আজকে জুম্মার নামাজের পর কথা হচ্ছিল বন্ধুদের সাথে সামার টায়ার লাগাতে হবে। যদিও তখন রক্ত হিম করা ঠান্ডা বাতাস বইছে। গত কয়েকদিন ভালো রোদ আর পজিটিভ টেম্পারেচার দেখে মনে হচ্ছিল বদলানোর দরকার। মিটিংয়ে ম্যানেজারও বলছিল সে অলরেডি চেঞ্জ করে ফেলেছে। বাকি দুইজন বলেছিল আমি যখন টায়ার চেঞ্জ করবো তখন জানাতে। তারা আগে কখনও করে নি, তাই যাবে আমার সাথে দেখতে কিভাবে, কোথা থেকে করা যায়! মাঝে মাঝে ভাবতে ভালো লাগে বন্ধুদের মাঝের এই বেড়ে উঠা টা... একসময় সবাই স্টুডেন্ট ছিলাম, একসাথে ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে থাকতাম, কোনমতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লিনিং করে দিন চলত। এখন বলতে গেলে সবাই প্রতিষ্ঠিত, একসাথে যখন উইকএন্ডে রাতের বেলা কফি খেতে যাই এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এবিসি তে ৩ ৪ টা গাড়ি নিয়ে, এমনি কি ভেবে যেন গর্বে মনটা ভরে উঠে। হয়ত তুমুল আড্ডার মাঝে মনে হয়, আমরা পেরেছি এই ভিনদেশে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে...
যাই হোক, সাধারণত আমরা নামাজের সময় গাড়ি নিয়ে যাই না, এসময় পার্কিং পাওয়া যায় না। আর শুক্রবারে যেহেতু অফিস টাইম, তাই তারাহুরো করে ট্রামে উঠে কোনমতে চলে যাই। আসার পথে বাজার সদাই করে যাই মসজিদের নিচের হালাল শপ থেকে। দোকানদারও এক মজার মানুষ! বেটা পার্সিয়ান কিন্তু বাঙ্গালী কাস্টমারদের খুশি করতে বাংলায় কথা বলে! আমাকে দেখেই বলে উঠল কি মামা কেমন আছেন! উনার কথা শুনে বুঝার উপায় নেই যে সে শুধু কয়েকটা শব্দ বলতে পারে বাংলায়! আমাদের মাঝের ইরফানের বাসায় আজকে দাওয়াত তাই সে ঢুকে গেল বাজারে। মাঝে আমি আর ফারহান ডোনাট খেতে খেতে বাসায় ফিরলাম। তার আর আমার বাসা পাশাপাশি তাই হেঁটেই একসাথে বাসায় ফিরি। ফারহান আর আমি একসাথে দেশে থাকতে একই ইউনিভার্সিটির একই বিষয়ে পড়তাম। আমার ভার্সিটির বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সে। আর ইরফান এক সেমিস্টার জুনিয়র ছিল সেইম ডিপার্টমেন্ট এর। ফারহানের সাথে কথা হতে থাকল আমার নতুন ps5 নিয়ে, এটা নিয়ে এই সপ্তাহে আমি খুবই অবসেস্ট বলতে গেলে! অফিস করতে করতে কখন যে মরটাল কমব্যাট এ ঢুকে একটা দুইটা ম্যাচ খেলে ফেলছি বলতে পারি না! ফারহানের প্ল্যান হল একটা টুর্নামেন্ট করার, আমরা দুইজন মিলে কিছু মরটাল কমব্যাট এর কম্বো বের করেছি, ইচ্ছা আছে জিসান আর সোহেল ভাইয়ের উপর এসব এপ্লাই করার! XD ঠিক হলো ইরফানের বাসায় দাওয়াত খেয়ে রাতের বেলা বসব টুর্নামেন্ট নিয়ে, সেখান থেকে যারা খেলতে চায় তারা আমার বাসায় চলে আসবে!
তো বাসায় আসার কিছুক্ষণ পরেই ফারহান weather forecast এর খবর শেয়ার করল। ভাই কালকের গাড়ির চাকা বদলানোর প্ল্যান বাদ দে! 10 থেকে 15 ইঞ্চ স্নোফল ফোরকাস্ট দেখাচ্ছে!
আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম, এই মিড এপ্রিলে আবার স্নো! গত দুই সপ্তাহ ধরে বরফে কোন চিহ্ন নেই! তার মাঝে রাস্তার সব পাথরও তুলে ফেলেছে সিটি কর্পোরেশন! দেখা যাক কি হয়! আমি অফিসের শেষ কিছু কাজে মনযোগ দিলাম। আরেক ক্লোজ ছোটভাই মাহদীর PhD interview চলছে, তার একটা টাস্ক দিয়েছে প্রফেসর llm এর উপর অ্যাপ্লিকেশন বানাতে, আমার কাছে কাছাকাছি একটা কোড ছিল, অফিসের আগের প্রজেক্টের জন্য রেডি করেছিলাম, openai এর api call করে একটা rag system বানাতে হবে, তার এটা শেষ করতেই বিকেল হয়ে গেল।
রাতে ইরফানের বাসায় দাওয়াতে যাবার সময় দেখলাম গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, আর দাওয়াত শেষে আড্ডা দিয়ে ১ টার সময় যখন বের হলাম দেখি সব ঢেকে গেছে সাদা বরফে। বরফ মানে একেবারে গোড়ালি ডুবে যাচ্ছে বরফে। গাড়ির কাছে এসে মাথায় হাত, পুরা গাড়ি বরফের চাদরে ঢাকা! এরমাঝে আমার বরফ পরিষ্কারের ব্রাশ ও খুঁজে পাচ্ছি না, sure আমি সেটা স্টোররুমে রেখে এসেছি! কে ভেবেছিল এই মাঝ সামারের সময় এমন স্নো ফল দেখতে হবে! যাই হোক অনিক ভাইয়ের ব্রাশ নিয়ে পরিষ্কার করে হিটিং দিলাম ফুল ম্যাক্স এ! আজ বালির মত চকচকে স্নো পড়ছে। দেখতে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে! কিন্তু বিগত ছয়মাস ধরে বরফ দেখতে দেখতে হাপিয়ে গিয়েছি আমরা, বুভুক্ষের মত অপেক্ষা করছি সামারের জন্যে। এখানে সামার আর উইন্টার সিজন আর পার্থক্য আকাশ পাতাল! শীতকালে অন্ধকার আর বিষণ্ন বরফে ঢাকা থাকে সবকিছু, আর গরমকালে গাছপালা সবুজে ঢেকে যায়.. সূর্য ডুবে রাত ১১ টায়। অদ্ভুত বৈচিত্রময় এই দেশ!
যাহোক, গাড়ি চালাতে গিয়ে বুঝলাম কি অবস্থা রাস্তার! একে তো উইন্ডশিল্ড এ স্নো জমে থাকায় ক্লিয়ারলি দেখতে পাচ্ছি না, তার উপর কোনটা যে রাস্তা আর কোনটা ফুটপাথ বোঝা যাচ্ছে না। বিপত্তি বাজল মোড় ঘুরতে! আমি স্টিয়ারিং ঘুরাই কিন্তু গাড়ি ঘুরে না! স্কিড করে গাড়ি সোজা রোড ডিভাইডার এর দিকে চলছে! কষে ব্রেক চেপে এই যাত্রা বাচ্লাম! মনে মনে এদেশের আবহাওয়ার গুষ্টি উদ্ধার করে ভাবলাম, শীতকালীন টায়ার আজকে যে স্কিড্ টা করল, সামার টায়ার হলে আজ কপালে যে কি ছিল! গাড়ির কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হলো না, মাহদী তার PhD নিয়ে কিছু বলছে আর আমার বউ তার ভ্লগ বানানোতে বিজি! এমন সামার টাইমে স্নো ফল দেখানো মিস করতে চাইছে না! বাসায় এসে এবেপারটা বেমালুম ভুলে গেলাম, কন্ট্রোলারের মাঝে আঙ্গুল উড়ছে! SubZero কে দিয়ে কয়েকবার ফ্রস্ট করলাম জিসানকে। তার বাসায় ডেকে ফিফায় যে ভরাটা ভরেছিল তার প্রতিশোধ নিতে একটুও খারাপ লাগল না! সব শেষে রাত আড়াইটার দিকে যখন সবাই চলে গেল আমি বারান্দায় কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম। সামনের স্ট্রিট লাইতে গুড়িগুড়ি স্নো ঝকঝক করছে। অদ্ভুত সুন্দর নির্জন মায়াবী এক দৃশ্য! মাইনাস ১০ ডিগ্রি ঠাণ্ডার মাঝেও কিছুক্ষণ দাড়িয়ে দেখতে থাকলাম আর ভাবলাম, জীবন হয়তো সুন্দর।
-রাফীদ চৌধুরী
তামপেরে, ফিনল্যান্ড।
৫টা ৫৫ মিনিট
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১০