উত্তরপুরুষ
রেজাউদ্দিন চৌধুরী
পার্কের উত্তর-পূর্ব কোনায় বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা তাঁর বাম কান স্পর্শ করল।রমনা পার্কের চক্রবেড় পথ একবার পাক দিলে হয় প্রায় সোয়া দুই কিলোমিটার, দু’বার পাক দিলে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার, ভূঁইয়া সাহেব, মানে সরকারের প্রাক্তন সচিব সামসুদ্দিন আবু মোহাম্মদ আজাদ ভূঁইয়া দৈনিক বৈকালিক হাঁটার জন্যে এই দূরত্ব নির্ধারণ করে রেখেছেন। কে না জানে রিটায়ার করার পর শরীরে ভর করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কলেস্টেরল নামের জীবন যন্ত্রণা! এসব নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটুকু হাঁটতে হয়। বৃষ্টির ফোঁটা কানে লাগায় তিনি দোনামনা করছিলেন, বাসায় ফিরে যাবেন না হাঁটা কমপ্লিট করবেন? অভিজ্ঞতা বলে পুরো বৃষ্টি নামতে এখনো অন্তত: আধা ঘন্টা।হাঁটার গতি বাড়ান তিনি ।তারের জালের উপর সবুজ পাতায় ঘেরা পথে লুঙী পরা, শাদা ফতুয়া, শাদাকালো দাড়ির এক মাঝবয়সী হাটুরের সাথে দেখা।
চাচা, কয়টা বাজে?
রিটায়ার করার পর কে চাচা ডাকল, কে ভাইজান বলল তার হিসাব তিনি ছেড়ে দিয়েছে । প্রথম প্রথম চটে যেতেন, পরে ভেবে দেখলেন সাধারণ মানুষের সাথে তাকে চলতেই হবে। তবে মনে মনে চটলেন এবং ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘পাঁচটা’। নাছোড় বান্দা লোক, সঙ্গ ধরল,
ঘড়ির দিকে চাইয়া কন না, চাচা, এত তাড়া কী?
ঘড়ির দিকে তাকালেন স্যাম, চাকরী জীবনে সাহেবী কেতায় চলেছেন বলে বন্ধু-সহকর্মীরা সামসুদ্দিন আবু মোহাম্মদ-এর সংক্ষেপ ‘স্যাম’ নামে তাকে ডাকে, তারপর লোকটার দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন,
পাঁচটাই বাজে।
লোকটা চলে গেল। পার্কে হাঁটার বিড়ম্বনা!সেদিন এক লোক তার পিছু ছাড়ে না, এক সাথে হাঁটে আর সাতক্ষিরায় মাছের ভেড়ির গল্প শোনায়। তিনি তার সাধ্যের বাইরে জোরে হেঁটেও লোকটাকে ছাড়াতে পারেন না, কারণসেও গতি বাড়াচ্ছিল। একসময় সে ফট করে বলল, “ভাইজানের ডাইবিটিসের খুব জোর নাকি?” সেদিনও মনে মনে চটেছিলেন তিনি।মন্ত্রীরা সাধারণ লোকের মুখে ভাই ডাক শুনতে অভ্যস্ত, সরকারের সচিবরা নয়, এমনকি প্রাক্তনরাও না। রাগী গলায় সেদিন বলেছিলেন, “আমার ডায়াবেটিস নেই”। লোকটা জবাব দিয়েছিল, “না, মানে, খুব জোর হাঁটতেছেন তো, তাই ভাবলাম।” নি:সঙ্গ হাঁটেন শামসু, স্কুলের বন্ধু শ্যামসুন্দর এই নামে তাকে ডাকত। সাথে লোক থাকলে অযথা কথা বাড়ে। এমন সময় -
‘স্যাম সাহেব!’
চমকে ফিরে তাকান তিনি। কে ডাকে? তাকিয়ে দেখেন বন্ধু বন্ধু তস্য বন্ধু ফিরোজ। অবশ্য তস্য হলেও বন্ধুতার দাবী তার কম নয়। তবু এখন তাকে তিনি এড়াতে চান। কি যেন বলতে চায় যা তিনি শুনতে চান না, অস্বস্তি হয়। ফিরোজ একজন শিল্পপতি, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি, দেশ বিদেশে ব্যবসা আছে, টেকনোক্রেট মন্ত্রী ও হতে পারে যে কোন দিন।
ফিরোজ যে, পার্কে কেন? বললেন স্যাম। ফিরোজের মত ঘ্যাম বড়লোকের পার্কে আসা যেন অন্যায়।
কাজ করে টায়ার্ড হয়ে পড়েছিলাম। ব্লাড সুগার, কলেস্টেরল, প্রেসার সবই হাই, বোঝেনইতো। আপনাকে পার্কে ঢুকতে দেখে নেমে পড়লাম।আমারও হাঁটা দরকার। বলল ফিরোজ।
হাঁটা খুব ভাল।
মুখে বললেন স্যাম কিন্তু মনে মনে ভাবলেন শুধু হাঁটার জন্যে বা আমাকে দেখে পার্কে নেমে পড়েনি সে! কলেস্টেরল কমানোর জন্যে তার নিজের বাড়িতে জিম, স্পা, দৌঁড়ানোর ট্র্যাক আছে।
কাঁচপুরে বিদেশী বায়ারদের ফ্যাক্টরী দেখাতে নিয়ে গেছি, হঠাৎ ফাঁকা লাগল চারদিক। ভাবলাম এত সব করছি কেন আমি? আমার বাবাতো এসব না দেখেও সুখে ছিল।
আমি যাই বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে। আজ আবার? সেদিন মাহমুদের বাসায় এ প্রসঙ্গ তুলেছিল ফিরোজ। মাহমুদ ছিল, শাহাদ ছিল, কিন্তু তাদের নয়, স্যামকেই শোনাতে চেয়েছে সে। কিছুটা শুনে তার মনে হয়েছিল এ কাহিনী আসলে তার স্বগতোক্তি। এত লোকের মাঝে শুধু ভুমিকা টুকু বলতে পেরেছিল সে। আরেক দিন শাহাদের বাসায় আবার শুরু করেছিল, মাহমুদের স্ত্রী চলে আসায় বলতে পারেনি। যে গল্প সবার সামনে বলা যায়না, তা শুধু তাকে শোনানো কেন? সেখানেই তাঁর অস্বস্তি। কথায় কথা বাড়ে তাই চুপ করে থাকেন তিনি।
সেদিন আপনাকে বলেছিলাম আমার বাবার চাকরী চলে গিয়েছিল, প্রেক্ষাপট বলিনি।
না, তারপর শোনা হয়নি।
আচ্ছা, তার আগে আপনি বলুনতো, আপনি কেন সচিব পদ চুক্তি নিলেন না? কেন কেবিনেট সেক্রেটারী হলেন না? একটু উত্তেজিত শোনাল ফিরোজের গলা।
শর্ত থাকায় নিইনি। ঠান্ডা গলায় বল্লেন স্যাম।
আপনি শর্ত থাকায় কেবিনেট সেক্রেটারী হতে পারেননি, আর আমার কেরানী বাবা শর্ত থাকায় চাকরীতেই থাকতে পারেননি। বলল ফিরোজ।
না, এ প্রসঙ্গ পাল্টাতে হবে। স্যাম বললেন,
নতুন কোন কাজে হাত দিয়েছেন নাকি ফিরোজ সাহেব?
জয়েন্ট ভেঞ্চারে একটা আন্তর্জাতিক টেন্ডার বিড করেছি।পেট্রো-কেমিক্যাল প্রকল্প।এসব কাজের জটিলতা আপনিতো জানেন।একটু ঝামেলা আছে -
ঝামেলা? তার মানে তদবির।বর্তমান জ্বালানী সচিব মামুন তার আন্ডারে ছিল। তিনি জ্বালানী সচিব থাকা কালে যে কাজ ফিরোজ করেনি আজ হয়তো সেই কাজ করতে চায়।
কাজটা ভিয়েৎনামে। সাতশ’ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প।
ও, ভিয়েৎনামে।
বললেন তিনি। টেন্ডার না তাহলে। তবে কি ব্যাঙ্ক লোন? তার ভায়রা বড় এক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান। চাকরীতে থাকা কালে স্যাম কারো তদবির শুনতেন না। এখন তদবির করবেন এটা নিশ্চয় ফিরোজ ভাবেনা। অন্য কিছু বলতে চায় সে। মাহমুদের বন্ধু শাহাদের মাধ্যমে ফিরোজের সাথে স্যামের পরিচয়। পরিচয় ক্রমে ঘণিষ্ট হয়েছে, তবু যে কথা সে মাহমুদকে বলতে চায়না, শাহাদকে বলতে চায়না, তা আমাকে কেন? বৃষ্টি আসবে যে কোন সময়। তাড়া তাড়ি হাঁটা শেষ করে বাড়ি ফিরতে হবে। এখন ফিরোজকে ফেরান কি করে? তার উপকার কেউ করতে পারে না, তবু ফিরোজ একবার তার উপকার করেছিল। বাণিজ্য নীতিমালা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি বিদেশী বিনিয়োগের স্বার্থে। দেশে নতুন সরকার আসার পর বলল বিদেশী কোম্পানীর কাছে টাকা খেয়ে তিনি কর মকুবের প্রস্তাব করেছিলেন।দূর্নীতি দমন কমিশন মামলা করল। তখন স্বাক্ষী হিসাবে এই ফিরোজ –। সে কথা এখন থাক্। হতাশ হয়ে হাঁটতে থাকেন স্যাম, সাথে হাঁটে ফিরোজ। আড় চোখে তার মুখ দেখেন স্যাম, যেখানে উদ্ভাসিত টেন্ডার বিডিং নয়, কাঁচপুর ফ্যাক্টরী নয়, বিদেশী বায়ার নয়, অন্য এক আলো। স্যাম বলেন,
বৃষ্টি আসতে পারে কিন্তু।
অল্প কথা আমার, বাকিটুকু হাঁটতে হাঁটতে শেষ হয়ে যাব।
স্যাম আজাদ কথা বলেন না, ফিরোজকে বলতে দেন। বলুক।বেশী সময় পাবে না, বৃষ্টি এল বলে। কানে বৃষ্টি পড়ার পর ঠোঁটে আর কপালে আরো দু’ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে। আরো বিশ মিনিট হাঁটলে আজকের মত বৈকালিক ভ্রমণ শেষ হয়, গল্পও শেষ হবে তখন, অথবা বৃষ্টি শুরু হলে আগেই শেষ হবে।নিয়তির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিলেন স্যাম।
আপনাকে আগেই বলেছিলাম আমার বাবা ছিলেন সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের একজন কেরাণী । তখন সরকারী অফিসগুলিতে ষ্টেশনারী জিনিস সাপ্লাই দে’য়ার জন্য এই ডিপার্টমেন্ট করা হয়েছিল।বড় অফিসার থেকে ছোট কেরাণী প্রায় সবাই এখানে সমানে টাকা কামাই করত। দু’একজন সৎ অফিসার এবং কর্মচারী ছিল পরগাছার মত। বাবা ছিলেন তাদের একজন।
কোন সময় এটা? জানতে চাইলেন স্যাম। সন্ধ্যা হতে দেরী নেই ।
পাকিস্তান আমলে। বাবার জিম্মায় ছিল অফিসের নথিপত্র। বাবা হঠাৎ লক্ষ্য করল কিছুদিন ধরে ক্রয় আর সরবরাহের জের মিলছেনা।গুদাম সরকারের স্টক রেজিষ্টার আর নথির জেরে মিল নেই, তার বস এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের কোথাও স্বাক্ষর নেই, এমনকি মাসে শেষে ডেপুটী ডিরেক্টরের প্রতি স্বাক্ষর নেই। গুদাম সরকার বলল, এসব দেখা বাবার বিষয় নয়। বাবা এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে বললেন, তিনি ও বললেন এসব দেখা বাবার বিষয় নয়। একদিন বাবা সাহস করে ডেপুটী ডিরেক্টরকে বললেন। তিনি বিষয়টা নথিতে পেশ করতে বললেন। বাবা নথি পেশ করলেন, সে নথি আর নিচে নামেনা।
পাশ দিয়ে মুস্তাফিজ চলে গেল, প্রাক্তন খাদ্য সচিব। তাকে দেখে হাত তুলল সে, স্যাম ও হাত তুললেন। ফিরোজ পোজ নিয়ে আবার শুরু করল,
একদিন ডেপুটী ডিরেক্টর বাবাকে ডেকে বললেন, ‘ভূঁইয়া, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে কি লাভ? আপনি গুদাম সরকারের সাথে বিবাদ মিটিয়ে ফেলুন।যান, আপনি আর গুদাম সরকার মিলে রেকর্ড আর নথির সামান্য হেরফের ঠিক করে ফেলুন, আমি সই করে দিচ্ছি।হেড অফিস থেকে আপনার প্রমোশনের রিকমন্ডেশন চেয়ে আমাকে চিঠি দিয়েছে, এ সময় ঝামেলায় না যাওয়া ভাল।’ হেরফের সামান্য ছিল না, বাবার আগে থেকে এটা চলে আসছিল, সুতরাং বাবা নথি ফেরৎ আনলেন না। একদিন গুদাম সরকার পালিয়ে গেল, সাথে নিয়ে গেল জরুরী নথি এবং ষ্টক রেকর্ড।
রহস্য রোমাঞ্চের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।জমে উঠেছে গল্প, তবু স্যামের অস্বস্তি যাচ্ছে না। ফিরোজ বলতে লাগল,
ইনকোয়ারী হল, গুদাম সরকারের চাকরী গেল, বাবাকে বাধ্যতামূলক অবসর দে’য়া হল, কর্তব্য কর্মে অবহেলার জন্য এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে এক ধাপ নীচে নামিয়ে দে’য়া হল এবং ডেপুটী ডিরেক্টরকে সতর্ক করা হল।
কোন ইয়ারের ঘটনা এটা? আবার জানতে চান স্যাম।
পয়ষট্টি সাল। বাবা গ্রাচুইটির টাকা দিয়ে একটা বইয়ের দোকান দিলেন।পেনশনের সামান্য টাকা আর দোকানের ইনকাম দিয়ে চলতে লাগল। বাবা শুধু সৎ আয়ের কথা বলতেন। বই বেঁচে দু’টো টাকা বেশী ঘরে আসলে ভাবতেন অনেক হয়েছে।অল্প নিয়ে সুখী ছিলেন আমার বাবা।
আপনার বাবার মত লোক এখন হয় না। কাহিনী শেষ হয়েছে ভেবে হাঁফ ছাড়লেন স্যাম, কিন্তু ভবি ভুলল না।
আপনার মত দু’একজন একজন ছাড়া। ফিরোজ বলল। স্যাম লজ্জা পেলেন,
কিযে বলেন! বললেন তিনি।ফিরোজ আবার শুরু করল,
’৭২ সালে আমি পাসকোর্সে বিএ পাস করলাম। বাবা আমার নামে দোকান ট্রান্সফার করে পুরোপুরি অবসর নিলেন। বড় ভাই ওয়েজ আর্নার বন্ড জোগাড় করে বিলাত চলে গেল, বোনের বিয়ে হয়ে গেল, বাড়িতে বাবা, মা আর আমি।
এসব আমাকে কেন বলছে ফিরোজ?এটা তার আত্মজীবনি? তাকে চমকে দিয়ে ফিরোজ বলল,
আপনার কাছে আত্মকাহিনী মনে হতে পারে, আসলে এটা প্রেক্ষাপট বোঝানোর জন্যে। মাহমুদের বাসায় সেদিন আপনি বলেছিলেন সততা, অসততা বংশ পরম্পরা সূত্রে গাঁথা, অমি বলেছিলাম, না। আমার মর্যাল বোঝানোর জন্যে এটা দরকার।
বলেছিলাম নাকি? তা’হলে ভুল বলেছিলাম। তাড়া তাড়ি বললেন স্যাম। তা’তে যদি সে থামে, গল্প থামে না।
চার্লস ডিকেন্স কোন একটা উপন্যাসে বলেছেন না, ‘সেই সময়টা ছিল সর্বোত্তম, সেই সময়টা ছিল সর্ব নিকৃষ্ট’, ৭২ সাল ছিল তেমনি একটা সময়। ভাল লোক ছিল, কিন্তু আমার কপালে জুটল কিছু অসৎ বন্ধু। রাজনৈতিক কানেকশন হল, পয়সা দিয়ে জুটল মাস্তান। একটা দোকান ছিল, তিনটা হল।
বৃষ্টির ফোঁটা বেড়েছে। পার্কের ভ্রমনবিলাসীরা হাঁটার গতি বাড়িয়েছে। অস্বস্তি হচ্ছে, তবু না বলে পারলেন না,
একটা দোকান তিনটা হল কি করে?
সদ্য জোটা বন্ধুরা সাহায্য করল, দু’টা অবাঙালীর দোকান পেয়ে গেলাম পানির দামে। বাবা এসব জানতেন না, জানতেন আমার হালাল রুজী বেড়েছে। ’৭৩ সালে খুব শান্তিতে আমার কেনা শান্তিনগরে টিনের চালাঘরে বাবা চোখ বুজলেন । মাথার উপর সততার চাপ কমায় আমার আয় বাড়ল। বন্ধুদের সাহায্যে সাপ্লাই, ঠিকাদারী, ঔষধের ট্রেডিং চালিয়ে যেতে লাগলাম।
বালজাক্ তা’হলে ঠিকই বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক বড় সৌভাগ্যের পিছনে বড় অপরাধ লুকিয়ে আছে’, ভাবলেন স্যাম, কিন্তু তিনি আর শুনতে চাননা, কিন্তু বাধা দেন কি করে?
’৭৪ এর শেষে মা মারা গেলেন। মারা যা্ওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘তুই যে ভাবে টাকার পিছনে ছুটছিস আমার ভয় হয়। তোর বাবার আদর্শ ভুলিস না।’ ইতিমধ্যে আমার বউ হয়েছে ছেলে হয়েছে। আমিও সৎপথে ফিরতে চাই।
তা’কি হয়? ভাবলেন স্যাম। একবার পথ পিছলে পড়লে আর উঠে দাঁড়ানো সম্ভব হয়না।ফিরোজ বলে চলল,
এক সময় টাকা পয়সার দাবী দাওয়া নিয়ে অসৎ বন্ধুদের সাথে আমার বিরোধ হল। সাপ্লাই, ঠিকাদারীর ব্যবসায়ে তখন যতখানি সৎ হওয়া যায় তার চেষ্টা করছিলাম আমি। সঠিক সাপ্লাই-দিয়ে আমার সুনাম বাড়ছিল, অসৎ বখরাদারদের তা সহ্য হচ্ছিল না।
কিছু বললেন না স্যাম।দেখা যাক্। তারা পৌঁছে গেছেন লেকের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায়। বৃষ্টির ফোঁটা বাড়ছে। অন্ধকার নামছে।‘অস্তাচল’ গেটের কাছে এসে তারা দেখলেন বহু লোক বেরিয়ে যাচ্ছে।
তিনজন ছিঁচকে বখরাদারের সাথে আমার কোন পার্টনারশিপ ছিলনা, তারা শুধু আমার হয়ে কাজ করত। একদিন তাদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে আমি বললাম আমার হয়ে আর তাদের কাজ করতে হবে না। খুব চটে গেল তারা। সন্ধ্যায় ফিরে এসে আমাকে না পেয়ে অফিস তছনছ করল, ষ্টিলের আলমারী করে গুলি করে ফুটো করল, এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করল।সেই রাতে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেল।
‘বৈশাখী’ গেটের কাছে আসতে আসতে বৃষ্টি নেমে গেল। একটু দূরে পার্কের পাকা ছাউনি। সেখানে এখন আশ্রয় নিয়েছে বিকালে বেড়াতে আসা পাবলিক, দৌড়ে গেলে তারাও আশ্রয় পাবেন, কিন্তু -
চলেন, ঐ শেডের নিচে দাঁড়াই। বলল হাজার কোটিপতি ফিরোজ।
শেডের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সামসুদ্দিন আবু মোহাম্মদ আজাদ ভূঁইয়ার এককালিন অফিস সহকারী মফিজ আলি, প্রবীর ঘোষ, কিছু ভ্রমণবিলাসী এবং ভবঘুরে ।
ভিজে যখন গেছি তখন আর শেডের নিচে যাবনা, গাড়ির কাছেই যাই।বললেন তিনি।
গাড়ি বহু দূর। মাথায় বৃষ্টি পড়লে ঠান্ডা লাগতে পারে, এখন কার্তিক মাস। ফিরোজ বিজ্ঞের মত বলল।
বাংলা মাসের হিসাব দেখি আপনি রাখেন।আপনি যান না? আপনার কাহিনী খুব ইন্টারেস্টি, আরেকদিন শুনব। আজ চলি।বললেন স্যাম আজাদ।
আপনাকে রেখে কি যাওয়া যায়? আমার কথাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
নাছোড়বান্দা! ছাড়বে না। গেট মানে ‘অরুণোদয়’ এখান থেকে এক কিলোমিটার, ঘাস পানি মাড়িয়ে গেলে আটশো মিটার। বৃষ্টিতে ভিজে দু’জন নীরবে হাঁটেন। কাকরাইল মসজিদ থেকে পার্কে এসেছে কিছু বাচ্চা তালেব-ইলিম, তাদের কিস্তি টুপির চূড়া থেকে সালওয়ারের গোড়া পর্যন্ত ভিজে চুপসে গেছে, কিন্তু স্ফুর্তির ঘাটতি হয়নি বরং বৃষ্টির বেগের সাথে বেড়েছে।গাছের ডাল ধরে ঝাঁকাচ্ছে, টুপ টাপ ফুল পড়ছে। মাদ্রাসা হোক কিংবা ইংলিশ মিডিয়াম, বাচ্চাদের স্ফুর্তি কিছুতে আটকানো যায়না। স্যাম আজাদ শৈশবের ‘আবু’ হলে ভিজতেন, গরুর মত নয় হরিণের মত, সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলের মাঠে বা পল্টন ময়দানে। বৃষ্টিতে ফিরোজের আত্মকথন বেগ পেল।
এরপর আর অসততার আশ্রয় নিতে হয়নি আমাকে, ট্রেডিং থেকে ইন্ডাস্ট্রি, এক থেকে একাধিক শিল্প।
ফিরোজের আছে ছোট বড় মিলিয়ে আছে ৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। হ্যাঁ নিজের পরিশ্রমেই সম্পদ গড়েছে সে, ভাবলেন স্যাম, কিন্তু গোড়ার ঐযে অপরাধ? স্যামের চোখে মুখে পড়ছে বৃষ্টির ধারা, ভিজে ভারী হয়ে গেছে ট্র্যাক স্যুট, চশমার ভিতর দিয়ে ঝাঁপসা দেখাচ্ছে পার্ক, ঝাঁপসা ফিরোজের মুখ।
বাবা তার বস, সেই অসৎ ডেপুটী সেক্রেটারীর নাম আমাকে কখনো বলেননি, তবু তাকে আমি খুঁজেছি। শুনেছি ডেপুটী সেক্রেটারী হিসাবে রিটায়ার করলে ও তিনি কোটিপতি হয়েছিলেন। আমার বাবাকে শেষ সময়ে দেখলে তিনি বুঝতেন, চাকরীতে পদোন্নতি বা অনেক টাকা, কোনটাই তার সুখের অন্তরায় হয়নি।
বার বার নিজের সৎ ব্যবসায়ের কথা বলে কান ঝালাপালা করে দিল ফিরোজ। এসব সে বলছে কেন স্যামকে? তিনি দূর্নীতি দমন বা ট্রুথ কমিশনের চেয়ারম্যান নয়। স্যাম ধাঁ করে জিজ্ঞেস করলেন,
এখন ব্যবসা করতে গিয়ে কি সততা বজায় রাখতে পারছেন?
ঐ, এ দেশে ব্যবসা করতে গেলে যা না করলেই নয়, একটু আধটু ঘুষ, যাকে বলে স্পীড মানি, অন্যের প্রাপ্য নে’য়ার জন্যে নয়, নিজের প্রাপ্য আদায় করতে, বোঝেনতো দেশের অবস্থা। তবে মিথ্যা বলে কাউকে ঠকাইনা।
হতে পারে। সঠিক ট্যাক্স দে’য়ার ব্যাপারে তার সুনাম আছে। কোন এক সরকার যখন ট্যাক্স ফাঁকি এবং দূর্নীতির জন্য বহু ব্যবসায়ীকে ধরল, সেবার সবচেয়ে বড় অংকের ব্যক্তিগত ট্যাক্স দে’য়ার জন্যে সে পুরস্কার পেয়েছিল। তবু সততা নিয়ে এত কথা ভাল লাগে না। স্যাম বললেন,
ঠকাননা, তবু মিথ্যা বলেন?
বায়ারদের সাথে প্রয়োজনে মিথ্যা বলতে হয়।নিছক সেল প্রমোশন, ঠকানোর জন্যে না।
স্যাম হাঁটেন, ভিজেন আর ভাবেন শেষ কার্তিকের বৃষ্টি মাথায় করে আমার কাছে সাফাই গাওয়ার জন্যে ফিরোজ এখানে আসলো কেন? সত্যি কি শুধু মনের ভার লাঘব করার জন্যে? হয়ত অপরাধ বোধ তাকে তাড়া করে, যা বলছে তার চেয়ে অনেকবেশী অপরাধ করেছে সে, এখন হালকা হতে চায়। এতদিন নি:স্বার্থ ভাবে স্যামের গুণগানই করেছে ফিরোজ, নিজের কথা কখনো বলেনি। আজ যদি নিজের কথা বলে অপরাধবোধ কমাতে চায়, কমাক না।ফিরোজ সরকারের কিছু না, কিন্তু তবুও ব্যবসায়ী সমিতির সভায় স্যামকে বাণিজ্য সচিবের পদ থেকে সরিয়ে দে’য়ায় সে প্রকাশ্যে দু:খ প্রকাশ করেছিল। প্রবীণতম সচিব হিসাবে তাকে পরবর্তী কেবিনেট সেক্রেটারী করা উচিৎ বলে মত প্রকাশ করেছিল।কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করেছে ফিরোজ। একটু সময় নিচ্ছে। দু’জন নি:শব্দে ভিজেন আর হাঁটেন। বৃষ্টির গতি বাড়ে, বিদ্যুৎ ঝলকায়, সশব্দে বজ্রপাত হয়।স্যাম আজাদের পাকা চুল থেকে অঝোরে বৃষ্টি ঝরে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা। শেডের নিচে দাঁড়ালো না কেন স্যাম? আমজনতার সাথে এককাতারে দাঁড়াতে লজ্জা করে, তাই? না কি রিটায়ার্ড কেরাণীদের সাথে রিটায়ার্ড সচিবের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ানো শোভা পায় না সে জন্যে? ফিরোজ কি ভাবছে কে জানে? আমারও কি সাফাই গাওয়ার প্রয়োজন আছে? জুতা মোজা ভিজে গেছে স্যামের, ভারী পা তুলতে কষ্ট হচ্ছে, তবু চলার বেগ তিনি বাড়ান ।
আপনার অস্বস্তি আমি বুঝতে পারি।শেডের নিচে প্রাক্তন কর্মচারীদের ভীড়ে আপনাকে পড়তে হত। বেশীদিনতো হয়নি।
কিসের বেশীদিন হয়নি?
কিছুটা রুক্ষ শোনাল স্যামের গলা।প্রতিরোধে শক্ত হল তার বর্ম। হয়তো কোন মানে করতে চায়নি ফিরোজ, রিটায়ারমেন্টের বেশীদিন হয়নি এটাই বোঝাতে চেয়েছে সে।নিজেকে বোকা বোকা লাগল তাঁর, রাগ ও হলো। অবসরে যাওয়ার তিনমাস আগে দূর্নীতি দমন কমিশন তার নামে মামলা করেছিল। অবসরের পর ও মামলা চলেছিল। না কি তিনি কোন কোরিয়-বাংলাদেশী পোষাক ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানীর কাছ থেকে গুলশানে বাড়ি উপহার নিয়েছেন। অফিসাররা সবাই, এমন কি তার মন্ত্রী পর্যন্ত অবাক হয়ে ছিলেন। পত্রিকা জুড়ে উড়োখবর। মামলা নিষ্পত্তি হল যখন জানা গেল গুলশানের বাড়িটা তার বাবার কেনা। ফিরোজের মুখের দিকে তাকালেন স্যাম। বৃষ্টিতে তার মুখের ভাব বোঝা ভার।
আমি আপনার রিটায়ারমেন্টের কথা বলছিলাম। এখানে আপনার অনেক অধস্তন কর্মচারী্ ইভনিং ওয়াক করে, তারা হয়ত কৌতুহলী হবে, ভীড় জমাবে আপনার কুশল জানতে।
না, না, পরিচিত লোকের ভীড়ে আমার অস্বস্তি হয় না।
কথাটা সঠিক বললেন না তিনি, তাই গলা একটু আড়ষ্ট শোনাল। অনেকে তাকে হাম বড়া ভাবে? সত্যি কি তিনি তাই? আব্বা চাইতেন তিনি যেন শুধু বড় মানুষদের সাথে চলাফেরা করেন, সাহেবী কেতায় চলেন অর্থাৎ, খাওয়া, সময়ানুবর্তীতা, কথা বলা সবকিছু। ফল হল, মেলা মেশায় তিনি ছোট বড় কারো সাথেই স্বাভাবিক হতে পারলেন না, কিন্তু সাহেবী কেতা রয়ে গেল। সামাজিক অনুষ্ঠানে অফিসের এককালিন অধস্তনদের সাথে দেখা হলে তিনি এত ভদ্র, মার্জিত এবং মিহি গলায় কথা বলেন এবং ভদ্র আচরণ করেন যে তাকে দেখলে তারা এড়িয়ে যায়।
সেটা আমি জানি। একজন স্টেনোগ্রাফারের সাথেও আপনি সম্মানের সাথে কথা বলেন।
তার অনেক অনেক জুনিয়ার অফিসারকেও তিনি আপনি বলে সম্বোধন করেন। ‘অরুণোদয়’ আর কতদূর? ভিজতে ভিজতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন স্যাম। কাকরাইল মসজিদের পিছন অতিক্রম করলেন, আর হয়ত সাত মিনিট। দেয়ালের ও পাশে তার গাড়ি, কিন্তু হায়! তাকে হেঁটে গেট পর্যন্ত যেতে হবে। হঠাৎ ছাতা হাতে একজন ছুটতে ছুটতে এসে ফিরোজের হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল।ছাতা হাতে নিয়ে স্যামের দিকে এগিয়ে দিল ফিরোজ।
পুরো ভিজে গেছি, আমার আর লাগবে না। বললেন স্যাম।
তবু মাথাটা যতখানি বাঁচানো যায়।
‘অরুণোদয়’ গেটটা ঐ দেখা যাচ্ছে। আরো পাঁচ মিনিট হাঁটার পর গেটে পৌঁছালেন তারা। রাস্তায় প্রচন্ড ভিড় কিন্তু গেটে ভিড় নেই, তিনটা গাড়ি তার মধ্যে সাদা লেক্সাস ফোর হুইলার ফিরোজের, স্যামের গাড়ি ধারে কাছে নেই। ছাতা নিয়ে যে লোকটা শেডের নিচে অপেক্ষা করছিল, ফিরোজের হাতে ছাতা দিয়ে সে দৌড়ে গাড়ির কাছে গেল। এখন গেটের নিচে কতিপয় ফেরিওয়ালা, ভ্রমণবিলাসী এবং নিশ্চিত ভাবে তার প্রাক্তন কিছু কর্মচারী, যাদের মুখ তিনি চেনেন, নাম জানেন না। দু’জন সালাম দিল, একজন চিনে না চেনার ভান করল। মোবাইলে ড্রাইভারকে ডাক দেবেন ভাবছেন এমন সময় সে ভেজা কাকের মত এসে হাজির।
গাড়ি স্টার্ট লইবার লইছে না। ড্রাইভার বলল।
কেন?
কইবার পারি না। ব্যাটারী ঠিক আছে, সেল্ফ ভি ঠিক, অন্যকিছু হইবার পারে। মেকানিকরে খবর দিছি।
কিছু বলার নেই। এ তার নিজের ড্রাইভার নয়, এক শিল্পপতি আত্মীয়ের একটা প্রকল্প কনসেপ্ট পেপার তৈরী করছেন তিনি, সাময়িক ব্যবহারের জন্যে তার দে’য়া গাড়ি।
আপনি আমার গাড়িতে উঠবেন? আমি নামিয়ে দিচ্ছি।
কিছু করার নেই, ফিরোজের গাড়িতেই উঠলেন তিনি। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলেন না। তারপর ফিরোজ মুখ খুল্ল।
পুরানা পল্টনের বাড়ি ডেভলাপারকে দিলেন না কেন?
আমার আরও দুইবোন এ বাড়ির মালিক, তারা আমেরিকায় থাকে।
আবার দু’জন নি:শব্দ। ফিরোজের আত্মস্বীকৃতি শেষ হয়েছে। কাকরাইলের প্রচন্ড যানজট পেরোতে সময় লাগে। ধীরে গাড়ি এগোচ্ছে। এবার কি আমার পালা? পুরানা পল্টনের রাস্তায় ঢোকার পর ফিরোজ বলল,
অফিসে মন উদাস হয়ে গেল বাবার কথা ভেবে। সাথে সাথে আপনার কথা মনে হল। আমার বাবা কিছু ছিলনা, তাই সন্যাসী, আপনি সব থেকেও সন্যাসী।
এবার বিরক্তি লাগল স্যামের। এ কি তোষামোদী! খালি সন্যাসী, সন্যাসী! একটু রূঢ় গলায় বললেন,,
সন্যাসীর কি দেখলেন?
গুলশানের মত জায়গায় বাড়ি ‘প্রতিবন্ধী দু:স্থ শিশু কল্যান সংস্থা’কে দান করে’ দিলেন!
ফিরোজের কথায় আবেগ নেই, ঝানু ব্যবসায়ী যেন কোন চুক্তির কথা বলছে। এত কথা সে জানল কি করে? গাড়ি পুরানা পল্টনের পুরনো বাড়ির সামনে থামল। গাড়ি থেকে নামলেন স্যাম।
আব্বা বাড়িটা আমার নামে লিখে দিয়েছিল। আমার দু’টো বাড়ি কি দরকার বলুন? ছেলে, মেয়ে আমেরিকায়। কেউ ফিরবে না। আর বাড়িটা–
একটু থামেন স্যাম, তারপর কথা শেষ করেন,
আব্বা সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে থাকার সময় পাওয়া টাকায় করা।
স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন স্যাম, স্বীকারোক্তি শেষ হয়েছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাড়ির বাইরে অন্ধকার, ভিতরে আলো জ্বলছে। ফিরোজের মুখে মৃদু হাসি। চট করে ধন্যবাদ দিয়েই বাড়িতে ঢুকে গেলেন সামসুদ্দিন আবু মোহাম্মদ আজাদ ভূঁইয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:২১