(১)
চৈত্র মাস শেষ হতে চলল আর সেটা জানান দিতেই বোধহয় আজ অত্যাধিক গরম পড়েছে।তাপমাত্রা প্রায় আটত্রিশ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। শেষ বিকালে কলেজ থেকে ফিরে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জাহিদুর রহমানের ভীষণ জলতেষ্টা পেল।হিম শীতল ঠান্ডা পানিতে গোসল করা দরকার তার আগে ড্রইং রুমের ফ্যানটা ফুল স্পীডে চালিয়ে ফ্রিজে ঠান্ডা পানি আছে কিনা নীলুকে হেড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলেন। ভিতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে অগত্যা নিজেই ফ্রিজ খুলে পানি ঢালতে লাগলেন।
ঠিক সেই মুহুর্তে বাসার ভিতর থেকে খালি গলায় রবীন্দ্র সংগীত ভেসে এলো।আবেশ মিশ্রিত সুর মূর্ছনায় জাহিদুর রহমান সচকিত হলেন।এই অসময়ে তাদের বাড়িতে কে গান গায়? তবে শুনতে বেশ লাগছে।নীলু বা রিয়া এদের দুজনের কেউ ই যে গাইছে না এটা নিশ্চিত । নীলু গানের সমাঝধার শ্রোতা হলেও গান গাইতে পারে না তাহলে? কে এসেছে বাসায়? প্রায় এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে জাহিদুরের মনে হলো কন্ঠটা ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন শুনেছে। কোথায়?
শব্দের উৎস অনুসরণ করে সে গেস্ট রুমের দরজায় উঁকি মারলো। অচেনা এক ভদ্রমহিলা জানালার দিকে মুখ করে খাটের উপর বসে একমনে গান গাইছেন।
"মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না... তারপাশে নীলু মন্ত্র মুগ্ধের মত বসে আছে।
ভদ্রমহিলা সম্ভবত নীলুর নতুন পরিচিত । প্রায়ই নীলু নানা জায়গা থেকে নতুন নতুন বান্ধবী জোগাড় করে আনে।যখন থেকে সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরোনো শুরু হয়েছে তখন থেকে এই উটকো ঝামেলার শুরু ।নীলু এমনিতে শান্ত স্বভাবের হলেও বেশ জেদী ধরনের মেয়ে।নিষেধ করলে অশান্তি বাড়বে তাই তেমন কিছু বলে না জাহিদুর। তবে তিনি নিশ্চিত একদিন না একদিন নীলু একটা ঝামেলা টামেলা বাঁধিয়েই ছাড়বে । আজকালকার যুগে মানুষকে বিশ্বাস করা এক ধরনের পাপ।কে বোঝাবে কাকে?
রাতে খাবার টেবিলে নিজস্ব কৌতুহল থেকে জাহিদুর নীলুর নতুন গায়িকা বান্ধবীর প্রসঙ্গ তুলে বললেন
- বিকালে বাসায় ফিরে তোমার নতুন বান্ধবীকে দেখলাম।
নীলু জানে এটা একধরনের প্রচ্ছন্ন খোঁচা।খোঁচাটুকু হজম করলো সে।জাহিদুরের সাথে বগর বগর করতে মন চাইছে না।সে একমনে প্লেটে ভাত বাড়তে লাগলো । সোহানার সাথে কথাবার্তার পর থেকে আজ তার মনটা বেশ বিক্ষিপ্ত।
জাহিদুর ভাত মাখতে মাখতে বললেন
- তোমার বান্ধবী তো ভালোই গান গায়, শুনলাম। বেশ চেনা চেনা গলা।তবে জানো তো স্বকীয়তা না থাকলে নাম করা মুশকিল।চেষ্টা করে দেখতে পারে। ইউটিউবে গান আপলোড করলে যদি ভাইরাল হয় তো.. ভালো কিছু হলেও হতে পারে।আজকাল তো অনেকে..
- অনেকে কি?
- সোস্যালমিডিয়ার কল্যানে রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে যাচ্ছে। উনারা কি এই শহরের নতুন? আগে দেখিনি তো?
নীলুফার করিম জাহিদুর রহমানের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
-তুমি ওনাকে না চিনলেও ওনার গানের গলা ঠিক চিনেছ।উনি কোন নকলকন্ঠী নন। উনার স্বকীয়তা আছে।উনাকে দেশ ও দেশের বাইরের বাংলাভাষী লোকজন ভালো করেই চেনেন।
-মানে? এতো বিখ্যাত একজন, আমাদের বাড়িতে!!
-উনি সোহানা কবির।বাজারে উনার বেশ কিছু জনপ্রিয় গান আছে। তোমার কম্পিউটারে ওনার গান সেভ করা আছে। আমি জানি।তুমি মাঝেমধ্যে শোনো
- কি! উনি সোহানা কবির।এখানে?কিভাবে?
-হুহ
হঠাৎ জাহিদুর বেশ হতাশার সুরে বললেন
- ওহ উনি সেই ভদ্র মহিলা না? যে..
নীলুফার খাওয়া থামিয়ে জাহিদুরের দিকে আবারও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।তারপর পানির গ্লাসে বাম হাত দিয়ে পানি ঢালতে লাগলেন। ব্যপারটা জাহিদুর রহমানের কাছে ভালো মনে হলো না। এসব ঝড় উঠবার পৃর্ব লক্ষণ।আজকাল নীলু হুটহাট রেগে যায়।তিনি কি কোন ভুল করেছেন।কিম্বা নীলুর মনটা আজ কোন কারণে বিক্ষিপ্ত ?
যা হবার হয়ে গেছে।সোহানা কবির সম্পর্কে তার যথেষ্ট আগ্রহ আছে..ঝামেলা এড়াতে
জাহিদুর যা বলতে চেয়েছিলেন সেই প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে ভদ্রস্থ কায়দায় বললেন
-আচ্ছা উনি হঠাৎ করে গান ছেড়ে দিলেন কেন? বেশ নামডাক করেছিলেন কিন্তু।অনেকে অনেক কথা বলে অবশ্য ... বছর দুয়েক ওনার কোন নতুন গান স্যোসাল মিডিয়া বা অন্য কোথাও নেই। আমার কিন্তু বেশ ভালোই লাগে ওনার গান।বিশেষ করে..."ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভূ" এত সুন্দর গায়।
- তোমরা ওকে ভালো থাকতে দিয়েছো যে ও ভালো থাকবে? এত নেগেটিভ এনার্জি কোথেকে পাও?
- আমি আবার এর মধ্যে কি করলাম।
- ন্যাকামী করো না। তুমি সবই জানো।একটা সামান্য ব্যাপার, উনাকে নিয়ে মানুষ যাচ্ছেতাই ট্রল শুরু করলো। ব্যপারটা দিন দিন ক্রমশঃ সীমা অতিক্রম করছিল।ওকে তো আমি চিনি ও যদি শক্ত মনের মেয়ে না হতো। হয়তো একটা যাচ্ছেতাই দূর্ঘটনাই ঘটে যেতো।কাউকে এভাবে উত্ত্যাক্ত করা একধরনের ক্রাইম ।একজন মানুষের পারসোনাল লাইফ নিয়ে অজানা অচেনা মানুষের এত মাথা ব্যথা কেন তা বুঝি না।আজজাল চারিদিকে এত বিষাক্ত মনের মানুষ দেখে ঘেন্না ধরে গেল জীবনের প্রতি।
- তুমি যাই বলো উনারও দোষ ছিল। প্রথম স্বামী কি যে নাম যাহোক কত দিনের প্রেম ভালোবাসার সংসার।কত ইতিহাস... তরুণ তরুণীদের আইডল বলা হতো ওনাদেরকে আর উনি কিনা সেই হাজব্যান্ড মারা যাবার সাতদিনের মাথায় হুট করে আরেকজনকে বিয়ে করে বসলেন।কোন মানে হয় এসবের।মানুষ তো বাজে কথা বলবেই তাহলে এত ভালোবাসাবাসি কিসের ছিল আসল কথা সব নাটকবাজি। যাই বলো তুমি, শোবিজের লোকগুলোর কোন কমিটমেন্টের বালাই থাকে না।ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়। কোন কোন সময় এত বেশি বেশি বাড়াবাড়ি করে যে সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। সেগুলোকেই তারা আবার স্মার্টনেস বলে প্রচার করে।হাউ ডিজগাস্টিং। কেউ কেউ এসব জাহির করে নিজেকে তো....
নীলুফার করিম মৃদু ধমকের সুরে বললেন
- কে কার সাথে সময় কাটাবে।কে কখন কোথায় ঘুরতে যাবে।কে কাকে জীবন সঙ্গী করবে এসবও সাধারণ পাবলিক ঠিক করে দেবে।তাই তো।এত অনধিকার চর্চা কেন? হোক পাবলিক ফিগার। প্রাইভেসী বলতে তো কিছু আছে না-কি? তুমি ঠিক আছো জাহিদ?তোমার মাথা কাজ করছে তো? এই যে তুমি এতসব বলছো তুমি কতটুকু জানো ওদের সম্পর্কে? ওর জীবন সম্পর্কে।
- রেগে যাচ্ছো কেন? কি হবে এদের সম্পর্কে জেনে উনার গান ভালোবাসি ঠিক আছে তাই বলে উনার খাপছাড়া কাজকে তো সমর্থন করতে পারি না।
- জানতে চাও না আবার ঠিকই সমালোচনা করো।তোমার কাছে কি উনি সমর্থন চেয়েছেন? তাহলে কেন এসব অকারণ কথা বলা। এত আজাইরা সময় কোথায় পায় পাবলিক। যার জীবন তার সিদ্ধান্ত। আর হ্যাঁ শোন। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে রাখো সোহানা আমার ছোটবেলার বান্ধবী। স্বাভাবিকভাবে ওর সম্পর্কে আমি উল্টাপাল্টা কমেন্ট শুনতে চাই না।
-সিরিয়াসলি?
নীলু হঠাৎ উদাস গলায় বলল
-ওরা আর আমরা এক পাড়াতেই থাকতাম।ঢাকার মোহাম্মদপুরের শের শাহ শুরী রোডে।টাউন হল মার্কেটের পিছনে রোডে।ওদের আর আমাদের ঠিক সামনাসামনি বাসা ছিল ।
- বাহ! ইন্টারেস্টিং তো।আগে কখনও বলো নি তো তারপর তারপর
- ওই পাড়াতে আমরা প্রায় একই সময় শিফট হয়েছিলাম। ওটা বিহারি মহল্লা ছিল।আশির দশকের শেষ দিকে। আমার আব্বা ছিলেন এফ ডি সি তে ওর আব্বা ছিলেন সচিবালয়ে। বেশ ভালোই দিন কাটছিল আমাদের ।ওর মায়ের সাথে আমার মায়ের বন্ধুত্বটা বেশ জমাটি ছিল হঠাৎ ওর বাবা কেমন বদলে যেতে লাগলেন।তারপর একদিন...
(২)
প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের বিনোদন পত্রিকায় ২৪শে মার্চের গরম খবর "মধ্য চল্লিশের বিখ্যাত গায়িকা সোহানা কবির স্বামীর মৃত্যুর সপ্তাহান্তে আবার বিয়ের পিঁড়িতে" । অথচ সোহানা কবির ও রাকিবের জুটিকে ইন্ড্্রাসট্রিতে আইডল মানা হতো। রাকিবও দূর্দান্ত গাইয়ে ছিল।গত সপ্তাহে ওদের বিচ্ছেদ সবাইকে কাঁদিয়েছে সেই সোহানা এত দ্রুত এমন একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত নিবে এটা কেউ আশা করেনি।শুরু হলো শোরগোল। তার ভক্ত শুভাকাঙ্ক্ষীরা সত্যি বলতে কি দারুণ হতাশ হয়েছিল এই ঘটনার পরিপেক্ষিতে।।তাদের একটাই কথা বিয়ের সিদ্ধান্তে একটু সময় নিয়ে নিলে কি ক্ষতি হতো।ছি! ছি!!
পত্রিকার কাটতির জন্য এমন মুখরোচক খবর সাংবাদিকরা লুফে নেয়,নেবে এবং সেটাই স্বাভাবিক । মানুষ আগ্রহ নিয়ে এসব খবর পড়ে নিজেদের মধ্যে নানা আলোচনা করে মজা পায়।
সোহানা কবিরও এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ নিয়ে খুব একটা বিচলিত ছিলেন না।শোবিজের লোকজনের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকবেই তারা শিল্পীদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কৌতুহল প্রবণ হন।সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সোস্যালমিডিয়ায় যখন খবরটা শেয়ার হলো তারপর আমজনতা নানা নোংরা কমেন্ট পড়ে সোহানা ক্রমশঃ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে লাগলো। নিজের উপর তার নিজেরই ঘৃণা হতে লাগলো।সে কি সত্যি খুব বড় ভুল করেছে?মানুষ কেন এত এত বাজে কমেন্ট করছে। এতোদিনে... । মানুষ কিভাবে এমন করে ভাবতে পারে? না জেনে না শুনে এমন কুৎসিত মন্তব্য কিভাবে করতে পারে? আসলে এসব ছিল তার ভাবনার বাইরে ।বরাবরই তার ব্যক্তিগত জীবন বেশ পরিচ্ছন্ন যার জন্য এর আগে কখনও সে তেমন ভাবে জনসাধারণের বুলিং এর শিকার হননি।অন্তত কোথাও কোন ফালতু কমেন্ট এর আগে তার চোখে পড়েনি। আর এখন... শ শ নোংরা কমেন্ট।
কিছু না জেনে একজন মানুষ সম্পর্কে কিভাবে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা মানুষগুলো এমন অশোভন মন্তব্য করতে পারে । তাদের নিজেদের কি পরিবার পরিজন নেই?নূন্যতম স্বাভাবিক সৌজন্যতা বোধটুকু প্রত্যেকটা মানুষের থাকা উচিত।একজন সম্পর্কে একটা কথা বলতে গেলে তাকে অবশ্যই জানা উচিত ঠিক কোথায় থামতে হবে।হুটহাট মনে আসলো আর বলে ফেললাম এসব কি ধরনের নোংরামো।কোন কোন শিল্পীর লাইফস্টাইল কলুষিত এটা সত্যি তাই বলে সকলকে এক পাল্লায় মাপতে গেলে চলবে কি করে।
এমনিতে রাকিবের মৃত্যুর পর সোহানার মনোকষ্ট , অর্থ কষ্ট দুটোই চলছিল।মা ক্যান্সার রূগী..নিজে চলার মত খরচ। এত দিনের যা উপার্জন তা রাকিবের পরিবার একপ্রকার তার কাছ থেকে কেড়েই নিয়ে নিয়েছে ।তাছাড়া তাকে রাকিবের অসুস্থতার জন্য অনেক আগে থেকে পারিবারিকভাবে তাকেই দায়ী করা হতো।সে জানে এটা আসলে ওদের দিক থেকে একপ্রকার দায় মুক্তি নেবার ব্যর্থ চেষ্টা ।জীবনের এতটা পথ হেঁটে এখন সোহানা নিজস্ব উপলব্ধি হলো জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সঙ্গী হিসাবে রাকিবকে জীবন সাথী নির্বাচিত করা।যদিও রাকিব তাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো।কিন্তু জীবনে ভালোবাসাই সব নয়।।
এদিকে মায়ের কথায় চটজলদি মাসুদকে বিয়ে না করলে সোহানাকে অন্য রকম একটা উটকো ঝামেলায় পড়তে হতো।
আজকাল কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারে না সে।এই সব ঘটনার পর সোহানা খুব দ্রুত নিজেকে গুটিয়ে নিলো। গান গাওয়া ছেড়ে দিলো। স্টেজ প্রোগ্রাম ফিরিয়ে দিলো এক এক করে। তারপর মাসুদের হাত ধরে চলে এলো এক অখ্যাত মফস্বল শহরে।সেখানে কয়েক বিঘা জমি কিনে নিজের মতো করে নতুন করে সব শুরু করলো।ভালো থাকার জন্য আসলে সদিচ্ছাটাই আসল।এখন সে বেশ ভালো আছে। আসলে মানুষের জীবনে ভালো থাকাটা ভীষণ ভীষণ জরুরী।সে এখন স্যোস্যালমিডিয়া থেকে, শোবিজের জগত থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত সোহানা অনেকবার চেয়েছে তার আর রাকিবের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে পাবলিকলি জানাতে কিন্তু প্রতিবারই রাকিবের অসহায় মুখটা তার সামনে চলে এসেছে । রাকিবের করুণ মিনতি ভরা মুখ।আর তাই এত লাঞ্ছনা গঞ্জনা স্বত্বেও সোহানা নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিয়েছে পরিচিত জগত থেকে ।
(৩)
সোহানার ছোটবেলাটা কেটেছে ভয়াবহ দূর্বিষহ অবস্থায় । ঘটনার শুরু হয় হঠাৎই। সোহানার আট বছর বয়সে তার উচ্চ শিক্ষিত বাবা অশিক্ষিতের মতো কাজ করে বসে। প্রায় বিনা কারণে সোহানাকে আর তার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ও হ্যাঁ কারণ একটা ছিল। কারণটা হলো রাহেলা বেগম ছিল গরীব কেরানীর মেয়ে।জয়নালের চাহিদা মতো টাকার জোগান দিতে সে ব্যর্থ হচ্ছিল ।তার অক্ষমতা জয়নালকে ক্রমশ ক্ষিপ্ত করে তোলে। আসলে জয়নালের জুয়ার নেশা ছিল।সর্বগ্রাসী নেশার এত টাকা রাহেলা বেগম কোথায় পাবেন? এরপর সোহানাদের জীবটা বড্ড জটিল হয়ে যায় ।কোন রকম কষ্টে সৃষ্টে ঠোকর খেয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো মেয়েটি।রাহেলা বেগম ছোট একটা কাজ জোগাড় করলো।সেটাই একমাত্র ভরসা। সোহানা লেখাপড়ায়,তেমন ভালো না হলেও গানটা গাইতো। পাড়ার ক্লাবগুলোতে নিয়মিত ডাক আসতো । সবরকম গানে সে দক্ষ ছিল। এই গানের সূত্রে একবার এক অনুষ্ঠানে সোহানার সাথে রাকিবের পরিচয় হয়।নানা দোলাচলে দীর্ঘ ছয় বছর পর সোহানা রাকিবকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। ততদিনে সোহানার বেশ নাম ডাক হয়ে গেছে।সিনেমায় প্লেব্যাকও করছে।বেশ কয়েকটা গানও হিট। দুটি এ্যালবাম বের হয়েছে। বিশেষ করে স্টেজ প্রোগ্রাম করে আয় রোজগার যথেষ্ট ভালোই হতে লাগলো। বিয়ের পর পরই সোহানা প্রথম হোঁচট খেল।এমন একটা কিছু হবে সে কখনও কল্পনাতেও আনতে পারেনি।সোহানার স্বপ্ন সাধ আশা হঠাৎ এক দারুণ ঝড়ে ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। তারপরও রাকিবের প্রতি সোহানার ভালোবাসা একটুও কমলো না।বাকিব যেন একটা শিশু।পরিবার পরিজন সকলের অবহেলার পাত্র রাকিবকে আগলে রাখা যেন সোহানার দায়িত্ব । এটা ভালোবাসা না বলে অন্য কিছু বলা যেতে পারে।সে সবসময় রাকিবের প্রতি অদ্ভুত একটা টান অনুভব করতো । আসলে রাকীব মানুষ হিসাবে ভীষণ একা ও নিঃসঙ্গ ছিল।রাকিবের কষ্টগুলো ওর অসহায়ত্ব সোহানাকে ওর কাছাকাছি থাকতে সহায়ক হয়েছিল।রাকিব সোহানার উপর এতটাই নির্ভরশীল হলো যে সোহানা ওকে ছেড়ে আসতে চাইলেও ছেড়ে আসতে পারলো না।অনেকদিন পরে একটু বেশি রাগের মুহুর্তে সোহানা যখন সরে আসতে চাইলো তখন হঠাৎ এক চরম সত্য হাজির হলো তার সামনে।অক্ষম মানুষ নিজের স্বার্থে কত কিছুই না করে বসে।সোহানা অবাক না হলেও ব্যাথিত হয়েছিল ।তবে সব পাপের ক্ষমা হয় না। রাকিবদের ওখানে সোহানা থেকে গিয়েছিল নিজের স্বার্থেই। রাকিবের প্রতি ওর ভালোবাসাটা তখন আর অবশিষ্ট ছিল না। পরিবারবিহীন জীবনে সোহানা একটা পরিবার চেয়েছিল। সোহানা জানে সংসার ভেঙে ফেলা সহজ কিন্তু তার ধকল সামলানো সহজ কথা নয়।বিশেষ করে সে একটা মেয়ে।সবার আগে পায়ের তলার মাটি শক্ত হওয়া লাগে।সে এসব তার মাকে দেখেই জেনেছে। তাই এত কিছুর পরও সোহানা রাকিব আর ওর পরিবারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রেখে চলতে লাগলো। প্রাইভেসী বলতে সোহানার কিছুই ছিল না। এমন কি সোহানার স্যোস্যালমিডিয়ার ইউজার নেম পাসওয়ার্ড সবই রাকিবের কাছে থাকতো। রাকিবের সন্দেহ সোহানাকে ভীষণ পীড়া দিতো। কখনও কখনও সন্দেহর বাড়াবাড়ি সোহানার জীবনকে বিষাক্ত করে তুলছিল।তবু সোহানা চাইছিলো সংসার ভাঙার দায়টা যেন তার কাঁধে না পড়ে। রাকিবের পরিবারের লোকজনের অত্যচার অনেক সময়ই সীমা অতিক্রম করতো। রাকিব এসব ব্যপারে একদমই নির্লিপ্ত থাকতো।কখনও কখনও নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করতো।কিন্তু ওই যে রাকিবের অসহায়ত্ব।ওর কষ্ট সোহানাকে দূর্বল করে দিতো। ওর মিষ্টি কথায় সোহানা বারবার ভুল করতো। আসলে কোন কোন মানুষের জীবন বড্ড রহস্যময়। উত্তর না মেলা জটিল এক অংক।
(৪)
এই পর্যন্ত বলে সোহানা চুপ করে যায়। নীলু ওকে সময় দেয় তারপর বলে
- তারপর কি হলো...
সোহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আসলে সোস্যালমিডিয়ার চকচকে পাড়ায় জীবন সবটাই রঙীন মনে হলেও মিডিয়া পাড়া বলো আর বাস্তব জীবনে বলো কোন কোন মানুষের জীবন কি সত্যিই রঙীন? আসলে সব মুখোশে ঢাকা মুখ। নিরন্তর অভিনয় প্রাকটিস।
বলার আছে অনেক কিছু।কিন্তু কোথেকে যে শুরু করি...
নীলু বলল
- রাকিবের অসহায়ত্বের কথা বলছিস। এই ব্যপারটা একটু পরিষ্কার করবি? কি ধরনের অসহায়ত্ব? কি সেই কষ্ট? তোর যদি সমস্যা না থাকে আমার সাথে শেয়ার কর।মনটা হালকা হবে।
সোহানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা উচু করলো। ওর চোখে তখন জল
-যে চলে যায় সেতো যায়ই। আমি বেঁচে আছি।ভালো আছি।এখন শুধু আমি এতদিনের বঞ্চনাগুলো ভুলে ভালোভাবে বাঁচতে চাই। আমি চাই না আমার অডিয়েন্সের কাছে আমার সম্পর্কে কোন ভুল মেসেজ পৌছাক।আবার এও চাই রাকিবের সিক্রেটটা বজায় থাকুক। আসলে রাকিবের বড় একটা সমস্যা ছিল।বিয়ের কিছুদিন যেতে আস্তে আস্তে আমার কাছে রাকিবের অসুস্থতা ধরা পড়ে।আসলে ও জন্ম থেকেই নপুংসক ছিল।ওর পরিবারের লোকজন সবাই জানতো। এই অস্বাভাবিকতা স্বত্তেও ওর স্বাভাবিক প্রেম ভালোবাসা। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সবই স্বাভাবিক ছিল।সাধারণ চোখে কেউ কিছু ধরতে পারতো না। আমরা অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি।ও আমাকে কোনদিনই সুখী করতে পারেনি।তবু আমি..
রাকিবকে হয়তো আমি ছেড়ে চলে আসতাম আসলে কোন কোন সময় আমার মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে উঠতো। আমিও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ আমার তো কিছু শারীরিক চাহিদা আছে।এদিকে রাকিব একটা বড় অন্যায় করেছিল আমার সাথে। নিজের স্বার্থেই করেছিল সে। হয়তো আমি তাকে ছেড়ে যাবো এই আশঙ্কায় ভুগতো ।আমার অজান্তে আমার কিছু ন্যূড ভিডিও ক্লিপ সে নিজের কাছে রেখেছিল। এটা অবশ্য ওর মায়ের বুদ্ধি ছিল।সেটা পরে জেনেছি। নিজেদের সামাজিক সম্মানে যেন কোন দাগ না পড়ে সে ব্যপারে ভদ্রমহিলা অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন।চরম নোংরা মনের মানসিকতার মহিলা ।আসলে জোর করে কোনকিছু টেকানো যায় কি? যায় না।শেষের দিকে আমাদের সম্পর্কটা একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল। কিন্তু সোস্যালমিডিয়ায় আমাদের পোস্ট দেখে কেউ সেসব বুঝতো না।আমিও চাইতাম না কেউ আসল সত্য জানুক।ওই যে বললাম না মানুষের মন কখনও কখনও রহস্যময় আচরণ করে।হাজার বঞ্চনা স্বত্ত্বেও আমার মনও তেমনি....।আমার মা কিছুটা জানতেন।মা চাইতেন আমি এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসি।মা ই মাসুদকে পাত্র হিসাবে ঠিক করে রেখেছিল। আর রাকিবের হঠাৎ মৃত্যু পর মা আর এক মুহুর্ত দেরি করতে চান নি।
মাসুদ আমার দুর সম্পর্কের মামাতো ভাই। পরিচয়টা আগে থেকেই ছিল।
-তাহলে কি ধরে নেবো তুই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে ছিলি এতদিন।
- নানা তা মেটেও নই। আমার দিক থেকে আমি শতভাগ সৎ থেকেছি সবসময়। নিজের অনেক অভাব অভিযোগ থাকা স্বত্বেও আমি আমার দায়িত্ব একনিষ্ঠভাবে পালন করে গেছি।অনেক অন্যায় অনেক প্রলোভন স্বত্তেও আমি কখন কোন অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায়নি কোন দায়িত্বে অবহেলা করিনি।আর যাই হেক আমি বেইমান না....
খাবারের টেবিলে বসে শেষ বিকালের কথোপকথনগুলো এখনও কানে বাজছিল নীলুফারের। মানুষের জীবনে কত গোপন দুঃখ কষ্টই না থাকে। সবটা সবার কাছে প্রকাশ করার দায় নেই। সোহানা এখন ভালো আছে এটাই অনেক।সে গানের বানিজ্যিক বিপনন ছেড়েছে নিজের প্রাইভেসি রক্ষার্থে। তবে গান গাওয়া ছাড়ে নি। জাহিদুরকে নীলু এসব কিছুই জানালো না। থাকুক কিছু গভীর গোপন। নীলুর কন্ঠে শোনা "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই" এখনও কানে বাজছে। কত দরদ ভরা কন্ঠ। কোন কোন প্রতিভা কত অজানা কারণে অকালে ঝরে যায়।কে তার খবর রাখে। জাহিদুর কি যেন বলছে। নীলু কোন উত্তর দেয় না। তার চোখে জল..সে মাথা নিচু করে একমনে ভাত মাখছে।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৭:৩৩