রাজু হাটতে হাটতে আজিমপুর থেকে নীলক্ষেতের দিকে চলে এল। যাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে। ওর ক্যাম্পাস অনেক ভাল লাগে। এখানে অনেক রকম মানুষ আসে। সবাই অনেক আনন্দ ফুর্তি করে। আড্ডা দেয়। রাজু চেয়ে চেয়ে দেখে।
প্রথম রাজুকে ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছিল ওর বাবা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইয়া আপুরা ছোট বাচ্ছাদের পড়ায়। রাজুর বাবা ওকে এখানে এনে ভর্তি করে দেয় বছর খানেক হল। প্রতিদিন বিকালে ওর বাবা ওকে দিয়ে যায় আবার ঘন্টা দুয়েক পর নিয়ে যায়।
রাজুর বাবা রিক্সা চালায়। আজিমপুরে এক রুমের একটা ছোট বাসায় থাকে। কোন মতে কষ্টে দিন কেটে যায়। মহাজনের জমার টাকা আর ঘর ভাড়া দিয়ে যা থাকে তা দিয়ে কোন মতে দু বেলা খেতে পারে। মাঝে মাঝে তাও হয় না। তার উপর গেল মাসে একটা বাচ্ছা হয়েছে। মেয়ে। নাম রেখেছে রুপালী। বউটার শরীরের অবস্থা ভাল না। রাতের বেলা ঘুমাতে পারে না। গরমে বাচ্ছাটা শুধু কাঁদে। পরে না পেরে ৮০০ টাকা দিয়ে একটা পুরানা ফ্যান কিনে আনল। অনেক কষ্টের জমানো সামান্য কটা টাকা। কিন্তু ফ্যানটা প্রচন্ড আওয়াজ করে। তাতে কি! কিছুটা বাতাস তো পাওয়া যায়!
রাজুর মা ঘুমাচ্ছে দুপুরের খাবার খেয়ে। ওর বাবা রিক্সা নিয়ে বের হয়েছে। এ ফাকে ও বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে। কিন্তু বাইরে এত রোদ বুঝতে পারে নি। রাজু নীলক্ষেতের দোকানের ফ্রিজে সাজানো কোল্ড ড্রিংসের বোতল গুলো দেখতে লাগল তৃষিত নয়নে। অনেকক্ষণ একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। দোকানদার বলল, এই পিচ্ছি। এখানে কি? যা ভাগ...!
রাজুর চোখে পানি চিকমিক করে উঠল। ওর এই ছোট্ট জীবনে কেউ ওর সাথে এমন ব্যবহার করে নি। ও ঘুরে দৌড় দিল। এক দৌড়ে বাসায়। বাসায় গিয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকালো। তারপর আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে গেল।
বিকালে ওর বাবা আসলে আদুরে গলায় বলল, বাজান! পানি খাব। ঠান্ডা পানি।
ওর বাবা বলল, ঠান্ডা পানি খাবি? আচ্ছা চল। কলটা ভালো মত চাপলে পানি ঠান্ডা পাওয়া যাইব।
রাজু আদুরে গলায় বলল, আরে কলের পানি নাতো! ঐ যে দোকানে আছে না? বরফ দিয়ে রাখে ঐ পানি। বোতলের ভিতর...।
রাজুর বাবা বুঝতে পারল ছেলে বড় লোকদের ‘ঠান্ডা পানি’ খেতে চাচ্ছে। সাথে সাথে একটা হিসাব করে ফেলল। ঐ রকম পানির এক বোতল ৩০/৩৫ টাকা হবে। সাথে আর ৫/১০ টাকা হলে এক কেজি চাল পাওয়া যাবে। অভাবের এই দিনে এত গুলা টাকা নষ্ট করা ঠিক না। কিন্তু ছেলে একটা আবদার করেছে...
রাজুর বাবা বলল, ঐ পানি খাওয়া ভাল না বাজান। পেট খারাপ করবে।
রাজু ছোট মানুষ। ও এত শত বুঝবে কেন? ও গাল ফুলিয়ে বলল, না আমি খাবই।
রাজুর মা বলল, আহ রাজু কি শুরু করলি? থাম তো...
রাজুর বাবা বলল, আচ্ছা ঠিক বাজান। তোকে পরে একদিন কিনে দিব।
রাজু গাল ফুলিয়ে ঘুমাতে গেল।
রাজু আজকে দুপুরে আবার বের হয়ে এলো প্রতিদিনের মত। আজিমপুর থেকে হেঁটে হেঁটে নীলক্ষেত। যাবার সময় ঐ দোকানের সামনে দাঁড়াল। দোকানদার ওর দিকে তাকাতেই একটা ভেংচি দিয়ে পালাল। এক দৌড়ে সোজা টিএসসি-তে। অনেকক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরতে লাগল। মানুষ দেখতে লাগল। হঠাৎ দেখল কিছু বাচ্ছা মানুষজনের কাছে খাবার চাইতেছে। আর সবাই কিছু না কিছু দিয়ে দিচ্ছে। রাজু দেখল সড়ক দ্বীপের ওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে অনেকে ‘ঠান্ডা পানি’ খাচ্ছে। রাজু ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল। এক সুন্দরী আপুর কাছে গিয়ে বলল, আপা! একটু ঠান্ডা পানি দিবেন?
সুন্দরী ওর দিকে ঘুরে তাকাল। রাজু চোখ নিচে নামিয়ে নিল। পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে পাটি খোঁচাতে লাগল আর ঐ দিকে তাকিয়ে রইল।
সুন্দরী ওকে জিজ্ঞেস করল, কি নাম তোমার?
-রাজু
-রাজু? রাজু পড়ালেখা কর?
-হ্যাঁ। ঐ যে ওখানে (রাজু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো)
সুন্দরী মেয়েটি আর কথা বাড়াল না। রাজুর মায়া মায়া চেহারা দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, নাও। অল্প একটু আছে। আমি অনেকটা খেয়ে ফেলছি।
রাজু ফিক করে হেঁসে দিল। ধন্যবাদের হাঁসি। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। মুখে ধন্যবাদ দেয়ার বিষয়টা বুঝার মত বয়স ওর হয় নি।
ঠিক ঐ সময় রাস্তার উপর থেকে একজন রাজুকে দেখতেছিল। ইস্কান্দর আলী। রাজুদের বাসার কয়েক বাসা পরে থাকে। ওর বাবার মতই রিক্সা চালায়। বিকালে যখন রাজুর বাবার সাথে ইস্কান্দর আলীর দেখা হল তখন সে শ্লেষ মাখা গলায় বলল, কি খবর রহমত মিয়া? ছেটারে কি ভিক্ষায় নামায়া দিলা?
রাজুর বাবা আকাশ থেকে পড়ল! সে কিছু না বুঝে বলল, কি কও এইসব মিয়া ভাই! আমি তো কিছুই বুঝবার পারতেছি না।
ইস্কান্দর আলী বলল, থাক। আর ঢং করতে হবে না। আজকে দেখলাম তোমার পোলা রাজু মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা করে জুস খাইতেছে। তোমার কি টাকা পয়সার এতই টানাটানি লাগছে?
রাজুর বাবার মনে পড়ে যায় গতকাল রাতে রাজু ‘ঠান্ডা পানি’ খাইতে চেয়েছিল। তার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। রাগে অন্ধ হয়ে বাসার দিকে যায়।
বাসায় গিয়েই ক্ষিপ্ত রহমত উদ্দিন চড়া গলায় বলল, রাজু! এই হারামীর বাচ্ছা! এইদিকে আয়। আজকে তোর ঠান্ডা পানি খাওয়া বের করতেছি।
রাজু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল। ও ঠিক বুঝতেছে না কি হচ্ছে। ওর সাথে ওর বাবা কখনও এমন ব্যবহার করে নি।
রাজু কাছে আসতেই রহমত ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একের পর এক চড়-থাপ্পর মারতে লাগল। রাজুর মা রান্না ছেঁড়ে দৌড়ে এসে রাজুকে ছাড়িয়ে নিল। বলতে লাগল, আরে কি করছো? পাগল হলে নাকি?
রহমত বলল, হারামীর বাচ্ছা ভিক্ষা করেছে। ভিক্ষা করে ‘ঠান্ডা পানি’ পানি খেয়েছে! আমার ছেলে ভিক্ষা করেছে। আমি অতটাই অধম। রহমত মিয়া বাচ্ছাদের মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। রাজু ওর মায়ের আড়াল থেকে ওর বাবাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখল। ওর গোল গোল চোখগুলো চিকচিক করছে। সেখানে কোন দুঃখ নেই, আছে বিস্ময়। পৃথিবীর রুঢ়তা দেখে বিস্মিত নবীন চোখ জোড়া অপলক চেয়েই রইল।
রাশেদ সাইফুল
১১/০৬/২০১৩
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৩ রাত ১:৫৩