আজ বলা যাক আন্দামানের এক অপ্রকাশিত ইতিহাসের কথা।১৯৮৪ সালের ৫ই অক্টোবর। অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে সরকারি নিয়োগপত্র হাতে নিয়ে আমি পৌঁছই, উত্তর আন্দামানের প্রধান জনপদ ডিগলিপুর থেকে ১৯-২০ কিলোমিটারের দুর্গম পথ পেরিয়ে, তালবাগান গ্রামটিতে। ঠিক সেই মুহূর্তে কোনও তথাকথিত স্কুল সেখানে ছিল না। দেশভাগের পর পূর্ব-পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশ) যাঁদের ঠাঁই হ'ল না, সেইসব অসহায় 'সর্বহারা' পরিবার শুধু বাঁচার তাগিদে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এই বিপদসঙ্কুল জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিলেন। কঠোর পরিশ্রমে তাঁরা গ'ড়ে তুলেছিলেন সুজরা-সুফলা-শস্যশ্যামলা গ্রাম।
যা-ই হোক,স্থানীয় গির্জাঘরে প্রাথমিকভাবে লেখাপড়া শুরু হ'ল।গ্রামবাসী সকলেই বাঙালি,তাই শিক্ষাও বাংলা মাধ্যমে। কয়েক মাসের মধ্যে গ্রামবাসীদের অসীম আগ্রহ ও অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হ'ল স্কুলঘর,খেলার মাঠ,নাটমন্দির,শিক্ষকাবাস। স্কুলের উৎসব আর নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না।শুধু তালবাগানই নয়,পার্শ্ববর্তী 'পশ্চিমসাগর' গ্রামে স্কুল-পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও যোগ দিত উৎসবে।আমার বেশ মনে আছে ১৯৮৫ সালের বার্ষিক উৎসবে (ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান) গ্রামের সমস্ত মানুষ একত্রিত হয়ে আয়োজন করেছিলেন সারাদিন ব্যাপী পংক্তিভোজনের আর তাতে যোগ দিয়েছিলেন তিনটি গ্রাম(তালবাগান,পশ্চিমসাগর ও কিশোরনিগর)-এর অগণিত মানুষ। সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর প্রায় সারারাত ধ'রে চলেছিল যাত্রানুষ্ঠান।সভ্যতার আধুনিক আলো যেখানে পৌঁছয়নি,সেই দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করা মানুষের জীবনযাত্রার মঙ্গলধ্বণি আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়।
একদিন সরকারি নিয়মের পথ ধ'রে আমাকে ফিরতে হ'ল পুরনো ঠিকানায়। জীবনের পথ পরিক্রমা করতে করতে ২০০৩ নাগাদ হঠাৎ কোনও একদিন শোনা গেল উদ্বাস্তু বাঙালিদের বাড়িঘর,বাগান,ফসল ইত্যাদি সরকারি ফরমানে ধ্বংস করা হয়েছে। তখনও আমার শ্রুতিগোচর হয়নি যে সেই সবুজ পাহাড়ের দেশে বনবিভাগের হাতির সাহায্যে ভয় দেখিয়ে মহিলা ও শিশুদের ঘরছাড়া করা হয়েছিল, অত্যাচার চালানো হয়েছিল তাঁদের উপর।বনবিভাগের জমি-অধিগ্রহণের অপরাধে পাকা ধানের ক্ষেতে চালানো হয়েছিল বুলডোজার।বিশ্বস্তসুত্রে জানা গিয়েছিল,একটি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা একজন অ-বাঙালি নেতা ‘বাঙালি’ পরিচয় দিয়ে,উচ্চতম আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে,অনেক গুরূত্বপূর্ণ রিপোর্টকে অবমাননা ক’রে বেসরকারিভাবে বসতি স্থাপন করা উদ্বাস্তু বাঙালিদের বাড়িঘর,নারিকেল-সুপারির বাগান সুফলা শস্যক্ষেত ইত্যাদি ধ্বংস করেছেন। অথচ,পরে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল উচ্চতম আদালতের এ ধরণের কোনও আদেশই ছিল না।
তথাকথিত ‘জননায়ক’টির পরিচয় দিতে গিয়ে আন্দামানের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেছেন- ‘এই নেতার আসল পরিচয় আন্দামান-নিকোবরের মানুষজন এখনও জানেন না।অথচ কলুর বলদের মতো তাঁকে সমর্থন করেন।পোর্টব্লেয়ারের সত্তর শতাংশ জমি বে-আইনীভাবে বহিরাগত আগন্তুকদের দখলে;অথচ বাঙালি স্বার্থ-বিরোধীদের তা’ চোখে পড়ে না।’
প্রশ্ন জাগে, যে ছিন্নমূল বাঙালিরা এক লক্ষ দু:খ-কষ্ট সহ্য ক’রে এই দ্বীপপুঞ্জকে সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা ক’রে তুলেছিলেন তাঁরাই আজ তথাকথিত জননেতাদের বিরক্তির কারণ কেন,কেন তাঁরা চক্ষুশূল? একটা কথা এখানে পরিষ্কার করা যাক।এই দ্বীপপুঞ্জে বাঙালি-বিরোধী কালপুরুষগুলোকে আমরা চিহ্নিত করব-ই।
বাঙালি-বিদ্বেষী আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই,সংক্ষেপে। ৯০-এ দশকে দক্ষিণ আন্দামানের ওয়ান্ডুর স্কুল প্রাঙ্গণে কোনও এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের জনসভা চলাকালীন একটা প্রচারপত্র (হ্যান্ডবিল) আমার হতে আসে। সেই প্রচারপত্রে ছাপা যে কয়েকটি দাবি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাখা হয়েছিল,তার মধ্যে অন্যতম একটি দাবি ছিল---‘বাংলাদেশ থেকে আগত অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের চিহ্নিত ক’রে সে দেশে ফেরত পাঠাতে হবে।’ এটি পাঠ ক’রে আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলাম;- ‘অনুপ্রবেশের দায় তাহলে শুধু মুসলমানের,হিন্দুর নয়?অনুপ্রবেশ নি:সন্দেহে একটি বে-আইনী কাজ, তবে তার দায় চাপাতে শুধু মুসলমানদের আলাদা ক’রে চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া কেন? উত্তরে নেতাপ্রবরের মুখ থেকে যে ‘অমৃতবাণী’ নি:সৃত হয়েছিল,তা মনুষ্যজনোচিত ছিল না,তাই এখানে তা’ অনুল্লেখ্য।
শুধু আন্দামানেই কেন,এই সময়ে সর্বস্তরে বাংলা ও বাঙালি-বিরোধী যে প্রেতচ্ছায়া আচ্ছন্ন ক’রে রেখেছে কিছু মানুষের শুভ চেতনাকে,তার বিরুদ্ধে আজ ‘একত্রিত হোক আমাদের সংহতি’। নানা জাতি,নানা ভাষা,নানা মত,নানা পরিধানের মাঝে আমরাও যেন আমাদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব-র মর্যাদা বজায় রাখতে পারি,এই হোক আমাদের সঙ্কল্প।