বর্তমান বিশ্বে গ্রীক মিথলজী বা পুরাণশাস্ত্র তথা পৌরানিক কাহিনীগুলোর কিছু বাস্তব নিদর্শন পাওয়া যায়। আর এই নিদর্শন বা বাস্তবতার সাথে মিলে যাওয়া কাহিনীগুলোই মানুষকে নতু্ন করে ভাবতে শেখায় হাজার বছর পূর্বে বিলিন হয়ে যাওয়া পৌরানিক বিষয়গুলো নিয়ে। এটাই হলো গ্রিক মিথলজীর সবচেয়ে মজার দিক এবং এর ফলেই এই মিথলজীগুলো নিয়ে বর্তমানে গবেষনাধর্মী কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। এমনি কিছু অবাক করা সত্য এই পর্বে জানতে পারবো।
(প্রথম পর্বের পর থেকে)
জিউস গুহার মধ্যেই তেজী হয়ে উঠে এবং নিজেকে শৈশব থেকেই তৈরি করে নেয় তার স্ব-নির্ধারণ গন্তব্যে পৌছানোর জন্য। সময়টা ছিলো তার কাছে অনেকটা ট্রেনিং প্রিওডের মত, যেখানে সে ছিল তার পিতা ক্রুনাসের দৃষ্টিসীমার বাহিরে। জিউস গুহা থেকে বেরিয়ে এলো একজন পূর্ণবিকশিত গড হিসেবে। জিউস প্রস্তুত মহাকাব্যিক শক্তি নিয়ে তার সৈরাচারী পিতা এবং দানবদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, পাঁচ অলিম্পিয়ানস সহোদর মুক্ত করার জন্য তার পিতার পেট থেকে এবং দানবদের হাত থেকে মহাবিশ্বের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য।
চূড়ান্ত কিছু ঘটতে যাচ্ছে। অবিসম্ভাবিভাবে এর দুটো ফলাফল আসন্ন এবং এর মাঝের ব্যবধান বিশাল। যদি জিউস বিজয়ী হয় তাহলে সে-ই মহাবিশ্বের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আর যদি তার পরাজিয় ঘটে সে নিক্ষিপ্ত হবে নরকে (টারট্রাস/Tartarus )। টারট্রাস- নরকের সর্বনিম্ন স্তর। প্রকৃতপক্ষে টারট্রাস হলো নরকের একটা অংশ যেখানে নিক্ষেপ করা হতো তাদেরকে যারা অশুভ বা গডদের বিরুদ্ধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জিউস যদি তার পিতা ক্রনাসের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধে পরাজিত হয় অথবা ক্রুনাস বা দানবদের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে আনতে ব্যার্থ হয় তবে সেও অনন্তকালের জন্য এই নরকে নিক্ষিপ্ত হবে। আর যদি সে বিজয়ী হয় তবে সে মানুষ এবং গডদের নিয়ন্ত্রণ করবে মাউন্ট অলিম্পাসের শীর্ষস্থান থেকে।
গ্রীক পুরাণশাস্ত্র অনুযায়ী মাউন্ট অলিম্পাস (Mount Olympus) হলো গডদের পারিবারিক বাসস্থান এবং এটা ছিল প্রচন্ড আকৃতির এবং বিশাল উঁচু। কিন্তু এর একটি বাস্তব উপলক্ষ বা প্রমাণ পাওয়া যায়। মাউন্ট ওলিম্পাস হলো বর্তমান গ্রীসের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দশ হাজার ফিট উপরে। এবং এটি প্রাকৃতিকভাবেই স্থাপিত ছিলো অতিপ্রকৃত প্রাকৃতিক শক্তি জন্য (হায়রে বাংলা অনুবাদ..:-| (supernatural natural power)। প্রাচীন গ্রীক-রা বিশ্বাস করতো তাদের গডরা মাউন্ট অলিম্পাসে শারিরিকভাবেই বসবাস করতো। তাই তাদের কাছে সেই স্থানটা অতিগুরুত্বপূর্ণ ছিল যা ছিল স্বর্গ বা গডদের আবাসস্থল।
গ্রীসের সবচেয়ে উঁচু পর্বত মাউন্ট অলিম্পাসের বর্তমান ছবি-
জিউস বাকি গডদের সাহার্য্য কামনা করছিল যারা ক্রুনাস দ্বারা বৈষম্যের শিকার হয়েছিলো। শুরু হতে যাচ্ছে চূড়ান্ত গৃহবিবাদ। এবং এটা হতে যাচ্ছে নিজের রক্ত মাংশের বিরুদ্ধে যা জিউস প্রথমে শুরু করতে যাচ্ছে। জিউস জানে তার শক্তিশালী সঙ্ঘ হবে তার পাঁচ সহোদর। অলেম্পিয়ানস- যারা এখন নত্তজোয়ান। তবে এখনো বন্ধি হয়ে আছে ক্রুনাসের পেটের গভীরে। যদি তাদের মুক্ত করা যায় তবে অলেম্পিয়ানস-রা বিরাট শক্তি নিয়ে জিউসের পক্ষে অবস্থান নিতে পারবে এবং তাকে সাহার্য্য করবে দানবদের চিরকালের জন্য নিঃশেষ করে দিতে। জিউস তার সহোদরদের মু্ক্ত করতে চাইলো এবং অতি সূক্ষভাবে ক্রুনাসের রক্তের পেয়ালায় বিষ মিসিয়ে দিলো। ক্রুনাস তা পান করলো এবং অতিমাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ো। সে ছটফট করতে লাগলো এবং সর্বপ্রথম তার পেট থেকে বেরিয়ে এলো সেই পাথর যা সে জিউসের পরিবর্তে গিলেছিলো।
কোনাকৃতির পাথরটি ঐতিহ্যঅনুসারে রাখা হয় প্রাচীন গ্রিকের সবচেয়ে গোপনীয় স্থান- ডেল্ফী মন্দিরে (The Temple of Delphi ) । ডেল্ফী মন্দির হলো গ্রিসের পবিত্র/ উপাসনার স্থান যেখানে মানুষ আসতো ঈশ্বরের সঙ্গে পরামর্শ করতে। এটা ছিলো স্বর্গের সাথে সরাসরি ফোনলাইন যাতে করে যে কোন প্রশ্ন করা যায়।
হাজার বছর পুরানো পৌরানিক কাহিনির সেই কোনাকৃতির পাথর যা ক্রুনাস গিলেছিল বলে ধারনা করা হয় এই মন্দিরে তার দেখা পাওয়া যায়। মন্দির কমপ্লেক্সের প্রায় মাঝামাঝিতে এই পাথরটি দেখা যায়। এবং কেউ যদি বর্তমান সময়ে সেখানে যায় দেখা যাবে স্থানীয় মানুষজন এটাকে সেই প্রকৃত পাথর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে যা ক্রুনাস জিউসের পরিবর্তে গিলেছিল।
পুরাণশাস্ত্র অনুযায়ী প্রচন্ড ব্যাথায় প্রথম পাথরটি বের হওয়ার পর ক্রুনাস জিউসের বাকি সহোদরদেও পেট থেকে বের করতে বাধ্য হয়। এবং তারা সবাই প্রস্তুত হয় জিউসের মহাবিপ্লবে অংশ নিতে। প্রবল বুদ্ধিমত্তা বা বিচক্ষণতা জিউসের চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ যা প্রশংসার দাবি রাখে। সে তার চারপাশের সকলকে রাজি করতে সক্ষম হয় যে তার-ই দলপতি হউয়া উচিৎ এবং সে গডদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরীতে সক্ষম হয়।
জিউসের পক্ষে তার সব সহোদর গড-রা কিন্তু দানবদের বিরুদ্ধে লড়ায়ে তার আরো শক্তি প্রয়োজন- তার পরিবারের অদ্ভুত সদস্যরা যারা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। ক্রুনাসের স্মরণাতীত সহোদর, সাইক্লোন্স (cyclone) এবং শত হাতওয়ালা দানব (hundred handers)। কিন্তু তাদের সন্ধান পাওয়ার জন্য জিউসকে নরকে যেতে হয়। জিউস নরকে পৌঁছে শত হাতওয়ালা দানব- এর সামনে গেল এবং বললো- আমি তোমাকে সম্মান দেব। আমি জানি আমার পিতা ক্রুনাস তোমার প্রতি অন্যায় করেছে এবং আমি তোমাদের মুক্ত করতে এসেছি। দানব-রা জবাব দেয়- হ্যাঁ মহান জিউস আমরা বুঝতে পারি, শুধুমাত্র এইজন্য নয় যে আপনি শক্তিধর হয়ে উঠছেন, এইজন্যই যে আপনি জানেন কিভাবে মানুষের সাথে ভালো আচরণ করতে হয়। আমরা এতে অনুপ্রাণীত হয়েছি এবং আমরা আপনার পক্ষেই যুদ্ধ করবো। মুক্ত সাইক্লোন গর্বিত হয়ে জিউসকে উপহার দিলো বজ্রের শক্তি। প্রকৃতির এক মহাবিধ্বংসী অস্র হলো বজ্রপাত এবং এটাই মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যথেষ্ট।
বজ্রের শক্তি এতটাই প্রোকট যে তা যখন বায়ুর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন বায়ুর তাপমাত্রা পঞ্চাশ হাজার ডিগ্রির অধিকে চলে যায় যা ভূপৃষ্টে সূর্যের তাপমাত্রার চেয়ে পাঁচ টন ডিগ্রির ও অধিক।
রণকৌশল নির্ধারিত হলো। দানব-রা যুদ্ধ করবে মাউন্ট অথ্রেস এবং অলেম্পিয়ান্সরা মাউন্ট অলিম্পাস থেকে। এই দুই পর্বতের মধ্যখানে সমতল জায়গা (plain of Thessaly )। তবে এটা কেবল এটা পৌরাণিক/ কাল্পনিক যুদ্ধক্ষেত্র। কিন্তু আধুনিক গ্রিস মানচিত্রে দেখা যায় যে থেসলি সমতল ভূমি গ্রিসের কেন্দ্রে অবস্থান করে। এবং প্রাচীন সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এটাই গ্রিসের বৃহত্তম এবং অতি উর্ভর সমতল ভূমি। থেসলি- সমতল ভূমির আছে বিশাল রক্তাক্ত ইতিহাস। বি.সি পঞ্চম শতাব্দির Garcal Percheron War থেকে শুরু করে এ.ডি বিংশ শতাব্দির বিশ্বযুদ্ধের রণভূমির সাক্ষী হয়ে আছে এই থেসলি।
পিতা এবং পুত্রের যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে দিবে কে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। মাউন্ট অলিম্পাসের চূড়া থেকে জিউস বজ্রপাত/ বিজলী বর্ষণ করতে লাগলো তার পিতার সৈন্যদের উপর। এ যেন মহাবিশ্বের সকল শক্তি বিপরীত প্রান্ত থেকে ছুটে নির্দিষ্ট স্থানে (থেসলি) এসে বিকট শব্দে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে শত হাতওয়ালা দানব-রা ক্রমাগত পাহাড়সম পাথর ছুড়েছে অন্যদিকে এসব প্রতিহত করতে ব্যস্ত দানবরা ক্রমাগত পিছু হঠছে। চলছে গডদের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের কাহিনী পুরটাই পুরাকথা বা কল্পকাহিনী নয়।
বিশেষজ্ঞরা সাম্প্রতিককালে খুঁজে বের করেছেন যে প্রাচীন গ্রিসে একটা প্রাসঙ্গিক ন্যায়বিচার যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছেলো। প্রায় ছত্রিশ-শত (৩৬০০) বছর পূর্বে ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী আগ্নেয় বিস্ফোরণের মুখোমুখি হয়েছিলো গ্রীক দ্বীপ সান্তরিনি (Greek Island of Santorini )। এর প্রভাব বা ধ্বংশযোগ্য এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ক্যালিফোরনিয়ার দ্বীপেগুলোতেও তা আঘাত হানে। এই আগ্নেয় বিস্ফোরণ পৃথিবীতে সাতাশ হাজার বছরের মধ্যে একক সর্ববৃহৎ আগ্নেয় বিস্ফোরণ। কতটা বিপুল ধ্বংসযোগ্য ছিলো বিষয়টা তা অনুমান করা যায় একটি বিষয় দিয়ে যেমন- একটা সাড়ে তিন কিলোমিটার উঁচু পাহাড় মুহূর্তের ধ্বংশ হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। ২০০৬ সাথে বিজ্ঞানীরা আরো আবিষ্কার করলো যে এই ধ্বংযোগ্য আরো বিশাল ছিলো যতটানা ধারণা করা হয়।
পুরাণশাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে, জিউস একসময় তার গন্তব্যের দারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। তার শক্তিশালী সঙ্ঘ ভারসাম্য রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং অলেম্পিয়ান্সরা বিজয়ের দারপ্রান্তে চলে যায়। কিন্তু দানব-দের শেষ হাতিয়ার এখনো রয়ে গেছে। নরকের (টারট্রাস) এর গভীর থেকে তারা প্রকাণ্ড এক জন্তু তুলে আনলো- ঠাইফান।
ঠাইফাস মারাত্নক শক্তিশালী জন্তু ছিলো এবং জিউস নিজেই একে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটাই ছিলো তার চূড়ান্ত মোকাবিলা এবং বিষয়টা জিউসের কাছে ততটা সহজ ছিলো না। এটা ছিলো অনেকটা অতিপ্রাকৃত মৃত্যুর খেলা (supernatural death match)। এবং সবকিছুই হার মানে জিউসের বজ্রের শক্তির কাছে। জিউর ক্রমাগত বজ্র নিক্ষপ করতে থাকে এবং ঠাইফান দূর্বল হতে থাকে। মহাকাব্যিক যুদ্ধের অবসান হয়। ঠাইফান এবং দানবরা নরকের (Tartarus) দিকে ধাবিত হয়। যেখানে তারা অনন্তকালের জন্য অগ্নিদগ্ধ হবে।
পুরাণশাস্ত্র অনুযায়ী, এটা ছিল ইতালি বৃহত্তম ভূমধ্য সাগরীয় দ্বীপ- সিসিলি (Island of Sicily) যেখানে জিউসের শত্রুদের নরকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল মাউন্ড এটনা-র আগ্নেয়গিরির প্রবেশ পথ দিয়ে (http://geology.com/volcanoes/etna/' target='_blank' >Mount Etna ) স্থানীয় কিংবদন্তীরা বিশ্বাস করেন ঠাইফাস এখনো এই পর্বতের ভেতর অবস্থান করছে এবং বিগত শতকজুড়ে সকল আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণ বা অগ্ন্যুত্পাতের জন্য সেই দায়ী। আগ্নেয়গিরির লাভা বা অগ্ন্যুত্পাতের কারণ হিসেবেই গ্রীকরা এই মিথ ব্যবহার করে ব্যবহার করে থাকে। তারা এর কারণ ব্যাক্ষা করে, জিউসের হাজার পছর পূর্বে নিক্ষিপ্ত বজ্র ঐ পর্বতের ভেতর থেকে এখনো আঘাত হানছে অথবা ঠাইফান-এর আগ্নেয়শক্তি দূর্বল হয়ে এখনো কিছুটা জীবত আছে এবং তা কখনো কখনো বড় ধরনের আগ্নেয় বিস্ফোরণ বেরিয়ে আসছে। এটিও বিশ্বাস করা হয় যে ঘূর্ণিঝড়ের কারণও এই ঠাইফান। এবং তার নামানুসারেই এর নাম রাখা হয়েছে টাইফুন (typhoon/ঘূর্ণিঝড়)।
গত কিছুদিন আগেও (৬ই আগষ্ট ২০১১) চীনে টাইফুন আঘাত হানার আশঙ্কায় পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ২ লাখের বেশি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গ্রীক মিথলজিতে বিশ্বাসীরা হয়তো ভাবছে- ঠাইফান আবার গর্জে উঠছে।
.
.
.
.
.
.
(চলবে)
প্রথম পর্ব
Greek Mythology
Tartarus/নরক
মাউন্ট ওলিম্পাস (Mount Olympus)
ডেল্ফী মন্দির/ The Temple of Delphi
থেসলি সমতল ভূমি/ Plain of Thessaly
গ্রীক দ্বীপ সান্তরিনি / Greek Island of Santorini
ভূমধ্য সাগরীয় দ্বীপ- সিসিলি/ Island of Sicily
মাউন্ড এটনা/ Mount Etna
চীনে টাইফুন আঘাত হানার আশঙ্কা