কামরুল সাহেব জুতোর ফিতে বাঁধা ভুলে গেছেন । প্রথমে এক গিঁট দিয়ে ডান পাশের ফিতা ফুল করে বাম পাশের ফিতা পেঁচিয়ে ঐ ফুলের ভিতরে ডুকিয়ে আলতো করে এক টান । ব্যাস ! হয়ে যায় ফিতে বাঁধা । কামরুল সাহেব ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সেই কাজটাই করে যাচ্ছেন । কিন্তু হচ্ছে না । হচ্ছে না তো হচ্ছেই না । এই অবস্থায় লুতফাকে কি ডাক দেয়া যায় ?
--ঐ লুতফা , আমি না মানে জুতোর ফিতে বাঁধা ভুলে গেছি , তুমি একটু বেঁধে দিবে ?
কথাটা বলতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে । যে লোক প্রতিদিন টাই স্যুট জুতো মুজো পড়ে গত ২২ বছর যাবৎ সরকারী চাকুরীতে অভ্যস্ত সে কিনা আজ সামান্য জুতোর ফিতে বাঁধতে পারছেন না ! হাস্যকর ব্যাপার । তবে এই হাস্যকর ব্যাপারটাই আপাতত সত্য । কামরুল সাহেব জুতোর ফিতে বাঁধা বেমালুম ভুলে বসে আছেন ।
শুধু জুতোর ফিতে না ইদানীং তিনি অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছেন । এই তো সেদিন তার বড় মেয়ের নাম ভুলে গেলেন । সুমি নাকি অন্তি , কোনটা ? কামরুল সাহেবের দুই মেয়ে । একজনের নাম সুমি অন্য জনের নাম অন্তি । সমস্যা হয়েছিল সুমি বড় নাকি অন্তি বড় সেটা নিয়ে । বেশ কিছুক্ষন চেষ্টার পর হতাশ হয়ে তিনি লুতফা বেগমকে বললেন --
তোমার বড় মেয়েকে ঢেকে নিয়ে আসো তো । জরুরী কথা আছে ।
লুতফা বেগম লাউ শাক বাছছিলেন । তিনি লাউ শাক হাতে বিরক্ত মুখে স্বামীকে দেখলেন । মেয়ে পাশের রুমে তারপরও তাকে দিয়ে মেয়েকে ডাকানোর অর্থ লুতফা বেগম বুঝতে পারেন নি । বিরক্তি নিয়েই বড় মেয়েকে ডাক দিয়েছিলেন --
– ‘ এই সুমি , এইদিকে আয় তো , তোর বাবা তোকে কি জানি বলবে ।
‘ কামরুল সাহেব মহাসাগরে ভেলা খুঁজে পেলেন । বড় মেয়ের নাম সুমি । এই নাম কামরুল সাহেবের মা তৈয়বা আক্তার রেখেছিলেন । একজন বাবা তার বড় মেয়ের ভুলে গেছেন ! কতো বড় লজ্জার বিষয় ! কামরুল সাহেবের খুব লজ্জা করছিল । মেয়ে বাবার কাছে আসলো ।
-- বাবা , ডাকেছিলেন ?
বড় মেয়েকে কামরুল সাহেব ডাকছিলেন , সত্য । কিন্তু কেন ডাকছিলেন সেটা আর মনে নেই ।
তিনি জড়তা নিয়ে বললেন - হ্যাঁ মা ডেকেছিলাম । তা তুই আছিস কেমন ?
সুমি কপাল কুঁচকে বাবার দিকে তাকালো । চোখগুলো সুরু হয়ে গেছে । ঠিক কামরুল সাহেবের মতো । মেয়েটার গায়ের রং কালো । তার মতোই । লুতফার রং পেয়েছে ছোট মেয়ে । দুধে আলতা । আচ্ছা ছোট মেয়েতা জানি কোন ক্লাসে পড়ছে ? সিক্স নাকি সেভেনে ? মনে পড়ছে না । তিনি ছোট মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে সেটা ভুলে আবার লজ্জা পেতে শুরু করলেন ।
কামরুল সাহেব জুতো হাতে বসে আছেন । অফিসের সময় হয়ে আসচ্ছে । তিনি বসেই আছেন । জুতো ছাড়া তিনি আজ পর্যন্ত অফিস করেননি । এমনকি বৃষ্টির দিনেও তিনি পলিথিনে জুতো মুড়িয়ে ব্যাগে করে নিয়ে যেতেন । অফিসে ডুকার আগে তাদের অফিসের দারোয়ান রোকনের টুলে বসে জুতো পড়ে তারপর অফিসে ডুকতেন । কিন্তু আজ ? আচ্ছা আজ অফিস ফাঁকি দিলে কেমন হয় ! স্কুল কলেজ কতো ব্যাং দিয়েছেন , আরবি শিক্ষক হারুন স্যারের বেতের বারি এখনো প্যান্ট খুললে খুঁজে পাওয়ার কথা কথা । আজ অফিসটাই ব্যাং হয়ে যাক । আরবি শিক্ষক হারুন স্যার তো আর অফিসে নেই । সুতরাং এই বুড়ো বয়সে পশ্চাৎদেশে ট্যাঁস ট্যাঁস বেতের ভয়ও নেই ।
-- কি ব্যাপার !! তুমি লাঞ্চের বাটি ফেলেই চলে যাচ্ছে যে ? লুতফা বেগম গোসল সেরে কামরুল সাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে ।
--আজ অফিসে লাঞ্চ করবো । গতকাল এক কলিগের প্রমোশন হয়েছে । তিনি আজ সবাইকে খাওয়াবেন ।
--তো এই কথাটা আগে বললে চলতো না ! এই ভোরে উঠে তোমার জন্য তো তাহলে আর মশলা বাটতে হতো না । এমনিতেই কাজের লোক নেই । সমস্ত সংসার সামলাতে হয় এক হাতে । দু মেয়ে তো হয়েছে নবাবজাদী । কোন কাজের ভিতরে নেই আছে শুধু অর্ডার দিতে । সেইসাথে তুমিও শুরু করছো তামাশা । মানে আমিও তো মানুষ , মনে থাকে সে কথা ?
লুতফা কোমরে হাত দিয়ে কথা বলছে । কথার দমে দমে তার নাকের ফটো বড় হচ্ছে , ছোট হচ্ছে । কামরুল সাহেব অবাক নয়নের তার স্ত্রীকে দেখছেন । নাহ , ২৪ বছর আগে এই মেয়েটিকে পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করে তিনি ভুল করেননি ।
কামরুল সাহেবকে চুপ করে থাকতে দেখে লুতফা বেগম ভাবলেন আজ স্বামীকে বাগে পাওয়া গেছে । তিনি স্বামী কাছে অভিযোগের পর অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছে । অনেক দিন অভিযোগ দেয়া হয়নি । অনেক অনেক কিছু জমে আছে ।
কামরুল সাহেব গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছেন , মূলত ভাবছেন । আজ তার তাড়া নেই । তিনি লুতফার প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করছেন । সত্যিই তো , মেয়েটা তার এই ছাপোষা সংসারে এসে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছে । সারাদিন হাড়ি পাতিল নিয়ে পড়ে থাকতে হয় । আগে গান গাওয়ার যে চর্চাটা ছিল সেটা তো কবেই মরে ভূত । মেয়ে দুটোকে নিয়েও বহুদিন ঘুরে বেড়ানো হয় না । ঘুরে বেড়ানো দূরে থাক , বাসায় একসাথে চারজন বসে ঠিক মতো কথাটাও ইদানীং বলা হচ্ছে না । অফিস বাসা , বাসা অফিস । কারেন্ট বিল , গ্যাস বিল , বাসা ভাড়া , মাসের বাজার , সেভিংস , একটা বাড়ির চিন্তা , রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা , অফিস পলেটিক্স ! কোন মানে হয় ? এতো কিছুর কি মানে আছে ?
লুতফা বেগম অনর্গল তার কষ্টের কথা বলে যাচ্ছিলেন এমন সময় কামরুল সাহেব শান্ত স্বরে বললেন
-- আচ্ছা আজ লুতফা আর মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে বের হলে কেমন হয় ।
স্বামীর কাছে তীব্র অভিযোগের মুহূর্তে এমন তরল কথা শুনতে লুতফা বেগম প্রস্তুত ছিলেন না । গত ২৪ বছরে বছরে তার কামু যে কথা বলেনি আজ সে কথা কেন ? কামরুল সাহেব লুতফার অবাক চোখকে পাশ কাটিয়ে তেমনি তরল স্বরে বলল --
-- চল আজ মেয়েদের নিয়ে আমরা কোথা হতে বেড়িয়ে আসি । যাবে ?
লুতফা বেগমের কিছু বলা উচিৎ কিন্তু কি বলা উচিৎ ভেবে পাচ্ছেন না । তিনি আগের মতোই বিস্ফোরিত চোখে কামরুল সাহেবকে দেখছে ।
বেশ কিছুক্ষন পর তিনি তার প্রাক্তন কামু বর্তমান কামরুল সাহেবকে বললেন --
-- এই তোমার কি আজ কিছু হয়েছে ? কখনো তো এতক্ষন আমার কথা শুনো না । আজ আমি এতগুলো কথা বললাম আর তুমি ঠায় দাড়িয়ে শুনলে আবার এখন বলছো আমায় নিয়ে বাইরে যাবে ! এই প্লিজ সত্যি করে বোল তো তোমার কি হয়েছে ?
বিস্ময়ের পরিবর্তে এইবার লুতফা বেগমের কণ্ঠে উদ্বেগ ।
-- কিছু হয়নি তো । ভাবলাম তোমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো । আচ্ছা লুতফা তুমি কি জুতোর ফিতে বেঁধে দিতে পারবে ? আমি না ভুলে গেছি
কামরুল সাহেবের স্ত্রী লুতফা বেগম এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছেন । তার কমকথা বলা নিরীহ স্বামীটির আজ কিছু একটা হয়েছে । তিনি অস্থির ভাবে বললেন
-- এই , সুমির বাবা , তুমি ঠিক আছো তো !
তিনি দ্রুত স্বামীর কপালে হাত রাখলেন । কপাল ঠাণ্ডা । জ্বর নেই । প্রেশার কি বাড়ল ? কাল রাতে ডিম তরকারী দেয়াটা ঠিক হয়নি । হজমে সমস্যা না তো !
লুতফা বেগম স্বামীকে জোর করে বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন । ইতিমধ্যে সুমি আর অন্তি বাবার মাথার কাছে চলে এসেছে । তিনজন উদ্বিগ্ন নারী কামরুল সাহেবকে ঘিরে রেখেছে । কামরুল সাহেব মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার আপন মানুষগুলোকে দেখছে । আহা কি শান্তি লাগে এই মুখগুলো দেখতে ।
কামরুল সাহেব পরিতৃপ্ত মনে ভাবছেন -- নাহ , মাঝে মাঝে ভুলে গেলে মন্দ হয় না ।