বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে না কারণ ছাদে সেই শব্দ কল্পনা করাও বেমানান। জানালা দিয়ে দু-এক ফোটা পানি আসলেও জানালা টা বন্ধ করতে ইচ্ছে করছে না।
জানালার পাশেই আমার বিছানা। তাই দু-এক ফোটা আমার গায়েও আসছে মাঝে মাঝে। চোখ টা বন্ধ করে শুয়ে আছি। কেন জানি খুলতে একদম ই ইচ্ছে করছেনা চোখ দুটো। বৃষ্টির দু-এক ফোটা যখন শরীর কে আলতো ছুয়ে দিচ্ছে তখন মনে হচ্ছে যেন পরম প্রশান্তি আমার সর্বাঙ্গে শিহরণ দিয়ে যাচ্ছে।
বৃষ্টির শব্দ আরো বাড়তে লাগলো, বৈদ্যুতিক সংযোগ ও এখন বিচ্ছিন্ন। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দমকা হাওয়া রুমে প্রবেশ করছে। চোখ বন্ধ করে বাতাসের শরীর স্পর্শ করার খেলা অনুভব করছি। একজোড়া বাতাস মনে হচ্ছে যেন একে অপরকে ছুতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে প্রেমিক প্রেমিকার মতো। তাদের মাঝে বোধ হয় আমিই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি। কারণ, তারা অনবরত আমাকে শিউড়িয়ে তুলছে।
কিন্তু আমার ভালো লাগছে ওদের বাধা হতে। বাধা প্রেম কে আরো মজবুত করে দেয় কোন কোন সময়।
অনুভব করলাম আরো কিছু প্রেমিক যুগল বাতাস প্রবেশ করলো জানালা পথ দিয়ে। তারপর তারাও অনুসরণ করলো তাদের পূর্বজন কে। শুরু হলো তাদের অনবরত ছোটাছুটি। একে অন্যকে ধরবার আপ্রাণ চেষ্টা। এতো ছোটাছুটির ভিতরেও কোনটা কার সঙ্গী চিনে নিতে তারা ভুল করছে না। প্রিয়তমার শরীরের গন্ধ ই যেন তাদের পথ নির্ভুল করে দিচ্ছে।
বৃষ্টি আরো বেড়েই চলছে। তার সাথে বেড়ে চলছে প্রেমিক বাতাস তার প্রেমিকার পিছে অবিরাম ছোটাছুটি এবং তার সাথে আমার শরীরের কাঁপুনি টাও।
বৃষ্টি, বাতাস মানুষের মনে প্রেম কে সজাগ করে তোলে। জেগে তোলে মানুষের মনের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি।
এবার অনুভব করছি বাইরের দৃশ্য টা। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা আঘাত করে যাচ্ছে কোমল মাটি। আমি সুঘ্রাণ পাচ্ছি সেই মাটির। এমন ঘ্রাণ যার ব্যাপন সবার জন্য নয়। সবাই এই ঘ্রাণ উপলব্ধি করতে পারে না।
বৃষ্টি কল্পনার উৎস। এই কল্পনার গভীরতা কোন যন্ত্র দিয়ে মাপ করা যায় না। চোখ বুজে আরো একটু গভীরে চলে গেলাম মনের অজান্তে।
বৃষ্টির শব্দটা এবার একটু আলাদা। বৃষ্টি আরো জোরে পড়তে শুরু করেছে একজোড়া পা এর উপর। খালি পায়ে নূপুরের ঝনঝন শব্দ হচ্ছেনা বৃষ্টির জন্য। কিন্তু তাতে আফসোস নেই। গায়ে সাদা সেলোয়ার কামিজ,বাম হাতে সিলভার কালারের চিকন একটি চুড়ির মতো পরা, দুই পায়ে রুপার একজোড়া নূপুর, অসম্ভব সুন্দর গড়নের এই মেয়েটি দুহাত পাখির মতো মেলে সাদা আকাশের দিকে চেয়ে আছে। এমন সৌন্দর্য পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা একটি।
আচমকা জেগে উঠলাম। বৃষ্টি অনেকটা কমে গেছে, বাতাস ও আগের মতো আর খেলা করছে না। কিন্তু একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। শুভ্রতার বিশালতা ঘটে গেল যা শুধু কল্পনায়। মেয়েটির মুখ আমি দেখতে পাইনি। শুধু শুভ্রতা কে দেখেছি। যার এখন কিছুই সামনে নেই, তবে স্বান্তনা হিসেবে বৃষ্টি টা কে রেখে গেছে আমার জন্য।
আবার বৃষ্টি জোরে হতে শুরু করলো। জানালা দিয়ে দু-এক জোড়া বাতাস আবার রুমে ঢুকতে শুরু করলো। আমি আবারও চোখ বন্ধ করে তাদের খেলা অনুভব করতে লাগলাম। আবারো কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম আমি।
বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। একটি অসম্ভব সুন্দর মেয়ে আমার কাছে এসে কাকুতি মিনতি করছে, "আমি একটু বৃষ্টি তে ভিজি? আমাকে একটু ভিজতে দাও। ৫ মিনিট ভিজবো শুধু। প্লিজ প্লিজ।"
মেয়েটি সাদা স্যালোয়ার কামিজ পরেছে, হাতে চিকন একটা চুড়ি, দুপায়ে রুপার নূপুর। অনেক সুন্দর লাগছে মেয়েটি কে। এই মেয়েটি কে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি।
আমি বললাম, "না, অন্যা। এই বৃষ্টিতে ভিজলে অনেক জ্বর আসবে। ভিজতে হবেনা।"
অন্যা গাল ফুলিয়ে বারান্দায় চলে গেল, কিছু বললো না। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা রিভাইজ দিচ্ছিলাম। বৃষ্টি তে আবছা আলোয় বই পড়তে অনেক মজা লাগে আমার।
৫ মিনিট হয়ে গেল অন্যা রুমে আসে নাই। বৃষ্টি আরো জোরে শুরু হয়েছে। বই রেখে বারান্দায় গেলাম।
বারান্দায় যেতেই দেখি অন্যা দুহাত দিয়ে একবার দড়জা ধরছে, একবার ওড়নার কাপড় আঙুলের সাথে এমনভাবে পেঁচাচ্ছে যেন হয় আঙুল ছিড়বে নয়তো কাপড়।
আমি আস্তে করে ওর পিছনে গিয়ে দাড়ালাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ও নিজেকে শক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলো।
আমি ওকে আমার দিকে ঘুড়িয়ে নিলাম। চোখের পানি মুছে দিয়ে ওর দুহাত আমার হাতে নিয়ে বললাম, "কোন কিছু হাতের কাছে পেয়েও যদি না পাওয়া যায়, তাহলে সেটার কষ্ট অনেক বেশি সেটা আমি জানি। কিন্তু এটা মনে রেখো, কষ্টের পর পাওয়া সুখে আনন্দ তার থেকেও বেশি। বৃষ্টি আরো জোরে শুরু হইছে, যাও, বৃষ্টি তে হারিয়ে যাও।"
মেয়েটি রাগ করে থাকতে একটু ও চেষ্টা করলো না। সাথে সাথে হাসিতে মুখটা ভরে উঠলো। বৃষ্টির পানিতে পুরো শরীর ভিজে গেল ওর। পাখির মতো দুহাত মেলে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে বিশালতা কে উপলব্ধি করতে লাগলো। আমি পিছন থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলাম। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কিছু হতেই পারে না।
একটি মেয়ে বৃষ্টি তে ভেজার জন্য এতটা আকুল হতে পারে!
হ্যা, অন্যা পারে। তাই দাগ টা খুব গাঢ় করেই কেটে রেখেছিল সে।
আর তাই বৃষ্টি হলেই একটি পরী কে দেখি পাগলের মতো বৃষ্টি তে ভিজতে, বৃষ্টি কে অবলোকন করতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৪:১০