কোটার কেস স্টাডি :
আমার বন্ধু কুদ্দুস। আমি জানি না তার হোম ডিসট্রিক্ট কোথায়। কিন্তু সে বলতে ভালোবাসে, গোপালগঞ্জ। মজা করে এও বলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি তার ফুফু। হোয়াটেভার ইট ইজ। ভদ্রলোক জাহাঙ্গীর নগর থেকে পাশ করে দীর্ঘদিন গোঁফে তা দিচ্ছে সরকারি চাকরি করবে বলে। হচ্ছে না। পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, তার চাকরি হচ্ছে না। আমি সারাজীবন প্রতিযোগীতা ঘৃণা করি বলে জীবনে কোন চাকরির পরীক্ষা দেই নাই। এবার একবার ফরম ফিলাপ করলাম অগ্রণী ব্যাংকের, তাও পরীক্ষা দিতে যাওয়া হয়নি। জানলাম প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় পরীক্ষা বাতিল। কুদ্দুস বিরক্ত হয়ে ‘গঠনমূলক লক্ষ্য নিয়ে’ বিসিএস এর জন্য পড়ালেখা শুরু করলো। ‘আদা-জল খেয়ে লাগা’ যাকে বলে। আমরা নিশ্চিত হয়ে গেলাম কুদ্দুস স্যার এবার ছক্কা হাঁকাবেই। তাকে বিরক্ত করা ছেড়ে দিলাম, যাতে পাশ করতে না পারার ব্যর্থতার দায় আমাদের কাঁধে না বর্তায়। অনেক দিন পর আজ তার সঙ্গে দেখা। কুদ্দুস!!! তুমি কত পাইসো? কুদ্দুস জানায় সে ৭৫.৫ পেয়েছে, কিন্তু ব্যর্থ। অন্যদিকে কুদ্দুসের ঘনিষ্ট বন্ধু, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সংগ্রহকারী পিতার সন্তান মফিজ ৫৫ পেয়ে ‘কেটে গেছে’। ‘বন্ধু ফেল করলে কষ্ট লাগে, ফাস্ট হলে আরও কষ্ট’ কুদ্দুসের সে অবস্থা। কুদ্দুসের চোখে ক্ষোভ-- ফুফুরে আমার আর ভাল্লাগে না, ফুফু যেন আর ক্ষমতায় না আসে; এইসব বিলাপে কাটলো আজকের কুদ্দুসীয় সন্ধ্যা।
দেশে বোধকরি এমন অনেক মফিজের পিতা আছেন, যারা মুক্তিযোদ্ধার সনদ ‘সংগ্রহ’ করেছেন। যুদ্ধে না গিয়ে যোদ্ধা হয়ে যাওয়া প্রচুর মুক্তিযোদ্ধারাও জানেন, একাত্তরে দেশের সকল মানুষই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। যারা যোদ্ধাদের পানি এগিয়ে দিয়েছেন, খাবার রান্না করে দিয়েছেন। আর যারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি পোড়াবার জন্য পাক বাহিনীদের পথ দেখিয়েছেন, ধর্ষণের জন্য এগিয়ে দিয়েছেন মা বোনদের-- তেমন লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম। আবার এমন অভিমানী মুক্তিযোদ্ধা বহু আছেন যারা মনে করেন, ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, সার্টিফিকেটের জন্য নয়।’ কিন্তু তাদের অনেকের সন্তানের যেন মনে রয়েছে উল্টো কথা, কোটাহীনতায় চাকরি হয়নি, মেধাহীনতায় নয়। আমাদের অবশ্য শিক্ষাজীবনেরই মূল শ্লোগান, ‘সার্টিফিকেটের জন্য পড়তে যাই, শিক্ষার জন্য নয়’। সবাইতো আর থ্রি ইডিয়টের র্যাঞ্চো না। তাই সবারই সার্টিফিকেট দরকার হয়, সার্টিফিকেটে আবার চাকরি হয় না। থাকতে হয় মেধা। আবার মেধা থাকলেই হয় না, প্রয়োজন সার্টিফিকেটধারী পিতা ও তার যুদ্ধের কোটা।
আমাদের দেশের আজকের এ বেহাল দশার মূল কারণ কী হতে পারে? আমলাতন্ত্র কী খুব মেধাবীরা নিয়ন্ত্রণ করে? মেধার মাপকাঠি কী? মাছি মারা ক্যারানির কাজে কতটা মেধার প্রয়োজন হয়? বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে কতজন আছেন যারা প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় টিকেছেন? আকিজ, আরপি সাহা, জহুরুল হক, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ড. ইউনূস, আব্দুল্লাহ আবু সাইদ এঁরা মেধাবী কি না আমি জানি না। তবে এটা জানি কেন আমাদের তরুণরা সরকারি চাকরির পেছনে পাগলের মতো ছোটেন। কেন তারা লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে হলেও একটা সরকারি চাকুরি চান। কারণ সরকারি চাকরিতে একবার ঢুকলে কাজ না করলেও চাকরি যায় না, কাজে ফাঁকি দিয়ে অন্য ব্যবসা করা যায়, কন্যার মায়েরা মোটা অঙ্কের পণ নিয়ে তাদের পেছনে ছোটেন, বিদেশে বেড়াতে যাওয়া যায়, প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে প্রজাদের কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় না এবং সবচেয়ে বড় সুবিধে চাকরি ছাড়ার পর এককালীন অনেকগুলো টাকা পাওয়া যায়। সুতারং এমন একটা নিশ্চিত জীবন কে না চায়? কে যায় টার্গেট ওরিয়েন্টেড চাকরি করতে? প্রথমে মুখস্ত করতে হবে সাধারণ জ্ঞান, বাংলা সাহিত্যে ও ব্যাকরণ, সাধারণ গণিতটা একটু কষ্ট করে আয়ত্বে আনতে হবে। ব্যস তারপর লাখ খানেক টাকা ঘুষ-- এরপর নিশ্চিন্ত জীবন, এর পর স্বপ্ন হবে সত্যি, ঘুষের ওপর ঘুষ...।
কোটার কতটা যৌক্তিক :
কোটার কোন প্রয়োজন আছে বলে বলে আমি মনে করি না। যে শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবনের সুদীর্ঘ সময় পার করে আসতে পারে কোটাহীন, চাকরির সময় তাকে কেন কোটার ফোঁটায় তিলক আঁকতে হবে বুঝি না। নারীরা সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সমান স্বাধীনতা চাইবে আবার পাবলিক বাসে চাইবে লেডিস সিট, পাবলিক পরীক্ষায় নারী কোটা-- এটা মেনে নেওয়া যাবে কী? আদিবাসীদের যদি কোটা দেয়া হয়, আমি মনে করি এটা তাদের এক রকম অপমানই করা হয়। এ ধরণের অপমানজনক বৃটিশ ব্যবস্থা বাতিল করা দরকার। আদিবাসী শিক্ষার্থী তার নিজ মেধায় স্নাতক পর্যন্ত পাশ করতে পারলে অন্য যেকোন পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের ক্ষেত্রেও কোটা বন্ধ করা জরুরী এই জন্য যে-- দেশের বহু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ও তাদের পরিবারকে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে নূন্যতম সম্মানটুকু দিতে পারি না। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা একটু অবস্থা সম্পন্ন, যারা একটু কৌশলী, যারা যুদ্ধে না গিয়েও সার্টিফিকেট সংগ্রহের কাজটি সফলভাবে করেছেন তাদের মধ্যে যেমন ব্যবধান বিদ্যমান, তেমনি মনে রাখা দরকার যে, মুক্তিযুদ্ধের বহু বছর পার হয়ে গেছে। এখন আর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা সবাই চাকরির বয়স পেরিয়ে গেছেন। পেরোননি এমন খুব বেশি নেই, কিন্তু তাদের খুঁজতে গুগলে সার্চ দিতে হবে।
শাহবাগের সাম্প্রতিক আন্দোলন প্রসঙ্গ :
কোটা বাতিলের দাবিতে শাহবাগে প্রজন্ম চত্তরের আন্দোলনরত মেধাবীদের কিন্তু বেশ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে যেমনটি করা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্ত্বরের সমাবেশের শিশুদের। বুঝতে হবে, প্রজন্ম চত্ত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ বসেছিল জাতীয় একটি স্পর্শকাতর ইশ্যুতে। ঠিক একই জায়গায় ব্যক্তিগত চাকরির ইশ্যু নিয়ে রমজান মাসের ব্যস্ত সড়ক আটকে দেয়া খুবই ন্যাক্কারজনক ও মেধাহীনতার লক্ষণ। তাদেরকে যে ব্যবহার করা হয়েছে সে আলামত ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। চত্ত্বরের নাম মেধা চত্ত্বর দিয়ে তাদের জেহাদী জোস আনায়নের ব্যর্থ চেষ্টা করা তারই নমুনা। কোন মহল তাদের কেন ব্যবহার করতে চায় তাও কিন্তু সচেতন শ্রেণী ইতোমধ্যে বোল্ড হরফে লিখিত জানিয়েছেন। সরকারের শেষ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রীক একটি চমৎকার অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারলে কারো কারো ঘর পুড়বে, কেউ কেউ আলু খেতে লবন নিয়ে আসবে পার্টি অফিস থেকে। সুতরাং মেধাবীদের অনুরোধ করবো পড়ালেখা করুন জ্ঞান অর্জনের জন্য, অন্যের কথায় নৃত্যের ক্ষেত্রেও খরচ করুন সেই জ্ঞান এবং সঠিক কাজটি সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে করতেও ওই একই জ্ঞান ব্যয় করুন। মেধাবীদের মঙ্গল হোক।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ২:১৬