও গৃহশান্তি দুইয়ের কারনেই।
'ঠিক হ্যায় ম্যাডাম।' হাল ছাড়েন পারভেজ সাহেব। লেখাটা শেষ করার জন্য আবার কলম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।
.............................।লেখার শেষমুহুর্তে মত বদলান আশফাক জামিল সাহেব। শেষটা একটু অন্য ভাবে করলে কেমন হয়? লিখে চলেন তিনি,
..............................সজ্ঞানে সুস্হ ধাতস্থ হবার পর শামসাদ নিজেকে আবিষ্কার করলেন নিজের বাড়ির ড্রইংরুমের সোফায়,পরনে গতকালকের বেশভূসা। ভয়াল একটা দুঃস্বপ্নকে শুধুমাত্র দুঃস্বপ্ন হিসেবে আবিষ্কার করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি ।কালকে গাঁজার এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন -এতে নাকি লেখা ডেভেলাপ করে,মাথার মাঝে হু হু করে প্লটেরা ভিড় করে আসে।সব বাজে কথা। আসে যদি কিছু হোক তা হচ্ছে ভয়ানক সব স্বপ্নেরা। প্রকাশকের একটা ক্রাইম,থিলার সাসপেন্স এই সবের মিশেলে একটা আনকোড়া গল্পের সন্ধানে মনে হয় মাথায় একটু বেশীই স্টেস দিয়ে ফেলেছেন তিনি । কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে মজিবরের বাসা থেকে এখানে কিভাবে এলেন তিনি?মারুফা ঘরে ঢুকতেই এই প্রশ্নেরও জবাব পেলেন । নির্ঘাত ওরই কাজ এটা। মনে মনে ওর রাগে বিস্ফোরিত হবার অপেক্ষায় শংকিত সময় গুনতে লাগলেন তিনি।
লেখাটা শেষ করে পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন পারভেজ জামিল সাহেব।পাঠক শেষ মুহুর্তে ভালোই ধাক্কা খাবে তাঁর লেখাটা পড়ে। একেবারে চমক যাকে বলে। প্রিয়াংকা বরাবরের মত এবারও ঠিক বলেছে , এভাবেই তাঁর গল্পটা বেশী খোলতাই হয়েছে। এমন বউ থাকাটা সত্যি বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। সে দারুন একজন লাইফ পার্টনার হবার সাথে সাথে স্বামীর কাজের সত্যকার অ্যাডভাইজারও বটে ।কতজনের এমনটা ভাগ্যে হয়?
ওকে লেখাটা না পড়ানো পর্যন্ত, মতামত না জানা পর্যন্ত মনে শান্তি পান না পারভেজ সাহেব,তাঁর সব লেখার সে-ই প্রথম পাঠক। এবারও তাই লেখা শেষ হবার সাথে সাথে ওকে ডাকতে উঠে গেলেন তিনি।না পড়ানো শেষ হবার আগে তাঁর স্বস্তি নেই।