আন্দামান থেকে বলছি: প্রথম পর্ব
গত শতাব্দী’র নয়ের দশক থেকেই ভাবছিলাম আন্দামান সম্পর্কিত স্বীয় অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করব, কিন্তু নানা কারণে তা হয়ে উঠতে পারেনি। ইতিমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি সূত্রে প্রাপ্ত আন্দামান সম্পর্কিত তথ্যসমৃদ্ধ অনেক বইপত্র পড়ার সুযোগ আমার আমার হয়েছে। কিন্তু সেসব লেখার মধ্যে তেমনভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি রূপসী আন্দামানের অপরূপ সৌন্দর্য ও করুণ ইতিহাস। ঘন নীল সমুদ্র-ঘেরা, সবুজ পাহাড়ে সাজানো নিবিড় বনভূমির সংমিশ্রণে এ যেন এক অজানা রূপকথার দেশ। যতই দেখি,এর মধ্যে ততই রহস্যাবৃত,পুঞ্জীভূত অরূপরতনের সন্ধান পাই।
আন্দামানে দুটি মাত্র মহাবিদ্যালয়,তাও আবার পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। একসময় পোর্টব্লেয়ার-স্থিত মহাবিদ্যালয়টিতে বাংলা-বিমুখ চক্রান্তকারীদের কূটকৌশলে বাংলা ভাষা বিতাড়নের অভিসন্ধি চলছিল। ব্যাপারটি যখন আমার গোচরে আসে, আমি কলম ধরতে বাধ্য হই। তীব্র প্রতিবাদ নিয়ে প্রকাশিত হয় আমার ‘মাতৃভাষা’-শীর্ষক প্রবন্ধটি,একাধিক স্থানীয় কাগজে। মনে পড়ে, ‘বাকপ্রতিমা’-র সম্পাদকীয়তে সেটিকে ‘অত্যন্ত সংবেদশীল লেখা’ বলে ইতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছিল। লেখাটি পাঠ করে খুব জোরালো সমর্থন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন আলোচ্য মহাবিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা-বিভাগীয় প্রধান ড: অবনী সিংহ মহাশয়।
৫৭২ টি ছোটবড় দ্বীপ ও প্রস্তরখন্ড’র সমাহারে গঠিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ,যার ক্ষেত্রফল ৮,২৪৯ বর্গ কিলোমিটার। ২০০১ খৃস্টাব্দ’র জনগণনানুসারে ৩.৫৬ লক্ষ মানুষের বসবাস এই দ্বীপপুঞ্জে,যার মধ্যে কমবেশি সত্তর হাজার জন মানুষ উপভোগ করেছে তার নির্মল মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য। দ্বীপপুঞ্জ’র প্রাণকেন্দ্র পোর্টব্লেয়ারে রয়েছে অগ্নিযুগের বীর সন্তানদের পদধূলি-ধন্য সেলুলার জেল, যার কালকুঠুরিতে কান পাতলে আজও হয়তো শোনা যায় উল্লাসকর দত্ত’র মতো বহু স্বাধীনতা-সংগ্রামীর মর্মভেদী চিৎকার। তাঁদের বিদেহী আত্মার আকুল আহ্বান,করুণ দীর্ঘশ্বাস আজও আমি অনুভব করি হৃদয় দিয়ে। প্রতিটি সন্ধ্যায়,ধ্বনি ও আলোর কুহেলীমায়া প্রতিটি দর্শক-শ্রোতাকে করে তোলে বেদনাহত ও আবেগমথিত।
প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটারের ভৌগোলিক দূরত্ব থাকলেও, বাংলা ভাষার মুখ্য ধারা থেকে আন্দামান কিন্তু খুব একটা দূরে নেই। ‘বাকপ্রতিমা’র দৌলতে আজ আন্দামানে সাহিত্যচর্চার সুরভি পৌঁছে গেছে,শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়,ভারতবর্ষের বহু শহরে যেখানে বাঙালির বসবাস রয়েছে। হলদিয়া’র বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবে আমরা নিয়মিত হাজির থেকেছি,বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’র ডালি নিয়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছি বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা উৎসব মঞ্চে,শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছি ঢাকার ভাষা-শহীদ বেদীমূলে।
বিগত ১৩,১৪,১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯,দ: ২৪ পরগনা জেলার ঢোলা হাই স্কুল(এইচ.এস)-এর প্লাটিনাম জুবিলি উৎসবের দ্বিতীয় দিনে, একজন প্রাক্তন ছাত্র সম্মানার্থে সভাপতির আসনে কিছুক্ষণ উপবিষ্ট থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেখানে লক্ষ্য করেছি আন্দামান সম্পর্কে জানার জন্য মানুষের কী অপরিসীম কৌতুহল! শারীরিক অসুস্থতার জন্য, অপূর্ণতার বেদনাময় স্মৃতি নিয়ে,আমাকে ফিরে আসতে হয়েছে আন্দামানে। ফেলে আসা আমার সহপাঠী বন্ধুবর্গ, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমন্ডলী ও নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের,আন্দামান সম্পর্কে জানার অপরিসীম আগ্রহ আমাকে বাধ্য করেছে ‘আন্দামানের পাতায়’ লিখতে। তাই, শুরু হ’ল এই ‘আন্দামানের পাতা’।