সৌদি আরবের স্থানীয় সময় রাত সাড়ে আটটার দিকে আমরা জেদ্দা বিমান বন্দরে অবতরন করি। ইহরাম অবস্থায় আছি আমরা, মুখে তালবিয়া। নিয়ত ও বাসনায় মক্কা মোকাররমা পৌঁছে সর্বাগ্রে উমরাহ্ সম্পন্ন করার স্থির সিদ্ধান্তে অটল আছি। সুতরাং স্বপ্নের কা’বা কখন দেখতে পাব ভেতর ভেতর এ জিজ্ঞাসা বার বার উচ্চারিত হচ্ছে। দীর্ঘ ৭ (সাত) ঘণ্টা অপেক্ষার পর আমাদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, যার মধ্যে শুধু কাউন্টারে দাঁড়িয়েই থাকতে হয়েছে পাক্কা দুই ঘণ্টা। সেখানে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কিছুটা অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের শিকারও আমরা হয়েছি। আমরা হজ্জব্রত পালনের মতো পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে যাচ্ছি তাতে তাদের কী ? এমন হাজার হাজার লোক তো প্রতিদিনই তাদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে পার হচ্ছে!
প্রথমবারের মতো মাতৃভূমি থেকে প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার দূরের সৌদি রাজ্যের তপ্ত ভূমিতে পা রেখেছি- এখানে জন্ম লাভ করেছিলেন সারা বিশ্বের সর্বকালের সেরা মানব প্রিয় রাসূল(স.), কিছুটা রোমাঞ্চ তো আছেই, তবু ক্ষুধার অনুভূতি আমায় ক্ষমা করল না। বেশ ক্ষুধা অনুভব করছি। অবশ্য দেহের ক্ষুধার পাশাপাশি কা‘বা ঘর দেখতে পাওয়ার মনের ক্ষুধা কখনো কখনো বেশি চড়াও হতে থাকে। জেদ্দা বিমান বন্দরের বাংলাদেশ প্লাজা মসজিদে ফজর নামায আদায়ের আরো কিছুক্ষণ পর আমরা বাসে চড়ে পবিত্র মক্কা-মোকাররমার উদ্দেশ্যে রওনা হই। শহর ছেড়ে বিস্তৃত মরু অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করছি আর মনে হচ্ছে ঐ দূরের দৃশ্যমান অঞ্চলের আড়ালেই কি কা‘বা ? জেদ্দা থেকে মক্কার দূরত্ব ৯০ কিঃমিঃ, রাস্তা বেশ প্রশস্ত ও নির্ঝঞ্ঝাট। সুতরাং কত সময়ই বা লাগবে ? বেলা ১১টার পূর্বেই নিশ্চয়ই স্বপ্নের কা‘বা দেখতে পাব ! অপেক্ষা সমাপ্তির মুহূর্ত ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছে ভাবতেই নিজের মধ্যে ভিন্ন মাত্রার শিহরণ নড়ে চড়ে বসছে।
রাস্তার দু‘ধারে এবার শুরু হয় পাহাড়। পাহাড়ের প্রতি আমার কৌতূহল একটু ভিন্ন মাত্রায়। তদুপরি আরব রাজ্যের পাহাড় ! দূরে এবং কাছে দেখতে পাচ্ছি শুধুই পাথরের পাহাড়। এবার মনে ধারণা জন্মাল নিশ্চয়ই এমন কোন পাহাড়ের ফোকল গলে দৃশ্যমান হবে প্রাণের আকুতি ও আবেগ মিশে থাকা কা‘বা শরীফ। বাসের ভেতরে অনেককে দেখলাম নিদ্রাকাতরতার কাছে দিব্যি হার মেনে এক প্রকার নির্মোহ ঝিমুনিকে তারা বেছে নিয়েছে। কিন্তু আমার দুটি চোখ গাছ-পালাবিহীন বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর, মরুর উট এ সবই খুঁজে ফিরছে। এক সময় নজরে আসে মক্কা গেট। হ্যা- এ গেট তো পরিচিত ! তার মানে আমরা মক্কা এলাকায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আরেকটু পরেই পৌঁছে যাব বাইতুল্লাহর সান্নিধ্যে ! ভাবতে ভাবতেই আমরা হারাম এরিয়ার মধ্যে প্রবেশ করি যদিও এখনো বাইতুল্লাহ অনেক দূরে। বাইতুল্লাহর হারাম এরিয়া আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এমন ধারণা দিয়ে গেছেন রাসূলুল্লাহ (স.)। জানা যায়, হযরত আদম ও হাওয়া (আ.) নিজেদের কৃত অপরাধের জন্য দীর্ঘদিন কান্নাকাটি ও অনুশোচনার পর আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হন ও আল্লাহ তাঁদের ক্ষমা করেন। অতঃপর তাদের বলা হয় পবিত্র কা‘বা ঘর তাওয়াফ করতে। তারা কা‘বার চারপাশে তাওয়াফের সময় মনে মনে ইবলিসের ভয় অনুভব করেন যে, যদি তারা আবার ইবলিস কর্তক কোন ধোকায় পড়েন ! আল্লাহ পাক তাদের অভয় দেন এবং ফিরিশতাদের এক বিশাল বেষ্টনী তৈরি করতে বলা হয় যার মধ্যে শয়তান যেন কোনভাবেই প্রবেশ করতে না পারে। ফিরিশতাদের নির্মিত সেই বেষ্টনী বা বন্ধন এলাকাই হারাম এরিয়া হিসাবে চিহ্নিত যেখানে এখনো কোন অমুসলিমের প্রবেশাধিকার নেই।
পথের একাধিক চেকিং ও নানা ফরমালিটিজ শেষ করে এখন মক্কা নগরীতে পৌঁছেছি বলে মনে হলো- ঐ তো মক্কা ওয়াচ টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। ১০০ তলা উঁচু বিশাল এ ঘড়ি টাওয়ারের আমরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছি বলেই মনে হলো। ভেতরে উত্তেজনা শুরু হয়। কৌতূহলী দৃষ্টি ও তৃপ্তির নার্ভগুলো নতুন করে জেগে ওঠে। কিন্তু না- টাওয়ারটা একটু দূরে থাকতেই আমাদের বহনকারী বাস ইউ টার্ন নিয়ে পেছন দিকে মুখ ঘুরায়। এ কি ! গাড়ী ঘুরিয়ে আবার কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছে ? অবশেষে আমরা হোটেলে যখন পৌঁছি তখন বেলা সাড়ে বারোটা। লাগেজপত্র হালকা গুছিয়ে গরম পানির গোসল সেরে বিছানায় এসে বসি। পাশের কক্ষের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মক্কা টাওয়ারের ঘড়ি। তার মানে আমরা এখন আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশি। চারিদিকে চোখ ঘুরালেই পাহাড় আর পাহাড় নজরে পড়ছে। তার মানে আরব ভূমির পার্বত্য পাদদেশেই পবিত্র কা‘বার ঐতিহাসিক অবস্থান যা ভাবনার উপকরণও লালন করে।
কারা যেন হোটেলের লবিতে বিরানীর প্যাকেট দিয়ে গেছে হাজীদের সম্মানে। ক্ষুধার মাত্রা অধিক থাকায় আগ-পিছু না ভেবে লাঞ্চ সেরে নিই। গতকাল বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টায় (বাংলাদেশ সময় থেকে সৌদি আরবের সময় ৩ ঘণ্টা পিছিয়ে) বাসা থেকে বের হয়েছি- সে হিসাবে প্রায় ৩২ ঘণ্টা সফর শেষে বিদেশ বিভূঁইয়ের এ হোটেল বিছানায় ক্লান্ত শরীরকে পেতে দেয়া দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের উমরাহ্ সারতে হবে- কাবা শরীফ দেখব সরাসরি নিজের চোখে- তার চার পাশে তাওয়াফ করব, আল্লাহকে ডাকব, তাঁর কাছে কত কিছু মিনতি করব, বিশ্রামকে কীভাবে প্রশ্রয় দেয়া যায় ?
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আমরা ৪ জনের হাজী দল ইহরামের পোশাকে হোটেল থেকে বের হই উমরাহ্র উদ্দেশ্যে। মক্কা টাওয়ার দেখা যাচ্ছে তবু কারো কাছে জিজ্ঞাসা করে তৃপ্তির আবহ গায়ে মাখার চেষ্টা- “হেরেম শরীফ আর কত দূর” ? এই তো কাছেই। মনের ভেতর শান্তির পরশ পাখা মেলতে থাকে। মুসলিম হিসাবে সেই শিশুকাল থেকেই কামনায় বাসনায় যে কা‘বা শরীফকে কল্পনা করেছি তা এখান থেকে একেবারেই কাছেই ? পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলিম পরম শ্রদ্ধায় যে দিকে মুখ করে নামায আদায় করে আমরা তার সন্নিকটেই ? দাম্ভিক বাদশা অভিশপ্ত আবরাহা যে কা‘বা ধ্বংস করতে এসে হস্তীবাহিনীসহ নিজে ধ্বংস হয়েছিল সম্মানিত সেই কা‘বা যে কোন মুহূর্তে দৃষ্টিগোচর হবে ? আমার পরম সৌভাগ্যের দুয়ার তাহলে এখনই উম্মুক্ত হবে ? একি কল্পনা নাকি নিছক স্বপ্নচিত্রের কল্পিত পাটাতন ? ভাবতেই শিহরিত হই।
আবার জিজ্ঞাসা করি-“বাইতুল্লাহ আর কত দূর ?”- এই তো ঐ বিল্ডিং এর পরেই। আমরা হিজরা রোডে কবুতর চত্বর পার হয়ে এসেছি। মক্কা টাওয়ারের একেবারেই নিচে তার মানে ঐ সামনের ভিন্ন শৈলীর বেষ্টনী ভবনের ভেতরেই পবিত্র কা‘বা। কামনা, বাসনা ও লালিত স্বপ্নের তৃপ্ত পূর্ণতা ও উত্তেজনায় নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। হার্টবিট বেড়ে যায়, প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে আসা স্বপ্নময় ক্লান্ত দুটি চোখ সহসা ছল ছল হয়ে ওঠে। চোখে এখনো ক্লান্তি আছে কিন্তু নিদ্রা নেই, স্বপ্ন আছে কিন্তু বিলম্ব নেই, বাসনা আছে কিন্তু বাঁধা নেই- শুধু কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র।
মাইকে আসরের আযান শুরু হয়। কা‘বা শরীফের আযান যা আগে শুনেছি ইথারের বদৌলতে বেতার তরঙ্গে। আর আজ সরাসরি ! ভিন্ন আমেজের এ আযানে উত্তেজনা আরো বাড়ে। দ্রুত পদে আমরা অগ্রসর হই- অবশেষে ৮৭ নং গেটের কয়েক গজ দূরে থাকতেই ইকামাত হয়। আমরা সেখানেই নামাযে দাঁড়িয়ে যাই। নামায শেষে ভেতরে প্রবেশের প্রচেষ্টা কিন্তু গেটের ওপরে ডিজিটাল বোর্ডে লাল রঙের লেখা No Entry। ভেতর থেকে এখন হাজীরা বের হচ্ছে। আমরা নিঃশব্দ উত্তেজনাকে সঙ্গী করে অপেক্ষা করতে থাকি। মিনিট সাতেক পর গেট ছেড়ে দেয়া হয়। ৮৯ নং গেট দিয়ে আমরা দোয়া ও তালবিয়া পড়তে পড়তে ভেতরে প্রবেশ করি।
অত্যাধুনিক কারুকাজ সম্বলিত হারাম প্লাজার অভ্যন্তরভাগে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায়ও যেন ভেতরের ঘন নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হতে চায় না। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিক কারুকাজ দেখছি আর হাঁটছি- কিন্তু পিপাসার্ত দুটি চোখ খুঁজে ফিরছে পৃথিবীর প্রথম ঘর আল্লাহ কর্তৃক সম্মানিত কা‘বাকে। প্রতিটি পা ফেলায় নিঃশ্বাসের মাত্রা বাড়তে থাকে। ডানে-বামে তাকাই, সবাই যাচ্ছি বাইতুল্লাহর দিকে। দুটি চোখের শিকারী দৃষ্টি সজাগ পাহারাদারের মতো নিবদ্ধ হচ্ছে সম্মুখ পানে। যে কোন মুহূর্তে স্বপ্নের কা‘বা নজরে আসবে এই ভাবনায় চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে।
আল্লাহু আকবার- ঐ তো স্বর্ণখচিত পবিত্র কুরআনের আয়াত সম্বলিত কালো গেলাফে মোড়ানো কা‘বা ঘর যা এতদিন দেখেছি শয়নে-স্বপনে কিংবা ছবিতে। কান্না ধরে রাখা আর সম্ভব হলো না- থমকে দাঁড়াই। কা‘বা ঘর প্রথমবারের মতো নজরে এলেই দাঁড়িয়ে যেতে হয়, দোয়া বলতে হয়। এই সময়টা দোয়া কবুলের সময়। আমার সৌভাগ্যবান দুটি চোখ ক্লান্তি ভুলে তাকিয়ে আছে স্বপ্নের কা‘বার দিকে। এই সেই কা‘বা যার টানে আমি বহুদূর থেকে সাগর- পাহাড়-জঙ্গল ফেলে ছুটে এসেছি ! এই সেই কা‘বা যার কথা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন। এই সেই কা‘বা যার গায়ে হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আ.) এর শ্রম হাতের পবিত্র স্পর্শ লেগে আছে, আমার প্রিয় রাসূলের(স.) নিজ হাতে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ দেয়ালে সেটে আছে! এই সেই কা‘বা যার চতুর্দিকে তাওয়াফ করেছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)। ভাষা যেন জমাট বেঁধে যায়। মহান মনিবের কাছে কী চাইব কিছুই মনে করতে পারছি না ! তবু দু‘ হাত তুলে সংক্ষিপ্ত দোয়া করি। হে মাবুদ ! আমি আপনার দরবারে হাজির হয়েছি, আমাকে আপনি মাফ করে কবুল করে নিন। আমার মা-বাবা, বংশধরদেরকেও আপনি মাফ করে দিন। গুনাহের বোঝা মাথায় নিয়ে আনত নয়নে আরো কিছু কথা বলে দোয়া শেষ করি। অতঃপর ধীর পদে এগিয়ে পৌঁছে যাই গ্রাউন্ড ফ্লোর মাতাফে। দোয়া পড়তে পড়তে সহসা মিশে যাই তাওয়াফকারীদের অবারিত স্রোতে। এ এক অনন্য অনুভূতির মুহূর্ত, অবর্ণনীয় উপলব্ধির সতেজ উপলক্ষ্য।
-------
ঢাকা
৩১/১০/২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৩৫