ম্যাজিশিয়ান
প্রায় নির্জন পার্কের এক প্রান্তে বসেছিলাম। হৃদয়ে ফাল্গুণের ভালবাসা নয়, করোনার ভয়। হঠাৎ দেখি বেঞ্চের অন্যপ্রান্তে এক লোক, মাথায় গলফ ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস, মুখে সার্জিকাল মাস্ক, মাস্কের নীচে ছাগুলে দাঁড়ি। আমি আৎকে উঠলাম। লোকটা বলল, “ঘাবড়াবেন না স্যার। ওসব আমার হয়নি। বিদেশ থেকে ফিরে তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে। আমি আপনার থেকে ছ‘ফুট দূরে।“
“ঘাবড়াচ্ছিনা, আপনি হঠাৎ কি করে আসলেন ভাবছি।“
“ম্যাজিক না, আমি এই গাছের পিছনে ছিলাম। আপনি দেখেননি।“
“ও,“ নিরাসক্ত ভাবে বলে আমি একটা কাঠ বিড়ালীর নাচ দেখতে লাগলাম।
“তবে এটা ম্যাজিক না হলে ও আমি আসলে একজন ম্যাজিশিয়ান।“ বলল লোকটা।
“এখন ম্যাজিক দেখাবেন বুঝি? “ আমি বললাম ।
“না স্যার, ম্যাজিক দেখাব না। একটা করুণ সত্যি ঘটনা বলব। বিদেশ থেকে এসেছি শুনে ভয়ে কেউ কাছে আসেনা, অথচ বলার জন্যে আমার হৃদয় হাহাকার করে।“
পাগল না কি লোকটা? বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হল, “বলুন।“
“সারা জীবনে আমি সাতাত্তর জন মানুষকে ষ্টেজের উপর বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে দু’টুকরো করেছি আবার দিব্যি জোড়া দিয়েছি, প্রতিবারই তারা লাফিয়ে উঠে দর্শকদের সালাম দিয়েছে, কিন্তু একবার ভুল হয়ে গেল।“
“কি ভুল হল? “
“লোকটা লাফিয়ে উঠল না। পর্দা ফেলে আমি পালিয়ে বাঁচলাম।“
“লোকটার কি হল?“
“কি আর হবে? হুইল চেয়ারে ঘুরে বেড়ায়, পা জোড়া বাড়িতে পড়ে থাকে।“
“ইস্। এমন ঘটনা অন্য ম্যাজিকে ঘটেছে?“
“ঘটেছে। একটা লোককে শুন্যে ভাসিয়েছিলাম। মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্টিলের রিং চালিয়ে দেখিয়েছি কোন চালাকি নেই। ও মা! তারপর লোকটা আর নামে না, শুন্যে ভেসে থাকে। দু’দিকে দশ কিলো করে বাটখারা বেঁধে তাকে নামাতে পারি না!
“তারপর?“
“তারপর আরকি? আবার পর্দা ফেলা, আবার পালানো।“
“লোকটার কি হল?“
“শুনেছি ভাসন্ত বাবা নাম নিয়ে হুজরা তুলে চুটিয়ে ব্যবসা করছে।“
কৌতুহল হল আমার। না, লোকটার গুলগল্প আমি বিশ্বাস করিনি । তার মিথ্যা কথার বহর কোথায় যায় জানার আগ্রহ হল।
“আর কি ভয়ংকর ম্যজিক দেখিয়েছেন?“
“ভয়ংকর না, তবে ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ। এটা গতমাসের কথা। তখনো করোনা ছড়ায়নি। ব্রডওয়ের এক থিয়েটারে আম গাছে আমড়া ফলিয়ে ছিলাম। জানেনতো আম্রিকায় বাঙালীরা দেশে জন্মায় এমন সব্জী বা ফল নাই যা তারা আমদানী করেনা। সাহেবরা সেগুলি দিব্যি সে গুলি খায়, কিন্তু তারা যে বরিশালের আমড়া খায়নি তা আমি জানতাম না। সামনের সারির ক‘জনকে খেতে দিলাম।“
গল্প শুনে খুব রোমাঞ্চ হল আমার। অজান্তে গায়ে কাঁটা দিল।
“খুব টক ছিল বুঝি?“
“ঠিক বলতে পারিনা। দর্শক সারির একজন ছাড়া কেউ সে আমড়া খায় নি। শুধু একজন। সে স্মৃতি মনে পড়লে আমার গায়ে কাঁটা দেয় মশাই। সে ছিল আম্রিকার ঔষধ আর খাদ্য প্রশাসনের প্রধান। খচমচ করে পুরো আমড়া খেয়ে ফেলল। তারপর ষ্টেজে উঠে কি নাচন কুঁদন। শো বানচাল হয়ে গেল। দর্শকরা বাকী টাকা ফেরৎ চাইল, থিয়েটার মালিক অর্ধেক টাকা ফেরৎ দিল।“
“আপনার বেশ লোকসান হল তাহলে?“
“লোকসানের কি দেখছেন? বলেছিনা লোকটা ছিল ঔষধ এবং খাদ্য প্রশাসনের প্রধান? আমার নামে মামলা করল। আমি নাকি তাদের অনুমতি ছাড়া নিষিদ্ধ গাছ-গাছড়া এবং ফল নিয়ে আম্রিকা গেছি। যত বলি, ‘এটা ম্যাজিক‘ কেউ বিশ্বাস করেনা। একগাদা টাকা দিয়ে রবিন রেডব্রেস্ট বলে এক ইহুদি উকিল নিলাম। কোর্টে উকিল বলল ,
- এটা ম্যাজিক, ইয়োর অনার। বাদীপক্ষ কোন প্রমাণ দাখিল করেনি। জজ বললেন,
- তাই তো! গাছ কই, ফল কই?‘ বাদী পক্ষের উকিল বলল,
- হুজুর, আমার মক্কেল গাছের নমুনা নেয়ার আগেই ধুরন্ধর বাঙালী ম্যাজিশিয়ান সেটা সরিয়ে ফেলেছে।‘ আমার উকিল বলল,
- ধর্মাবতার, নোট করুন, প্রতিপক্ষের উকিল ধুরন্ধর বলে বাঙালী জাতিকে অপমান করছেন। জজ বললেন,
- সংযত হয়ে কথা বলুন, মি: উডি উডপেকার। ভ্যানতাড়া বাদ দিয়ে বলুন গাছ আছে না নাই?‘
- নাই, স্যার।
- ফল কোথায়? নাকি সেটা ও নাই?
উকিল তাকান মক্কেলের দিকে, মক্কেল আমার দিকে, তারপর ঢোক গিলে বলে,
- স্যার ফলটা আমি খেয়ে ফেলেছি। জজ বলেন,
- তা হলে বড়া? বড়া নাই?
- নাই স্যার, ষ্টেজে উঠে নেচেছিলাম তখন কোথায় পড়ে গেছে। জজ বললেন,
- আহাম্মক কোথাকার! তা হলে কেইস ডিসমিস করতে হবে। তখন উডপেকার বলল,
- স্যার, স্যার, প্রমান আছে। আমার মক্কেলের দু‘টা দাঁত। মক্কেলের কাছ থেকে দাঁত দু‘টো নিয়ে সে জজকে দিল।
- ফল খেয়ে আমার মক্কেলের এই দু‘টি কাঁচা দাঁত পড়ে গেছে, ইয়োর অনার।
- ফল খেয়ে পড়েনি স্যার, এত নাচানাচি করলে নড়া দাঁততো পড়বেই। বলল আমার উকিল।
- নাচানাচি করে না, স্যার। এত যমটক ফল খেলে আপনার দাঁত ও পড়ে যেত।
- মাইন্ড ইয়োর ভাষা, মি: উডপেকার। আমার বত্রিশ হাজার ডলারের দাঁত নিয়ে কোন কথা হবেনা।
বাহাস বাদ দিয়ে পরের কথা বলি। জজের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর জজ বললেন,
- ফলটা সত্যি টক কিনা আমি খেয়ে দেখব। আমি বললাম,
- আমি আমড়া এখানে কোথায় পাব, হুজুর? ওটাতো ম্যাজিক ছিল। জজ বললেন,
- ম্যাজিক করেই আনুন। এখানেই আম গাছে আমড়া ফলাতে হবে।
ম্যাজিক করলাম। কি বলব, কাঠগড়ায় তরতর করে আম গাছ গজাল, আমড়া ধরল। উকিল, পেশকারের সমবেত, ‘খাবেন না স্যার, মরে যাবেন,‘ ধ্বনির মধ্যে জজ সাহেব আমড়া খেলেন। খেয়েতো আনন্দে আত্মহারা!
- এত মিষ্টি ফল হয়? কে খায় আপেল, নাশপাতি, পীচ? আহারে আহা! কেইস ডিসমিস।
গুল গল্প শুনে আমিও রোমাঞ্চিত। অজান্তে গলা দিয়ে বেরিয়ে এল, “সাবাস! তারপর?“
“কেইসতো ডিসমিস হল, কিন্তু আমি পড়লাম বিপদে। রোজ জজ সাহেবের কাছ থেকে পেয়াদা আসে আমড়ার খোঁজে। এদিকে আমিতো আম্রিকার খাদ্য এবং ঔষধ প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে অফুরন্ত আমড়া আম্রিকায় নেইনি। নিউ ইয়র্কের কোন বাঙালী দোকানে বরিশালের আমড়া পাওয়া যায়না। এদিকে আরেক বিপদ, আম্রিকার প্রেসিডেন্ট, তার বাড়ি নিউ ইয়র্ক। সে তার ছেলের শালার কাছে শুনেছে এই ফলের কথা। সেখান থেকে এত্তেলা এল। পালাতে চাইলাম, কিন্তু তার আগেই এফবিআই না কি যেন নাম, আমাকে ধরে ফেলল। গোয়েন্দারা আমাকে চ্যাংদোলা করে রাজধানীতে নিয়ে গেল। বড় এক বাড়ি, নাম নাকি শাদা বাড়ি, তাম্মধ্যে এক অফিস, ‘ডিমাকৃতি‘ অফিস, তাম্মধ্যে হুমদো এক সাহেব, নাম বলা বারণ, প্রেসিডেন্ট। সাহেব গুম গুম করে কি বলল এক বর্ণ বুঝতে পারলাম না। চিমসে এক সাহেব আম্রিকান বাংলায় অনুবাদ করল। আমি বাংলাদেশী ইংরেজদের মত করে বুঝলাম। প্রেসিডেন্ট বললেন,
- আম গাছে আমড়া বানিয়ে খাওয়াও। আমি বললাম ,
- আমার জিনিষ পত্তর আনিনি, ইয়োর এক্সসেলেন্সি। হুমদোটা আবার গুমগুম করল, চিমসেটা অনুবাদ করল,
- জিনিষ পত্তর ছাড়াই তুমি কোর্টে আমড়া বানিয়েছ। এখানেও পারবে। আমার জিগরী দোস্ত সুপ্রাচীন দেশের মহান লোক বলেছে তোমরা ইয়োগা করে সব বানাতে পার। আমি বললাম,
- স্যার আমি ওই সুপ্রাচীন দেশের লোক না, সুপ্রাচীন জাতি থেকে উদ্ভব হলেও অর্বাচীন দেশের মানুষ।‘ প্রেসিডেন্ট বলল,
- চালাকী করনা। আমরি সাথে চালাকী করে রাশিয়া, চীন কেউ পার পায়নি। আমি নিজেও না।
কি আর করি, ‘ডিমাকৃতি‘ অফিসে ম্যাজিক করলাম। ভয়ে ভয়ে আম গাছে কিছু মুড়ির মোয়া ফলিয়ে দিলাম।“ এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলাম, আর পারলাম না,
“মোয়া ফলালেন মানে? মোয়া কি একটা ফল?“
“না হলেই বা কি? প্রেসিডেন্টতো বুঝতে পারেনি! ফল খেয়ে মহা খুশী। চিমসে লোকটা বলল,
- স্যার, এটা আমড়া না। ফ্লাফি রাইস আর গুড় দিয়ে বানানো। প্রেসিডেন্ট বলল,
- চোপ রও! আমি বলছি এটা ফল। তুমি কি উপহার চাও, ইয়োগী?
- ইয়োগী না স্যার, আমি ম্যাজিশিয়ান।
- ঐ হল। তোমারে একাউন্টে আজ এক মিলিয়ন ডলার যাবে। এছাড়া আমার পক্ষ থেকে তিনটা স্যুট, আর এই এক বোতল সিরাপ। শুনেছি তোমার দেশেও করোনা ভাইরাস ঢুকেছে। রোজ এক ফোঁটা করে খেলে তোমার হবেনা। স্ট্র কালার, পানির মত, একটু টক, একটু নোনতা, ভাল মন্দ মিলিয়ে আরকি! আমার লোকেরা বলেছিল আমার করোনা হয়েছে। কিন্তু, হয়নি, তারা প্রমাণ পেয়েছে। সে এই সিরাপের গুণে। আমার জিগরী দোস্ত সুপ্রাচীন দেশের মহান ব্যক্তির দেয়া এই ঔষধ। আমার দেশের লোকেরা খায়না, শুনেছি সেই সুপ্রাচীণ দেশের আধুনিক লোকেরাও খায়না। আমি সাহস করে বললাম,
- স্যার, খাবে নাইতো। আপনার দেশেই আছে সেই সুপ্রাচীণ দেশের বড় ডাক্তার, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদরা, তাদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন, তারা বলবে মহৎ প্রাণী থেকে এই সিরাপ নেয়া হলে ও এতে কাজ হবেনা। সেদেশের লোকরা খায়না। সম্ভবত: আপনার জিগরী দোস্তও এটা খাননা।‘
গুমগুম করে আবার প্রেসিডেন্ট বললেন,
- কিন্তু, তুমি এটা খাবে। তোমাকে আমার দেশের সীমান্তে দেয়াল তুলতে হবে, চাইনীজ দেয়ালের মত। ব্যাটাদের কোন কিছু টিকেনা, কিন্তু দেয়ালটা, মাশাল্লা! তোমার এক্সট্রা এনার্জি দরকার।“
আমার রোমাঞ্চ চূড়ান্তে উঠেছিল। বললাম, “তারপর?“
দীর্ঘ প্রশ্বাস ছেড়ে লোকটা বলল, “তার আর পর নেই। আমাকে রেখেছিল এক সাত তারকা হোটেলে। সেখানে ‘করোনা কিউরে‘র বোতল ফেলে, ব্যাঙ্কে এক মিলিয়ন ডলার ফেলে, সাত পূরুষ আম্রিকান হবার লোভ ফেলে দেশে পালিয়ে এলাম। এখনো ঘুমের মধ্যে এফবিআই‘কে স্বপ্নে দেখি।“
“আরেকটা কথা ছিল, .“ আমি বলতে গিয়ে চমকে তাকাই, ওমা! লোকটা উধাও!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২০ সকাল ৯:৪৬