বংশবীজ: শামীম আজাদ
অভিবাসী মানুষ যেন শিমুল গাছ। ফল বিস্ফোরিত হলে শিমুল বীজ যেমন বাতাসে ভেসে এসে ভিত গাড়ে নতুন ভুমিতে, তেমনি। তবে একটা পার্থক্য আছে। শিমুল অভিবাসী হয় নিজেকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে, মানুষ অভিবাসী হয় জীবিকা, উচ্চতর আয়, উন্নততর জীবন এবং সবার উপরে রক্তেমেশা অভিযানের নেশায়। রোমাঞ্চাভিলাষীরা প্রথম অভিযাত্রী, তাদের অনুসরণ করে অন্যরা। তবে মানুষের মধ্যে কিছু শিমূল গাছ আছে যারা নিজেকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে না হলেও নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্যে অভিবাসী হয়। এই ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিজের সক্ষমতার বিস্তার ।
শামীম আজাদের আত্মজৈবনিক উপন্যাস, “বংশবীজ”, এমনি একটি বই যা ধারণ করে আছে একটি সম্ভাবনার বীজ। শিমুল বীজের মত সাপ্তাহিক বিচিত্রার ফ্যাশন সাংবাদিক, লেখক. টিভি উপস্থাপক থেকে উল্লেখযোগ্য প্রবাসী লেখক, গল্পকথক, ইংরেজী-বাংলার দ্বি-ভাষিক কবি, নাট্যকার এবং উপস্থাপক হয়ে ওঠার কাহিনী ঘিরে রয়েছে বিলেতের মাটিতে তার নিজেকে ছড়িয়ে দেয়ার গল্প, পটভূমিতে পূর্বপুরুষদের বংশবীজ বিস্তার এবং এবং পূর্বসূরীদের নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার টুকরো ঘটনা। কাহিনীতে এসেছে লেখকের বড় হয়ে ওঠা, বিয়ে এবং পারিবারের খন্ড চিত্র। জীবিকা এবং জীবনের জন্যে তার মামাদের, আত্মীয় স্বজনদের এবং বৃহত্তর সিলেটে তথা বঙ্গবাসী অভিবাসীদের বিলেত যাত্রার কিছু ঘটনার সাথে প্রবাহিত হয়েছে মূলত: তার নিজের কাহিনী। দেশে একটা সুপ্রতিষ্ঠিত জীবন থাকতে শামীম আজাদের কাছে কেন এল কালাপানির হাতছানি? একি শিমুল বীজের মত ছড়িয়ে যাওয়া? নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিলাষ? শামীম আজাদের পিতৃব্য রোমাঞ্চপ্রিয় আবদুল লতিফ তরফদার ১৯২৯-৩০ সালে লন্ডনে যান, পাবের মালিক হন, শ্বেতাঙ্গ রমনিকে বিয়ে করেন, কন্যা সন্তানের জনক হন, দেশে ফিরে দেশীয় নারীকে বিয়ে করেন এবং যখন সাগরের টান নাড়িতে তার রক্ত ধারায় আবার টান দেয় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সিংগাপুরে আর্মি জিপ চালানোর সময় বোমার আঘাতে তিনি নিহত হন । তিনি পূণরায় বিয়ে করেছিলেন এবং সিংগাপুরে বাংলাদেশী বংশবীজ ছড়িয়েছিলেন। এ কাহিনীর নায়ক হতে পারতেন তিনি, হননি, কারণ এটা এ যুগের শামীম আজাদদের কাহিনী। বইয়ের ছোট্ট পরিসরে শামীম মমতা এবং ভালবাসায় বাঙালী অভিবাসীদের কথা বলেছেন, যারা ছড়িয়ে আছে ইস্ট লন্ডনের ব্রিকলেন, বেথনাল গ্রীণ, হোয়াইট চ্যাপেল এবং যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে। ভাষার প্রবাহমানতা ক্ষুণ্ণ না করে তিনি সিলেটী আঞ্চলিক সংলাপ প্রয়োগ করেছেন তার বইয়ে।
একটি বা দু’টি কথা। যদিও চরিত্র বা ঘটনার সূত্র ধরে পরের ঘটনা আগে এবং আগের ঘটনা পরে বলার মধ্য দিয়ে গল্প কথকের কৌশল তিনি ব্যবহার করেছেন তবুও আমার মনে হয়েছে পূর্ব এবং পরের ঘটনার বিভাজন রেখা আরেকটু স্পষ্ট হলে ভাল হত। ছাপার কিছু ভুল পরিবর্তী সংস্করনে সংশোধিত হয়ে যাবে বলে আশা করছি। সুপাঠ্য এই বই পাঠক-মাধ্যমে প্রসারিত হোক এই আশা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১:১২