(পুঁজিবাদি শোষনের দুনিয়ায় সব কিছুই আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। ভোগবাদী সংস্কৃতি মানুষকে লাভের লোভে অমানুষের স্তরে নামিয়ে দিচ্ছে। রেহাই পাচ্ছে না কেউ, এমন কি বুদ্ধিজীবীরাও না। হওয়াই স্বভাবিক। কারণ সমাজ বিকাশের বৈপ্লবীক বাস্তবতার সঙ্গে সংঘর্ষিক কোন চেতনা দ্বারা পরিচালিত হলে, তাকে যতই বাহারী পোষাকের মোড়কে আবদ্ধ রাখা হোক না কেন প্রতিক্রিয়াশীলতার দুর্গন্ধ বাতাস ভারি করে পরিবেশকে দুষিত করবেই। হতে পারে সে সচেতন বা অসচেতন ভাবে। অসচেতন ভাবে যারা চিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণে যারা প্রতিক্রিয়াশীলতার শিকার হন তারাও সামাজিক বিভিন্ন আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু যারা সচেতনের দলে এরা ভয়ঙ্কর। এরা বুদ্ধির চর্চা করে শোষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য। প্রচারের দৌড়েও এড়াই এগিয়ে মিডিয়ার বদৌলতে। তাই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী কারা বা তাদের স্বরূপ কি- তা নির্ণয় করাটাই এখন অন্যতম প্রয়োজন হিসাবে সামনে আবির্ভূত হয়েছে। আর এ বিষয়েই অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের একটা লেখা পড়লাম যা আপনাদের সঙ্গে শোয়ার করছি। যেহেতু এটি একটি বিমূর্ত বিষয়, সকলে হয়ত সব বিষয়ে একমত নাও হতে পারেন। তাই সাবার সুচিন্তিত মতামত আশা করছি। আর একটি কথা না বললেই নয়, তাহচ্ছে লেখাটি প্রকাশে লেখকের কোন অনুমতি নেই নাই। কিন্তু তাকে যতদুর জানি বড় হৃদয়ের মানুষ, নিশ্চয় এটা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর এখানে প্রকাশের সমকল ত্র“টি জনিত ভুলের দায়িত্বও আমার।)
১ম পর্বঃ
ইংরেজি ইন্টেলেকচুয়াল শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে বুদ্ধিজীবী শব্দটি চালু হয়ে গেছে। তাই আমি বুদ্ধিজীবী শব্দটিই ব্যবহার করব। যদিও প্রতিশব্দটি আমার খুব একটা পছন্দ নয়। বিনয় ঘোষ ইন্টেলেকচুয়াল-এর বাংলা করেছেন বিদ্বৎজন। আমার পছন্দ হলেও কথাটি তেমন চালু হয়নি। থাক সে-কথা। কে বুদ্ধিজীবী ? বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেকেই ভাবনাচিন্তা করেছেন। বিষয়টি আমারও খুব প্রিয়। ভীষণ আকর্ষণ করে বুদ্ধিজীবী কে-এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে। ২০০০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক মাতৃভূমি পত্রিকায় কাঠামোগত সংকটে বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষক আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। লেখাটি আমার প্রসঙ্গ : শিক্ষা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেই লেখায় প্রসঙ্গক্রমে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে আমার কিছু ভাবনা প্রতিফলিত হয়। সেদিন আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম, শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী কি সমার্থক ? ১৯৭৩ সালে এই একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন বিনয় ঘোষ। উত্তর খুঁজতে তিনি সেদিন ম্যাক্স ওয়েবার, আর্নল্ড টয়েনবি, কার্ল ম্যানহেইম, রবার্ট মিচেল্স প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানী ও পণ্ডিতের ওপর দারুণভাবে নির্ভর করেছিলেন। তাঁদের লেখা থেকে বিপুল পরিমাণে উদ্ধৃতির উল্লেখ করে সেদিন তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে বিদ্বান হলেই বিদ্বৎসমাজভুক্ত হয় না। শিক্ষিত আর বিদ্বৎজন এক নয়। তিনি সেদিন রবার্ট মিচেল্সের কথার উল্লেখ করেছিলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিচারে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা দাঁড় করানোটা ভুল হবে। আমিও সেদিন বিনয় ঘোষের লেখা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছিলাম। তাই আজকের লেখায় আমি তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আমার এই লেখাটি সেদিনের ওই লেখাটিরই সমপ্রসারণ মনে করা যেতে পারে।
১৯৯৩ সালে এডওয়ার্ড সাঈদও হু আর ইন্টেলেকচুয়্যাল (কে বুদ্ধিজীবী) এই প্রশ্ন তুলে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। বইটি যে-কোনো কারণেই হোক আমার দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গিয়েছিল। সমপ্রতি বইটি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়। কয়েকবার পড়ি। এডওয়ার্ড সাঈদও তার সিদ্ধান্তের গোড়া শক্ত করার জন্য নোয়াম চমস্কি, এন্টেনিও গ্রামসি, মাইকেল ফুকো, পিটার নোভিক, রাসেল জ্যাকোবাই, জাঁ পল সার্ত্র, জাঁ জেনে প্রমুখ পন্ডিতের সাহায্য গ্রহণ করেন। আসলে বইটি তাঁর রিথ বক্তৃতা। ১৯৪৮ সালে রিথ বক্তৃতা শুরু করেন বাট্রান্ড রাসেল। তারপর অনেকেই ঐ বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করেন। যেমন রবার্ট ওপেনহাইমার, জন কেনেথ গলব্রেথ, জন সিয়ার্ল। ১৯৯৩ সালে এডওয়ার্ড সাঈদ ওই বক্তৃতাটি দেন। সেই বক্তৃতাটিই রিপ্রেজেন্টেশান অব দ্য ইন্টেলেকচুয়্যাল নামে বইয়ের আকারে প্রকাশ করে ভিনটেজ বুকস এডিশান ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে। সম্ভবত ১৯৯৪ সালে অন্য কোন প্রকাশক বইটি প্রকাশ করেছিল।
প্রথমেই আমি অশিক্ষিত মানুষকে আমার এই লেখার গণ্ডির বাইরে রাখব কারণ এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে বুদ্ধিবৃত্তির সাথে শিক্ষার একটা সংযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলো শিক্ষিত মানুষ তৈরির কারখানা। তবুও প্রশ্ন ওঠে, যাঁরা ওইসব উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র থেকে উচ্চতম ডিগ্রির ছাপ নিয়ে বের হন, তারা সবাই কি বুদ্ধিজীবী? তারা সবাই শিক্ষিত, হয়ত এ-কথা মিথ্যা নয়। কিন' বিণয় ঘোষ, এডওয়ার্ড সাঈদের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে আমিও বিশ্বাস করি যে তারা সবাই বুদ্ধিজীবী নন। তাহলে? বুদ্ধিজীবী কারা? কী বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা? যে-সংজ্ঞাভুক্ত না হলে শিক্ষিত হয়েও অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তিই বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না? যাঁরা শিক্ষিত কিন' বুদ্ধিজীবী নন, বিনয় ঘোষ সেদিন কৌতুকপূর্ণ ভাষায় তাদের নির্মমভাবে কশাঘাত করেছিলেন। তার সে-লেখায় কলকাতার শিক্ষিত মহলে ঝড় উঠেছিল। এডওয়ার্ড সাঈদও একই সিদ্ধানে- পৌঁছেছেন সামান্য একটু মার্জিত ভাষায়। তাই এডওয়ার্ড সাঈদের পাশাপাশি বিনয় ঘোষের উদ্ধৃতি উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করা বেশ কষ্টকর।
যেমন কে বুদ্ধিজীবী?- এই প্রশ্নের উত্তরে সাঈদ প্রথমেই বলেন, একজন বুদ্ধিজীবী সেই মানুষ সমাজে যার বিশেষ ভূমিকা আছে। তিনি কোন নামগোত্রহীন পেশাজীবী নন, যিনি সমাজের একজন সদস্য হিসেবে প্রতিদিন তাঁর বাঁধাধরা কাজে যান আর আসেন। এরপরই তিনি বলেন, ব্যক্তিগত বুদ্ধিজীবী বলতে কিছু নেই। যেই মুহূর্তে তুমি কিছু একটা রচনা করলে এবং তা প্রকাশ করলে সেই মুহূর্ত থেকেই তুমি একটি গণমানুষের জগতে পা রাখলে। বর্তমানের এই রমরমা প্রাইভেটাইজেশন-এর যুগে বুদ্ধিজীবীদের প্রাইভেটাইজেশন সম্ভব নয়। কারণ, সাঈদের মতে, বুদ্ধিজীবীদের কর্মতৎপরতার প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের স্বাধীনতা ও তার জ্ঞানের সমপ্রসারণ। যেসব বুদ্ধিজীবী দাবি করেন যে তারা কেবল তার নিজের জন্য লেখেন কিংবা খাঁটি জ্ঞানচর্চা বা বিমূর্ত বিজ্ঞানের জন্য কাজ করেন, তাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করা যায় না। বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত লেখক জাঁ জেনে একবার বলেছিলেন বলে সাঈদ জানান যে, সমাজে যখনই তুমি একটা প্রবন্ধ বা লেখা প্রকাশ করো, তখনই তুমি রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করো। সুতরাং তুমি যদি নিজেকে রাজনৈতিক বলে প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রসত্ম হও, তাহলে কোনো প্রবন্ধ লিখো না কিংবা কথা বলো না। বিনয় ঘোষও বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বের কথা বলতে গিয়ে ম্যানহেইমের উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছিলেন। প্রত্যেক সমাজে নানা গোষ্ঠীভূক্ত এমন কিছু লোক থাকেন, যাঁদের কাজ হলো সেই সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি রচনা করা বা ব্যাখ্যা করা। যারা সমাজের এই জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করেন তারাই বিদ্বৎসমাজের অন্তর্ভূক্ত হবার যোগ্য। তারাই প্রকৃত বিদ্বৎজন-ইন্টেলেকচুয়্যাল।
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে বুদ্ধিজীবীরা তা-ই করছেন। এমনকি লিখিত ইতিহাস শুরুর আগে যারা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে পূজো করার জন্য সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তারাও সে-সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যেই পড়েন। কিন্তু সমাজ ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা পরিবর্তিত না হলেও তাদের কাজের ধারার পরিবর্তন হয়। ম্যানহেইম, মিচেল্স ও সাঈদের সংজ্ঞায় একজন ধর্মবেত্তাও বুদ্ধিজীবী। কারণ তাঁরাও একসময় সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি রচনা করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরাও সেদিন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও মানুষের জন্মের নানা তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। আজ তার অধিকাংশই আমাদের কাছে পরিত্যাজ্য মনে হলেও তাদের সময়ে মানুষ সেগুলো সরল মনে বিশ্বাস করত। জ্ঞানের সমপ্রসারণের সাথে সাথে তাঁদের অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং অনেক তত্ত্বই আজ ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সামন-যুগের বুদ্ধিজীবীরাও একই কাজে লিপ্ত ছিলেন। তাদের কাজের ধারা ছিল সেদিনের সমাজ সংগঠনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেদিন তারা ছিলেন রাজা-বাদশাহদের আশ্রিত বুদ্ধিজীবী। দরবারাশ্রিত। তারা ছিলেন রাজ-দরবারের অলংকার বিশেষ। জনগণের সঙ্গে তাদের সামান্যতম যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তাদের কাজও মানুষের স্বাধীনতা ও জ্ঞানের সীমানা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। সুতরাং সামন-যুগে তাঁরাই ছিলেন বুদ্ধিজীবী।
চলেব..............
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:১১