আগামীকাল ২৪ এপ্রিল! সাভারের সেই ভয়াবহ রানা প্লাজা ধ্বসের তিন বছর!
বিবিসির সকালের বাংলা অধিবেশন শুনছিলাম। সাভার উপশহরের রেজিয়া! ৫ তলায় ফ্যান্টমের কর্মী ছিলেন। ভবনটা যখন ভেঙ্গে পড়ে, দৌড়ও দিয়েছিলেন। কিন্তু একটা পা বাঁচাতে পারেননি। বাকিটা তার মুখে শুনি!
‘বীম ভেঙ্গে পড়ে পায়ের উপর। চিকিৎসা নিয়েছি। ডাক্তার পা’টা কেটে ফেলতে বলেছিলো। স্বামী কাটতে দেয়নি, বলেছে, এই ভাঙ্গা পা নিয়েই থাকবা। তবু পা ছাড়া নয়। পায়ের ব্যথা সারেনি। সেই অকেজো পা এখন সবচেয়ে বড় শক্রু। ঝুলে থাকা পা নিয়ে কিছুই করতে পারিনা। স্বামীই রান্না করে। যখন স্বামী কাজে থাকে, নয় বছরের শিশুকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। গোসল করা, বাথরুমে যাওয়া- এসব কাজের জন্য ওই নয় বছরের শিশুটাই ভরসা!” - রানা প্লাজা ধ্বস, রেজিয়ার মতো অসংখ্য নারী- পুরুষের যন্ত্রণার গল্প দিয়ে গেছে আমাদের। কিন্তু ঘটনার তিন বছর পরে এসে যদি ফিরে দেখি, কী দেখি? কিছু কী বদলালো?
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার শহরে ‘রানা প্লাজা’ নামের ভবনটি ভেঙ্গে পড়ে। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই ভবন ধ্বসে ১১৩৫ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো। আহতের সংখ্যা ছিল ২৫০০। পরে বিজিএমইএ নিশ্চিত করেছে ধ্বসের সময় ভবনটিতে মোট ৫টি কারখানার কার্যক্রম চলছিলো। যেখানে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৯০০! ভবনটি ভেঙ্গে পড়ার পর সরকারের সকল স্তরের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা স্বত্তেও ২১ দিন লেগেছিলো অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করতে! কিন্তু তারপর তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এই তিন বছরে পোষাক খাতে সুশাসন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা, আইন মেনে ভবন নির্মাণ- এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কী কোন অগ্রগতি হলো? একটু ফিরে দেখা যাক:
ভবনটি বানানোর সময় কোন ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ৫ তলা ভবনের অনুমতি নিয়ে ৮ তলা বানানো হয়েছে। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রযেছে, বাণিজ্যিক ভবনকে কারখানা হিসেবে ব্যবহার, উপরের দিকের তলাগুলোতে ভারি মেশিন স্থাপন, খুবই নিম্ন মানের নির্মাণ উপাদান ব্যবহার। সেই পরিস্থিতি কী এখনো চলছেনা?
ঘটনার মূল হোতা সোহেল রানার বিচার এখনো শুরুই করেনি। যদিও বহু আগে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
সারা দুনিয়ার পোশাক শিল্পের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো একসাথে কাজ শুরু করলেও, অগ্নি নির্বাপন, ভবনের নিরাপত্তা, শ্রমিক নিরাপত্তা বিষয়ের কোন অগ্রগতি হয়নি।
শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫০০০ (৬৮ ডলার) করা হয়েছে। এটা এখনো প্রতিযোগিতামূলক বাজারের তুলনায় অনেক কম। চিনে একই রকমের কাজের জন্য একজন শ্রমিক পান ২৫০ ডলার।
রানা প্লাজা ধ্বসের পর, ভবনগুলোর ঝুঁকি নিরূপণে কিছু উদ্যোগ শুরু হয়েছিলো।শ’পাঁচেক ভবনের প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও এর পর সব মুখ থুবড়ে পড়েছে।
রানা প্লাজা দেখিয়েছে, বড়সড় ভবন ধ্বসে উদ্ধার কার্যক্রমে আমাদের কী সীমাহীন দূর্বলতা! অথচ সেই বিষয়ক কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
রানা প্লাজার পর নগর স্বেচ্ছাসেবক ধারণা বড় করে সামনে এসেছিল। অথচ তার অগ্রগতি, তাদের প্রশিক্ষণ এবং সেসব স্বেচ্ছাসেবককে মূল ধারায় নিয়ে আসার বিষয়ে কোন উদ্যোগ নাই।
রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ পায়নি। ২০০ পরিবার দাবি করছে তাদের স্বজনদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সে ব্যাপারে কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
রানা প্লাজা ধ্বস আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছে, ভবন ধ্বসের মতো দুর্যোগে আমরা কতটা বিপদাপন্ন। এরই মধ্যে এই অঞ্চলে বড়সড় ভূমিকম্প হয়ে গেছে। আমাদের ঘুম কিন্তু ভাঙেনি, বরং বাহাস আছে। ভবন আইন বাস্তবায়নের তোয়াক্কা করছিনা আমরা! বরং সরকার বলছে আমরা যে কান ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত!
রানা প্লাজা ছিল জেগে ওঠার ডাক। সে ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙেনি। এর পর আরো বড় দূর্ঘটনার সব দায় কিন্তু আমাদেরই।