সংগ্রামী বন্ধুগণ,
এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলে উপহাস করা হতো। ঝুড়ির তলায় ¯¦র্ণ খনির সন্ধান পেয়ে মার্কিন-ব্রিটিশসহ সাম্রাজ্যবাদীদের হিংস্র থাবা এখন বাংলাদেশের দিকে। ইতোমধ্যে জনগণের প্রতিরোধের মুখে বন্দর দখল করার চেষ্টা প্রতিহত করা হয়েছে। বিগত ৩৯ বছর ধরে শাসক সরকারসমূহ অসম পিএসসির মাধ্যমে দেশের স্থলভাগের গ্যাস ব্লকগুলো বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ইজারা দিয়ে দেশকে মারাত্মক জ্বালানি নিরাপত্তা হীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। বহুজাতিক কোম্পনিসমূহ কখনও প্রচার করছে দেশ গ্যাসের উপর ভাসছে, আবার কখনও বলছে গ্যাস শূণ্য বাংলাদেশ। আমাদের দেশের একদল ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞরাও তাদের সঙ্গে সূর মিলিয়ে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে বিদেশে গ্যাস রপ্তানির অপচেষ্টা চালিয়েছে। জনগণের প্রতিরোধে তা কার্যকর করতে পারেনি। বর্তমানে নতুন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কেয়ার্ন এনার্জিকে ৩য় পক্ষের কাছে গ্যাস বিμির অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ভয়াবহ হুমকীর মুখে পড়বে। শাসক সরকারগুলোর নতজানু নীতির ফলে যে অসম পিএসসি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তাতে গ্যাসের মালিক হয়েও বছরে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা আমাদেরকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। গ্যাস-বন্দরের পাশাপাশি কয়লা লুণ্ঠনের জন্যও সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শাসকগোষ্ঠীর সহায়তায় বাংলাদেশের উপর শকুনের মত ঝাঁড়িয়ে পড়েছে।
তারা বলছে মাটির নীচে কয়লা রেখে লাভ কি? যতদ্রুত যেভাবে পারা যায় কয়লা উত্তোলন করতে হবে, তাতে দেশের উনড়বতি। মাটির নীচে রেখে দিলে দেশের ক্ষতি। যারা কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে উত্তোলনে বাধা দিচ্ছে তারা উনড়বয়ন ও দেশের স্বার্থবিরোধী। আমরা কয়লা উত্তোলনের বিরোধী নই। বরং কী পদ্ধতিতে কয়লা তুললে আমাদের দেশের মানুষ ও পরিবেশের কম ক্ষতি হবে। কীভাবে কয়লার সর্বোত্তম ব্যবহার করে দেশ ও জনগণের উনড়বতি সাধন করা যায় তার সুষ্পষ্ট স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা দেশবাসীকে জানানো হোক সরকারের কাছে এটাই দাবি করছি।
জ্বালানি হিসেবে কয়লার গুরুত্ব বাড়ছে বিশ্বে জ্বালানির অন্যতম প্রধান উৎস কয়লা। গ্যাস-তেলের মজুদ μমশ ফুরিয়ে আসার ফলে কয়লা আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে কয়লা উত্তোলন করা হয়। সারা বিশ্বে জ্বালানি চাহিদার ২৬.৫ ভাগ মেটানো হয় কয়লা দিয়ে। বিশ্বে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪১.৫ ভাগ আসে কয়লা থেকে। অনেক দেশেই নিজস্ব চাহিদা মেটানোর মত কয়লা মজুদ নেই। তাই তারা বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে। এক হিসেবে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী কয়লার ব্যবহার প্রতিবছর ২-৩% হারে বাড়ছে।ওয়ার্ল্ড কোল ইনস্টিটিউট বলছে আগামী ২০ বছরে কয়লার ব্যবহার ৬০% বাড়বে।
আমাদের দেশে এর গুরুত্ব কি
কুচমা বাদে আমাদের দেশে আবিষ্কৃত কয়লা খনিতে প্রাপ্ত কয়লার মজুদ ৩১৮ কোটি ৭৩ লক্ষ মেট্রিক টন। ভূগর্ভের কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর পাশাপাশি সিমেন্ট কারখানা এবং কয়লা থেকে বিশেষ পঙμিয়ায় মিথেন গ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপন করাও সম্ভব হবে। ফলে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে কয়লার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশে আবিষ্কৃত কয়লা উচ্চমানের বিটুমিনাস বি র্যাংকের কয়লা হিসেবে বিবেচিত। এ কয়লা কোক উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে পারে। ইস্পাত উৎপাদনে এই কোক ব্যবহার করা হয়।
কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি সমূহ
কয়লা স্তরের গভীরতার উপর নির্ভর করে উত্তোলনের বিভিনড়ব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। পদ্ধতিগুলো হলো:
টানেল মাইনিং: মাটিতে সুড়ঙ্গ করে কয়লা স্তরে পৌছানো অতি পুরনো পদ্ধতি।
শ্যাফট মাইনিং: কয়লা স্তর গভীরে থাকলে উপর থেকে ইদাঁরা বা কূপের মত বড় শ্যাফট বসিয়ে তার মাধ্যমে মাটির গভীরে প্রবেশ করে কয়লা আহরণ করা। এ পদ্ধতিতে ২০-৬০% কয়লা তোলা যায়।
ওপেন পিট মাইনিং বা উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি: কয়লা যদি কম গভীরে থাকে তাহলে উপরের মাটি সরিয়ে কয়লা তোলার পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ২০-৯০% কয়লা উত্তোলন করা যায়।
কোল বেড মিথেন: কয়লা স্তর পানি ধারন করে কিন্তু এর মধ্যে ফাঁকা জায়গাও থাকে। এই ফাঁকা জায়গায় পানির চাপে মিথেন গ্যাসও আটকা থাকে। পাইপ পুতে পানি তুলে চাপ হালকা করলে ওই পাইপে মিথেন গ্যাস উঠে আসে। কয়লা স্তর বেশী গভীরে হলে এ পদ্ধতিতে কোল বেড মিথেন তুলে আনা হয়। জাপান ও আমেরিকায় এটি লাভজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ভূগর্ভস্থ কয়লা গ্যাসীয়করণ: মাটির অধিক গভীরে কয়লার স্তর থাকলে কয়লা গ্যাসীকরণ পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়। উপর থেকে কূপের মাধ্যমে কয়লা স্তরে পানি ও বাতাস ঢুকিয়ে উচ্চতাপে (প্রায় ১২০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড) কয়লা পুড়িয়ে গ্যাস তৈরি করা যায়। যা একটি কূপের মাধ্যমে উপরে এনে জ্বালানি হিসেবে বা বিদ্যুৎ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, নিউজিল্যান্ড সহ বহু দেশে পরীক্ষামূলক ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
দেশে দেশে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি বাতিল হচ্ছে আর আমাদের দেশে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে তা চালু করার চμাšও চলছে মাটি, পানি, জীববৈচিত্রসহ সামগ্রিক পরিবেশ এবং জনবসতি, জীবন-জীবিকার উপর উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির যে বিষস্ময় ফল সে সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়ছে। কোন কোন দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতি আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার সীমান্তে উন্মুক্ত কয়লা খনি স্থাপনে বাধা দিয়েছে। আর্জেন্টিনা ও কোস্টারিকা উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পেরুতে সোনা উত্তোলনের কানাডিয় একটি প্রকল্প গণভোটের মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে। ভিয়েতনামে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিকে বিপর্যয়কারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইকুয়েডরেও উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির বিরুদ্ধে নানা মাত্রায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতি চালু আছে সেটা প্রধানত মরু এলাকা বা জনবসতিহীন এলাকা। উন্মুক্ত পদ্ধতি নিয়ে বিশ্বের অভিজ্ঞতা যখন এই পর্যায়ে সেই সময় এশিয়া এনার্জিসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দুর্নীতিবাজ শাসকগোষ্ঠীকে নানাভাবে প্রলোভিত করে বিপুল মুনাফার লোভ দেখিয়ে ফুলবাড়ীসহ বিভিনড়ব বেসিনে তাদের কয়লা উত্তোলনের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন: লাভ কার ক্ষতি কার?
এশিয়া এনার্জির সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী উত্তোলিত কয়লার ৯৪ ভাগ পাবে এশিয়া এনার্জি, বাংলাদেশ পাবে মাত্র ৬ ভাগ। উত্তোলিত কয়লার মধ্যে বছরে ১২ মিলিয়ন টন কয়লা বিদেশে রপ্তানি হয়ে যাবে। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এশিয়া এনার্জির প্রস্তাব অনুযায়ী উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি হলে-১৩৫ বর্গ কিলোমিটার কয়লা খনিসহ আশেপাশের ৬৫৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকার কয়েক লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে, ১০ হাজার দোকান-পাট, ঘর-বাড়ি সরাতে হবে। ৫০ হাজার মানুষকে পুনর্বাসন করতে হবে। ৩ ফসলি উর্বর আবাদি জমি ধ্বংস হবে। গাছপালা, প্রাণবৈচিত্র ধ্বংস হবে। খনি এলাকার আশেপাশের এলাকার নদী-খাল-বিল দুষিত হবে। এই ক্ষতির আর্থিক মূল্য কত হবে তা পরিমাপ করা কঠিন। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী উত্তোলিত কয়লার দাম টন প্রতি ৫০৫০০ ধরলে প্রতিবছর প্রায় ৫২৫০ কোটি হিসেবে ৩০ বছরে ৯৪ ভাগ অনুযায়ী এশিয়া এনার্জি আয় করবে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ৬ ভাগ রয়ালিটি ও ট্যাক্স মিলিয়ে ৩০ বছরে পাবে ৭ মিলিয়ন ডলার বা ৪৬ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ আমরা বছরে পাব ১৫০০ কোটি টাকা। (উপরের হিসাব এশিয়া এনার্জির) উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খননের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় প্রতিবছর কৃষি, মৎস্য, পশুপালন থেকে যে উৎপাদন হয় তার বাজার মূল্য প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা। ফলে বার্ষিক ক্ষতি দাঁড়াবে ৩০০ কোটি টাকা। আর পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট, মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, বিপুল সম্পদ ধ্বংসের হিসাব ধরলে এটা আরও বহুগুন বাড়বে। এত উনড়বয়নের গল্প শুনিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৫০০ কোটি টাকা আয় করতে গিয়ে ক্ষতি ১৮০০ কোটি। ৩০ বছরে নীট ক্ষতি ৯ হাজার কোটি টাকা। দেশের এই বিপুল ক্ষতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল সারা দেশের মানুষ। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট জাতীয় কমিটির আহ্বানে ফুলবাড়ীর সংগ্রামী মানুষ কালো কয়লার জন্য বুকের লাল রক্তে সেদিন এশিয়া এনার্জির অশুভ তৎপরতা রুখে দিয়েছিল। বিডিআরের গুলিতে নিহত হয়েছিল তরিকুল, আমিন ও সালেকিন নামে ৩ কিশোর। আহত হয় দ্ইু শতাধিক। জনগণের রক্তের বিনিময়ে তৎকালীন সরকার বাধ্য হয়েছিল ৬ দফা চুক্তি করতে। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা বিস্ময়ের সাথে দেখছি ফুলবাড়ীর জনগণের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে দেশবাসীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশকে অগ্রাহ্য করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের চμাšও চলছে। বাসদ সহ বামপন্থী প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও জনতাই আন্দোলনকে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে। ফলে জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল জনতার শক্তি বাসদকে শক্তিশালী করুন। বাম পন্থার আন্দোলনকে এগিয়ে নিন। এই আন্দোলনকে আর্থিক ও নৈতিকভাবে সহযোগিতা করুন। জাতীয় কমিটির আহ্বানে আগামী ২৪-৩০
অক্টোবর ২০১০ ঢাকা-দিনাজপুর-ফুলবাড়ী লংমার্চ সফল করুন। বজ্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলুন: