আমি ইলিশ ভাঁজা পছন্দ করি , কিন্তু ইলিশের মাথা দিয়ে পুঁইশাকের তরকারী পছন্দ করি না । যতবার খেয়েছি গলায় আঁটকে গিয়েছে । আজও তাই হল ।
বাবা বলল – মুঠো করে সাদা ভাত গিলে ফেল । একদম চাবাবি না । একেবারে গিলে ফেলবি । দেখবি ভাতের সাথে কাঁটা পেটে ডুকে যাবে ।
আমি মুঠো মুঠো সাদা ভাত গিলতে শুরু করলাম । না চাবিয়ে ভাত গিলা কঠিন । ইচ্ছে হয় দাঁত দিয়ে ভাত পিষে ফেলতে ।
আমার কাশির শব্দ শুনে মা বুঝে ফেলেছেন আবারও আমার গলায় কাঁটা বিঁধেছে । বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে বাবাকে বলছেন
-কতবার বলেছি , ইলিশের মাথা রাঁধবে না । ঠিক মতো রাঁধতে পারো না উল্টো তরকারী ভর্তি থাকে কেবল কাঁটা । এই তরকারী কি খাওয়া যায় ! তোমার কি আর কোনকালেই আক্কেল হবে না ?
মায়ের সামনে বাবা হাঁটু চুলকাতে চুলকাতে এদিক ওদিক তাকায় । প্যারালাইসিস হয়ে মায়ের ডান পাশ একদম অকেজো হয়ে যাবার পর মায়ের কোন কথার প্রতিবাদ বাবা করেন না । মা কিছু বললে বাবা অপ্রস্তুত মুখে কেবল হাঁটু চুলকায় । হাঁটু চুলকানো বাবার পুরনো অভ্যাস ।
আমি মুঠো মুঠো সাদা ভাত পেটে চালান করি । কিন্তু ইলিশ কাঁটা গলায় বহাল তবিয়তে আঁটকে রয় । “ ভাত মুঠোয় ডরে না বীর “
এখানে কাঁটা বীরের ভূমিকা নিয়ে নেয় ।
মা’কে ভাত খাইয়ে দিয়ে বাবা আমার কাছে এসে দাড়ায়
– নেয়ামুল কোরআনে কাঁটা নামানোর একটা আয়াত আছে । আয়াত পড়ে পানিতে ফু দিয়ে খেলে কাঁটা উদাও । আয়াতটা এখন মনে পড়ছে না । আমি নেয়ামুল কোরআন খুঁজে বের করছি । তুই টিপ দিয়ে বসে থাক ।
আমি টিপ মেরে রই । মুখে প্রচুর থুতু জমছে । গিলতে পারছি না । পিচিক পিচিক করে থুতু ফেলতে ফেলতে চারপাশ নোংরা হয়ে গেছে ।
বাবা সারা বাড়ি খুঁজে ফেলেছেন । নেয়ামুল কোরআন কই রেখেছেন তার মনে নেই । ভুলে গেছেন ।
-খোকা, এক কাজ কর । গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করে ফেল । কাঁটা বের হয়ে যাবে । পারবি ? নাকি আমি গলায় হাত ঢুকাবো ?
আমি জানি রাতে রান্না করবার মতো ফ্রিজে কিছু ছিল না । বাবা বাধ্য হয়েই ইলিশের মাথা রান্না করেছেন । আমি তার দিকে কোন অভিযোগ করেনি । তারপরও হয়তো তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবছেন । গুমরো মুখে বাবা আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায় ।
-আঙ্গুল ডুকিয়ে বমি কর খোকা । দেখবি ঠিক বের হবে । ছোটকালে আমার কতোবার গলায় কাঁটা বিঁধেছিল । এইটা কোন ব্যাপার ই না । তুই বমি কর ।
আমি গলায় আঙ্গুল ডুকিয়ে বমি করি । চোখে পানি এসে যায় । কাঁটা বের হয়ে আসে না । বাবা বিরস মুখে আমার চারপাশে ঘুরঘুর করতেই থাকেন ।
-খোকা , কাঁটা নেমেছে ?
- হুম । তুমি শুয়ে পরো । রাত অনেক হল ।
গলায় কাঁটার অস্বস্তি যন্ত্রনা নিয়ে আমি বারান্দায় এসে দাড়াই । গলা ব্যাথা করে খুব । ফস করে আগুন জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাই । লম্বা টান দেই । কাঁটা ভুলে থাকার চেষ্টা । গ্রিলের ফাঁকা জায়গা দিয়ে শিরশির বাতাস আসচ্ছে । ভিজিয়ে দিতে চায় । সিগারেটের ধোঁয়ায় আমি আমার চারপাশে বলয় সৃষ্টির চেষ্টা করি । এই বলয় আমার কাঁটার অনুভূতি কমিয়ে দিবে ।
হঠাৎ আমার কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ পাই । বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন । আমি সিগারেট বাইরে ফেলতে যাবো এমন সময় তিনি বলেন –
-ফেলিস না খোকা , আমাকে দে । দুটা টান দেই ।
অবাক হলেও প্রতিবাদ করি না । বাবার হাতে সিগারেট তুলে দেই । তিনি এক টান দিয়েই কাশতে থাকেন । বাবার হাঁটু চুলকানোয় অভ্যাস আছে , সিগারেটে নেই । তারপরও তিনি জোরে জোরে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন । বাবার সিগারেটের ধোঁয়া আমার চারপাশে বলয় তৈরি করছে ।
মানুষ প্রিয়জনের বলয়ে বন্দী হতে ভালোবাসে ।