--তবে শিখিয়ে দাও
-ভালোবাসা তো বর্ণমালা না যে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া যায় !
-তাহলে ?
-তবে আর কি ? আজ থেকে তোমার লাইন আমার লাইন আলাদা
শিপলু চমকে ঘুম থেকে উঠলো । সারা গা বেয়ে ঘাম । গেঞ্জি ভিজে গায়ের সাথে লেপটে আছে । ফ্যান হা করে শিপলুর দিকে তাকিয়ে আছে । কারেন্ট নেই ।
রাখীকে নিয়ে শিপলু এই বাজে স্বপ্ন কেন দেখল ? তাদের ভিতরে তো কোন সমস্যা নেই ! গতকাল বিকালেও তারা একসাথে বিপিন পার্কে বহুক্ষণ বসে ছিল । যতক্ষন রাখী তার পাশে ছিল তার মাথা শিপলুর ডান কাঁধে দিয়ে রেখেছিল । রাতে রাখীর সাথে মোবাইলে কথা হয়েছে । রাখী তাকে চমৎকার দুটো নজরুল সংগীতও শুনিয়েছে । ‘ মোর ঘুম ঘরে এলে মনোহর ‘ আর ‘ খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু ‘
চমৎকার পরিবেশে দুজনে পরস্পরকে মিহি স্বরে গুড নাইট হানি বলে ঘুমোতে গেছে । এর মাঝে হঠাৎ ‘ আজ থেকে তোমার লাইন আমার লাইন আলাদা ‘ ধরনের স্বপ্নের হেতু কি !
তবে তাদের ভিতরে আসলেই কোন সমান্তরাল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে । অথচ তারা কেউ টের পাচ্ছে না ? কিন্তু এমনটাই বা কেন হবে ?
মাথাটা দপদপ করছে । শিপলু ঘড়ির দিকে তাকাল । ৩টা বেজে ৪০ মিনিট । রাত প্রায় শেষের দিকে ।
এখন আর ঘুম হবে না । শিপলুর তেষ্টা পাচ্ছে । জিবহা যেন শুকিয়ে কাঠ । আগুনের তপ্ততা নিয়ে সে পানি চাচ্ছে । এক সমুদ্র পানি ।
ডেস্কটপের পাশে এক বোতল পানি রাখা আছে । শিপলুর উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না । তার ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে তেষ্টা পেলে বোতলটার মুখ যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার মুখে সাথে মিলে যেত । বেশ হতো ।
তেষ্টা বাড়ছে । শিপলু বিছানা ছেড়ে উঠলো । পানির বোতল খুলে ঢক ঢক করে আধ বোতল পানি এক চুমুকে শেষ করে দিল ।
রাখীকে কি এখন ফোন করা ঠিক হবে ? নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে । রাখী আদর্শ মেয়ে ।
early to bed early to rise makes a man healthy wealthy and wise এই নীতি রাখীর জন্য আবিষ্কৃত !
রাখী ঘড়ি ধরে ঠিক ৯ টায় রাতের খাবার খায় । তারপর শিপলুর সাথে এক কখনো দেড় ঘণ্টা ফোনে কথা বলা । ঘড়িতে ১১.৩০ বাজা মানেই - টা টা বাই বাই কাল যেন দেখা পাই । রাখী ঘুমে । উঠবে খুব ভোরে । ৫ টা ।
শিপলু টর্চ নিয়ে রান্নাঘরে গেল । এই মুহূর্তে এক মগ কফি গলায় নামালে মন্দ হয় না । মাথার দপদপানিটা সেরে যেতো ।
শিপলু যথাসম্ভব আস্তে ধীরে কফি বানাচ্ছে । মা’র ঘুম পাতলা । অল্প খুটখাট শব্দ শুনলেও তিনি জেগে উঠে বলেন
-- কি হয়েছে শিপলু ? ঘুম হচ্ছে না বাবা ? শরীর খারাপ লাগছে ? দেখি তো কপালটা !
আর যদি দেখে শিপলু রান্নাঘরে ব্যাস আঁচল কোমরে গুঁজে বলবেন
--ওমা , তুই রান্নাঘরে কি করছিস ! যা রুমে যা ... যা লাগবে আমি আমি নিয়ে আসচ্ছি । তা লাগবেটা কি ?
তারপর চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করবেন -- আচ্ছা এতো রাতে কফি খেতে চাচ্ছিস , সমস্যা হবে না তো !
শিপলু’র মা এমনটাই করেন । সবসময় ঠিক এমনটাই ।
ছেলেকে নিয়ে প্রশ্ন করতে তিনি ক্লান্ত হোন না । মজার বিষয় হল প্রশ্নের বিনিময়ে তার যথাযথ উত্তর চাই না । চাই একের পর এক প্রশ্ন । কারণ উত্তর তিনি নিজেই বসিয়ে নিতে জানেন ।
--তোর তাহলে জ্বর ? আমাকে জানাবি না ? আমি কি মরে গেছি ? তোর বাবা স্বার্থপরের মতো নিজের বুঝ বুঝে আগেভাগে কেটে পড়েছেন । তাই বলে কি আমিও এমনটা করবো ? কক্ষনো না ।
মা এই সময় কাঁদবেন । কাঁদতে কাঁদতে এক হাতে কফির মগ অন্যহাতে আধবালতি পানি টেনে টেনে ছেলের রুমে নিয়ে আসবেন ।
--নে , এইবার বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড় । আমি মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছি । তার আগে তুলো দুটো কানে গুঁজে নে তো
এতো কাহিনী অথচ কারণ বেশি কিছু নয় । রাতে একটু কফি খেতে চাওয়া । এতটুকুই । তার জন্য এতো হুলুস্থুল ।
কোন মানে হয় না । সত্যি ই এসবের কোন মানেই হয় না । মা ‘ টা দিন দিন অসহ্য হয়ে যাচ্ছে । বাবা মারা যাবার পর থেকেই মা যেন আরও খুব বেশি পরিমানে পসেসিভ হয়ে গেছেন । উঠতে বসতে তিনি শিপলুকে চোখের সামনে দেখতে চান । নিজের মতো একমাত্র ছেলের বিপদ ইমাজিনেশনে সাজিয়ে তিনি অনর্থক প্রতিকারে নেমে যান । উনিশ বছরের শিপলুর যে সম্পূর্ণ আলাদা এক জগত আছে , তার সেই জগতে রাখী নামের ভারী চশমাধারী নিয়ম সচেতন এক মেয়ে আছে , সেটা মা কি করে বুঝবে ?
শিপলু কফির মগ হাতে রুমে আসলো আর তখনি কারেন্ট চলে আসলো । কফিতে চিনি বেশি হয়ে গেছে । টর্চের আলোতে ঠিক মতো আন্দাজ করা যায় নি । খেতে বিশ্রি লাগছে । আবার রান্নাঘরে গিয়ে নতুন আরেক মগ বানাতেও ইচ্ছা করছে না ।
--কি’রে কফি ভালো হয় নি ! খাচ্ছিস না যে
মা শিপলু’র পিছনে দাড়িয়ে । কখন আসলো শিপলু বলতে পারবে না । দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিপলু বলল
-- ‘ তুমি কি রাতে এক ফোঁটাও ঘুমাও না ? আমি তো তেমন শব্দ করলাম না । তাও জেগে উঠলে ? ‘
মা কিছু না বলে বিছানার কোনায় বসে মুচকি হাসলো ।
মা ‘কে ক্লান্ত দেখাচ্ছে কি ! শিপলু ভেবে রেখেছিল আর কিছুক্ষন পর সে বাইরে বের হবে । যাবে রাখীদের বাসায় । রাখী ভোরে ছাঁদে কিছুক্ষন দাড়ায় । শিপলু’র ইচ্ছা ছিল সে রাখীদের ছাদের বিপরীত পাশের রাস্তায় দাড়িয়ে থাকবে । রাখী ছাঁদে উঠে আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শিপলুকে দেখে অবাক হয়ে যাবে । নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে । মেয়েরা সময়ে অসময়ে রোমান্টিসিজম দেখতে পছন্দ করে । মেয়ের বয়ফ্রেন্ড ভোরে তার বাসার সামনের রাস্তায় দাড়িয়ে আছে । কারণ রাতে ছেলেটি মেয়েটিকে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখেছে । তাই ভোরে মেয়েটির কাছে ছুটে এসেছে । বিষয়টা যথেষ্ট রোমান্টিসিজমে টুইটুম্বর । এখন রাখীকে একটা ভরভুর ধাক্কা দেয়া দরকার । শিপলু’র মন বলছে তাদের সম্পর্কে নতুন করে রোমান্টিসিজমের ধাক্কা দেয়া প্রয়োজন । না হলে আজ শিপলু এতো ভয়ংকর বাজে স্বপ্ন দেখত না ।
--“ আজ থেকে তোমার লাইন আমার লাইন আলাদা “
স্বপ্ন তো অবচেতন মনের ই বহিঃপ্রকাশ । তাহলে কি তাদের সম্পর্কে ‘ একটা সূক্ষ্ম আলাদা আলাদা গন্ধ এসে যাচ্ছে । না । কোন মতেই আসতে দেয়া যাবে না । শিপলুর আরও বেশি কেয়ারিং হতে হবে রাখীর ব্যাপারে । রাখী মুখ ফুটে কিছু বলে না । কিন্তু সে হয়তো শিপলুর কাছে আরও বেশী কিছু প্রত্যাশা করে । শিপলু রাখীর প্রত্যাশা পূরণ করবে । সেটা যে ভাবেই হোক না কেন ।
--এতো , কি ভাবছিস রে
শিপলু দেখলো মা গালে হাত দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে । রাখীর দেয়া অফ ওয়াইট গেঞ্জিটা পড়তে গিয়ে সে এই কথাগুলো ভাবছিল । গেঞ্জি গায়ে দিতে আর মনে ছিল । এতক্ষন খালি গায়ে গেঞ্জি হাতে শিপলু বসে !
মা নিশ্চয়ই ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন । শিপলু’র লজ্জা লাগছে । মা টের পেয়ে যাননি তো ?
--মা , আমি একটু বের হবো । আজ ভোরে হোসেনআলী মাঠে প্র্যাকটিস আছে । সামনেই ফুটবল টুর্নামেন্ট । আজ পুলাপান আসবে প্র্যাকটিস করতে ।
--আমি একটু নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি । খেয়ে তারপর যা । রাতে জানিয়ে রাখবি না ? রুটি বেলে রাখতে পারতাম ।
--না মা । এখন কিছু খাবো না । আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব । আজ প্রথম দিন তো , বেশীক্ষণ প্র্যাকটিস হবে না তুমি ভিতর থেকে দরজা না আটকিয়ে শুয়ে পড়ো । আমি বাইরে থেকে লক করে যাচ্ছি । শিপলু কথা বলতে বলতে টেবিলের উপর থেকে সাইকেলের চাবি পকেটে ভরে নিল ।
বের হবার আগে শিপলু’র হাতে মা একটা আপেল ধরিয়ে দিল ।
--খেতে খেতে যা ।
তুমি শুয়ে পড়ো । আমি যাচ্ছি ।
শিপলু বাইরে থেকে দরজা লক করে চলে যাচ্ছে । রেহনুমা আক্তার ছেলের পায়ের শব্দ পাচ্ছেন । সিঁড়ি ভেঙে ছেলের পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে । রেহনুমা আক্তার দরজার সাথে কান ঠেস দিয়ে রেখেছেন । শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি শিপলুর পায়ের শব্দ শুনতে চান ।
ভোর হচ্ছে । ক্রমশ আলো ফুটছে । একটা ঠাণ্ডা বাতাস চারিদিকে । আহা কি মিষ্টি বাতাস । রেহনুমা আক্তার জানালার ধরে দাড়িয়ে আছেন । ঐ তো শিপলুকে দেখা যাচ্ছে । লাল সাইকেলে প্যাডেল মেরে হামিদউদ্দিন সড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ।
জানালার পাশে চেয়ার টেনে রেহনুমা আক্তার বসলেন । এখন তিনি অপেক্ষা করবেন । যতক্ষন না ছেলেকে আবার দেখতে পারছেন তিনি অপেক্ষা করবেন । এতো ভোরে ছেলেটা কিছু মুখে না দিয়েই বের হয়ে গেল । চিন্তা হয় তো !
ছেলের জন্য রেহনুমার আক্তারের বড় চিন্তা হয় ।