আমার বাল্যবন্ধু হাসনাত । বন্ধু মহলে তাকে ডাকা হতো বিপাশা । কারন স্কুল জীবনে বিপাশা নামের এক মেয়েকে সে গভীরভাবে ভালোবেসে দিয়েছিল একটি প্রেমপত্র । যা বিপাশার বদলে বিপাশার বাবার হাতে পড়ে ।
পরের দৃশ্য অত্যাধিক করুন , বেদনার , ট্র্যাজিডির । যে মেয়ে রূপসী অতি অবশ্যি তার পিতা বদরাগী বড় ভাই গোঁয়ার আর ছোট ভাই কুটনা । এইটাই চিরন্তন সত্য ।
বিপাশারও পিতা আছে যিনি কেবল বদরাগী নন , তিনি বাংলাদেশ পুলিশের গর্বিত (!!) এসপি । লও ঠ্যালা । বিপাশার আছে একটি ষণ্ডা মার্কা বড় ভাই যিনি যেমন গোঁয়ার তেমন টাকলা । সবসময় মাথা ছিলা রাখেন । উনার গরম বেশি তাই আরাম কম । থেমে যাবেন না বিপাশার আছে একটি ছোট ভাই । মুফতে । নাম মুহিত । ( এলাকায় তাকে ডাকা হয় মুতি , কই মুতে সেটা অজানা ) এই চাল্লু পোলাই মূলত চিঠি বিপাশার পিতার হাতে তুলে দিয়ে একটি গেইম জয় স্টিক বাগিয়ে নেয় ।
যেই বিপাশার এতো কিছু সেই বিপাশাকে আটচল্লিশ বার আইলাবিউ লিখা প্রেমপত্র দিয়ে ধরা খাওয়া আমাদের বন্ধু হাসনাত ধরা খাবার প্রথম রাতেই বিপাশার গোঁয়ার ভাইয়ের হাতে খেল ঢলা । ঢলা ভালো খেয়েছে , সাতদিন পর্যন্ত সে কোথাও বসতে পারিনি ।
বিপাশার এসপি বাপ হাসনাতের পিতা মাতাকে বিচার দিয়েই ক্ষান্ত হন নি তিনি এলাকায় সালিশির ব্যবস্থা করেন । হাসনাতের পিতা মাতা ভীরু প্রকৃতির , উনারা ক্রসফায়ার অপেক্ষা সালিশির একশ দোররাকে শ্রেয় ও কার্যকরী মনে করেছেন ।
সালিশিতে একশ দোররা খাওয়া থেকে হাসনাত বেঁচে গেলেও বাঁচাতে পারিনি নিজের নাম । আমাদের বন্ধু মহলে সে হাসনাত থেকে হয়ে যায় বিপাশা ।
ন্যাড়া বারবার বেল তলায় যায় না । আমাদের বন্ধু বিপাশাও ( হাসনাত ) আর প্রেমের পথে নিজে পা বাড়ায়নি । তবে তরুন প্রেমিকদের প্রেমে সফলতার জন্য অব্যর্থ টিপস দিয়ে সে রাতারাতি বনে যায় -- প্রেম গুরু ।
নিজের করুন অভিজ্ঞতার আলোকে সে অনভিজ্ঞ প্রেমিকদের দিয়ে যায় একের পর এক পরামর্শ । কিভাবে প্রেমিকার বদরাগী বাবা কিংবা বড় ভাইদের চোখ ফাকি দিয়ে প্রেম পত্র প্রেমিকার পড়ার টেবিলে পৌঁছানো যায় , কিভাবে প্রেমিকার মন জয় করতে হয় , কিভাবে প্রেম করবে অথচ ধরা পর্বে না – এরুপ কঠিন বিষয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে অল্প সময়ে সে কামাতে থাকে নগদ অর্থকড়ি । তার প্রতি সাজেশনের জন্য সে চার্জ করে দশটাকা । আমি যেই সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে দশ টাকা অনেক কিছু ।
অবাক হলেও সত্য তার পকেটে টপাটপ দশ টাকা নোট জমতে থাকে । তাকে আমরা জিজ্ঞাস করতাম -- এতো এতো দশ টাকা নিয়ে করবিটা কি ?
সে উদাস নয়নে উত্তর দিত --- বিপাশা মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট বানাবো । সেখানে সকল প্রেমিক জুটিকে দজ্জাল পরিবারের লাল চোখ এড়িয়ে অবাদে প্রেম করবার সুযোগ দেয়া হবে ।
কথাগুলো বলতে বলতে বন্ধু কেঁদে দিত । আমরা বন্ধুরা শুকনো মুখে তার পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম – কাঁদিস না বিপাশা , কাঁদিস না । তোর কান্না আমাদের আর সহ্য না ।
বাবার বদলীর জন্য আমাকে এলাকা ছাড়তে হয় । কলেজের গণ্ডী শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় , তারপর চাকুরী । মাঝে দীর্ঘসময় । হাসনাতের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি । জানা হয়নি বিপাশা মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট এর অগ্রগতি বা নিম্নগতি ।
গতপরশু দিন বসুন্ধরা শপিং সেন্টারের ফুড কোর্টে হঠাৎ দেখা সেই হাসনাতের সাথে । হ্যাংলা পাতলা হাসনাতের গায়ে এখন পাহাড় সমান চর্বি । থলথলে পেট ভাসিয়ে সেই আমায় ডাক দিল । পুরনো বন্ধুর সাথে বহুদিন পর দেখা ।
একেরপর এক বহু কথার পর জিজ্ঞাস করলাম – বন্ধু , তোর বিপাশা মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট এর খবর কি রে ?
হাসনাত মুচকি হেসে – “ এই শৈলীর মা , এইদিক দেখে যাও “ বলে ডাক দিল এক নারীকে ।
আমি বিস্ময়ে দেখলাম – ফুটফুটে এক বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো বদরাগী পিতার , গোঁয়ার বড় ভাই আর চাল্লু ছোট ভাইয়ের সেই বিপাশা !
বন্ধু হাসনাত হাসতে হাসতে বললো – একেবারে জীবন্ত বিপাশা মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি রে দোস্ত ।
আর পিছনে দাঁড়ানো একটা চ্যাংড়া ছেলেকে দেখিয়ে বলল - আর এঁকে তো চিনতে পারছিস ? আরে বিপাশার ছোট ভাই মুহিত ।
দেখলাম ছেলের হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ । শপিং ব্যাগের ভারে সেই চাল্লু মুতি বেঁকে গেছে । তবুও অসহায়ের মতো দুলাভাইয়ের পিছনে দাড়িয়ে !
মানুষ অধিক শোকে পাথর হয় এবং মাঝে মধ্যে অধিক বিস্ময়ে ইটের চাক্কা হয় । হতবাক আমায় হাসনাত ধাক্কা দিয়ে বলল -- শ্যামলীতে এইমাসের নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছি , বাসায় আসিস কিন্তু ।( চুপি চুপি বলে দেয়া ভালো , ১২ শো স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটখানা বিপাশার বাবা জামাইকে উপহার দিয়েছে )
বন্ধু ও বন্ধু পত্নীকে অভিনন্দন জানিয়ে দিয়ে , তাদের ছোট্ট কন্যার হাতে একটি গিফট তুলে আবার দেখা হবে কথা দিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিলাম ।
মনে মনে বললাম – প্রেমের জয় হোক ।
কার্টুন - মৌরিন