এই বৃহস্পতিবারের ঘটনা। অফিস করে মেজাজ চরমে পৌঁছেছে। তিনটার উপর বাজে কিন্তু দুপুরের খাওয়া হয় নি। কাহাতক নিজে নিজে রান্না করে অফিস ডে তে খাওয়া যায়? আর নিজের রান্না মুখে জুটে না। যদিও চার বছর এদেশে থেকে হেন রান্না নেই জা শিখি নি। কিন্তু আর কত! তার উপর মেজাজ খিঁচড়ে আছে অফিসের কাজ নিয়ে। দরকার 20 হাজারের মত ডাটা সেট আর যে গিট থেকে স্ক্রিপ্ট নামিয়েছি সেটায় ডাটা আছে 5,6 মিলিয়ন! কোন এক্সেল ফাইলে লোড হয় না এত বড় ডাটা সেট বাধ্য হয়ে ক্লাউড এ পান্ডাস ডাটা ফ্রেমে নিয়ে কাজ করা আর স্ক্রীপ্ট চেঞ্জ করা! কোথাও কেন আগে থেকে এক্সিস্ট করে না কাজগুলো সব কিছুই নিজের মত চেঞ্জ করে নিতে হয়!
ফোন লাগলাম জিসানকে। কফি খাবা অফিস শেষে?
হ্যা ভাই অবশ্যই! তার আবার মাস্টার্স এর এক্সাম চলছে। সাথে ফুলটাইম জব আর অকেসনে ক্ষেপে ফুড ডেলিভারি ও বাদ রাখে না। তার বিশেষ সুনাম আছে গ্রুপে এব্যাপারে।
কাজ করতে করতে খবর হয়ে গেছে ভাই! ৪:৩০ এ আসতেছি। রেডি থাইকেন।
আমি অবশ্য বিশেষ ভরসা পেলাম না। আগেও একবার ডেকেছিলাম, সেদিন আসছি আসছি বলে শেষ পর্যন্ত পেট খারাপ বলে বাদ দিল! তাও তাকে দরকার এই ঠান্ডা রাতে তার গাড়ি ছাড়া হেঁটে বা ট্রামে এত দুর যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার!
সতিই আসবা তো? সন্দেহ দেখা দিল আমার মনে। আমি এখনও কিছু খাই নাই!
কসম ভাই আসতেছি আমি! দেখা হচ্ছে বলে ফোন রেখে দিল।
যেই কথা তাই সই। মনটা কিছুটা ভালো হয়ে গেল। বাজে দিন গেছে ব্যাপার না, শেষ পর্যন্ত বাইরে খাওয়া হবে। ওস্তাদের মাইর শেষ রাতে!
এমন সময় dhl থেকে মেইল এল। পার্সেল বের হয়েছে ডিপো থেকে। ৩:১৫ থেকে ৫:১৫ এর মাঝে ডেলিভারি। ভাবলাম আগে চলে আসুক পরে বের হওয়া যাবে। ম্যাপে দেখালো আর চারটা মাত্র ডেলিভারি বাকি। ভাবলাম এ আর এমন কি চার ডেলিভারি আসতে আর কতক্ষণ! এখনো যথেষ্ট সময় আছে, বের হবার আগেই চলে আসবে। জিসানকে বলে দিলাম পাঁচটায় বের হব।
অথচ চারটা ৫০ বাজে তাও dhl এর খবর নেই! এককালে শুনেছিলাম ডিএইচেলের গাড়ি শুধু ডানদিকেই ঘোরে এখন মনে হল ম্যাপে তাই দেখাচ্ছে শুধুমাত্র ডান দিকে ঘুরে বিশাল পথ ধরে যাচ্ছে, কোন তারা নেই তাদের মনে। ইতিমধ্যে জিসান এসে হাজির ফোনের উপর ফোন দিচ্ছে। ডেলিভারির টাইম পাঁচটা 15 যে কখন শেষ হয়ে গেল তার ওপর দেখাচ্ছে আরো একটি ডেলিভারি বাকি। নিচে নেমে উড়ে গেলাম বাতাসের দাপটে, দেখেছিলাম টেম্পারেচার পজিটিভ ওয়ান কিন্তু বের হয়ে দেখি ফিলস লাইক মাইনাস ফাইভ তখন। উল্টো আমি একটা টার্টল নেক পাতলা টি শার্ট এর উপর হালকা জেকেট পরে বের হলাম যাক আজকে তো পজিটিভ টেম্পারেচার। নেগেটিভ ফাইভ টেম্পারেচার ও ব্যাপার না যদি না বাতাস থাকে বাতাসে এক মিনিটও হাত বের করে রাখা যায় না।
কাঁপতে কাঁপতে জিসানকে বললাম দাঁড়াও একটু ডেলিভারিট টা নিয়েই যাই, এখনি চলে আসবে। সে উত্তর দিল গাড়ির দরজাটা লাগান ভাই ঠান্ডা ঢুকে!
অতঃপর বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকলাম আর ম্যাপে দেখতে থাকলাম, মেজাজটা খিচড়ে গেল ডি এইচ এল এর উপর তারা দেখাচ্ছে নেক্সট ডেলিভারি আমার কিন্তু এর মাঝেই কয়েকটি জায়গায় দাঁড়িয়ে পার্সেল ডেলিভারি দিচ্ছে ডি এইচ এল এর ভেন! এদিকে আমার ঠান্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। বিরক্ত হয়ে কাছের স্টোরেজে ড্রপ করতে দিয়ে উঠলাম গাড়ি তে! আসা লাগবে না আর তোর আমার বাসায়!
গাড়িতে উঠতেই জিশানের প্রথম কথা, জমা টাকা ইনভেস্ট করেন ভাই খামাখা ফালাইয়া রাখবেন কেন। এটি তার নতুন বাতিক, যাকে দেখছে তাকে এই কথা বলছে। কয়দিন পর পরই তার এমন হয়, কিছু একটা দেখেছে তো সবাইকে সেটা করতে বলবে, আর ভাব নিবে যে না করলে বিশাল কিছু মিস হয়ে গেল।
আমি কি তোমার মত ফুল টাইম জব সাথে ফুড ডেলিভারি করে বেড়াই যে জমা টাকা থাকবে?
কি যে কন ভাই, আপনার তো কোনো খরচই নাই! সেভিংসের টাকা ব্যাংকে না রেখে কোথাও ইনভেস্ট করেন!
তারে আমি বুঝাতে পারি না আমার সেভিংস একাউন্টে কোন টাকা নাই, যে আমি উল্টা ইনভেস্ট করব! হতাশ হয়ে বললাম কোথায় যাব খেতে?
ভাই আমি কিছু খাব না, আমি এখন ডায়েটে আছি, একটা কফি খাবো আপনি কোথাও খেয়ে নেন। মেজাজটা খিচুড়ে গেল, এটাও তার নতুন বাতিক। নিউ ইয়ার এর আগে একবার খেতে গিয়েছিলাম, তিনজন মানুষ, অথচ খাবারের পরিমাণ হচ্ছে একটা পিজ্জা, একটা বিশাল সর্মা, আর রাইস উইথ কাবাব! বললাম এত খাবার কে খাবে? বলল সমস্যা নাই ভাই শেষ হয়ে যাবে। আর আজকে বলছে কিছু খাবে না!
রেজুলেশন ভাই, নতুন বছরে। এখন ডায়েট করব কার্ব জাতীয় কিছু খাই না! আপনি hesburger থেকে কিছু খেয়ে নেন আমি বাজার করি!
একে তো dhl ধোঁকা দিল, এখন খাওয়ার প্ল্যান ও বাদ! দিনটাই খারাপ যাচ্ছে। Hesburger ফিনল্যান্ড এর সবার প্রিয় হলেও আমাদের বাঙালি কমিউনিটি তে কেউ ছুঁয়েও দেখে না, এত ফ্ল্যাট এর টেস্ট!
তাই নাকি, হেসে বললাম। আমি তো ভাবছিলাম পাঞ্চো তে জাই আজকে!
দেখলাম চোখগুলো লোভাতুর হয়ে গেল জিসানের। পাঞ্চ ভিলা এখানকার মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট, তাদের বার্গার এর পেটি ফুড ভ্লগারদের ভাষায় টেন্ডার আর জুসি, বড় উপাদেয় এই জিনিস।
উচিত না ভাই, জিভ চেটে বলল জিসান। মাত্র ডায়েট শুরু করলাম! আচ্ছা আমি শুধু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাই, আপনে বার্গার খান। বলে গাড়ি ঘুরাল kaukajarvi এর দিকে। রাস্তার মোড় টা পেরুতেই দেখা গেল সামনে দিয়ে dhl এর হলুদ গাড়ি টা যাচ্ছে! ভুল হবার কোন সুযোগ নেই! ভিনদেশে বাংলা গালির উত্তম প্রয়োগ করলাম! এখন যাচ্ছে শালা এতক্ষণ বসে ছিলাম!
জিসান বলল কি আছে ডেলিভারি ভাই, এত ক্ষেপা dhl এর উপর?
সল্ট নিক ভেপের জুস!
ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার! বাঁকা হাসি দিল সে। তাই তো বলি এত উতলা কেন!
উতলা হবার কারণ আছে! ফিনল্যান্ড এ ফ্রী বেইসড জুসই শুধু পাওয়া যায়, এতকাল কেউ দেশে গেলে বলে কয়ে হাত পা ধরে দেশ থেকে সল্ট নিক জুস আনতাম, ছোটভাই থাকত দেশে, সে কিনে পাঠিয়ে দিত, এখন সে গেছে কানাডা পড়াশোনা করতে, এখন কে আমাকে দেশের জুস খাওয়াবে? মাঝে লাতভিয়া এর একটা ওয়েবসাইট পাওয়া গেল যেখান থেকে সল্ট বেইস জুস অর্ডার করা যায় ফিনল্যান্ড এ কিছুদিন এই সার্ভিস নিলাম, কিন্তু দেখা গেল হুট করে লাতভিয়ান পুলিশ রেইড দিয়েছে তাদের অফিসে, সব সেল বন্ধ! কয়দিন খুঁজে এই ওয়েবসাইট বের করেছি, এখনো জানি না ফেইক কিনা! তাও ডেলিভারি চার্জ কেটে নিয়েছে একগাদা dhl করে পাঠাবে বলে! এখন dhl এর এই দশা! সিগারেটের কথা বাদ দিন, এর দাম এক প্যাকেট 10 euro এর উপরে! বাংলা টাকায়.. বাদ ই দেই!
রেস্টুরেন্ট এ যেয়ে দেখা গেল জিসান বার্গার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিশাল কোক সব অর্ডার করে বসে আছে, আমি তাকাতেই লজ্জিত ভঙ্গিতে ফোন বের করে বলল, অ্যাপস চেক করে দেখেছি, আজকে খেলেও কেলোরি ইনটেক রেঞ্জের মাঝেই থাকবে...
দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম, আজকালের ছেলেরা ডায়েট শুরুর আগেই অ্যাপস ইনস্টল করা শেষ! যাক আমার ভালোই হল, আড্ডা জমে গেল। বাসায় এসে ফুরফুরে লাগল যাক পেট শান্তি তো মন শান্তি! তীব্র শীতএ পাঞ্চ এর বার্গার তুলনাহীন!
কফি বানিয়ে এনে ফোনে তাকাতেই মেসেজ টা আসল, your parcel has been placed to the nearest locker. From DHL! দেখেই খিঁচড়ে গেল মেজাজটা! আসবি যখন দশমিনিট আগে আসতি! জিসানের গাড়ি করে যাওয়া যেত! কিন্তু কি আর করা! A very important parcel is waiting for me
এবার আর ভুল করলাম না, উইন্টার জ্যাকেট টা বের করে অফিস থেকে দেওয়া মাগনা কান টুপি পরে airtight হয়ে বের হলাম। তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করলাম এই বিরূপ আবহাওয়ার মাঝে।।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১০:২৮