somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রণেশ দাশগুপ্তঃ সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক কর্মী

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক কর্মী রণেশ দাশগুপ্তের জন্ম ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের গাউরদিয়া গ্রামে। বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত। তিনি খ্যাতনামা খেলোয়াড় ছিলেন। তাঁর কাকা নিবারণ দাশগুপ্ত ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও শিক্ষক। আরেক কাকা ছিলেন গান্ধীবাদী স্বদেশী। পারিবারিক রাজনৈতিক ধারার জন্য রণেশ দাশগুপ্ত ছোটবেলা থেকেই দেশমাতৃকার সাধীনতা সংগ্রাম ও দেশপ্রেমের বীজ অন্তরে বুনেছিলেন। যার ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এভাবেই রণেশ দাশগুপ্ত এক সময় হয়ে ওঠেন তুখোড় মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক কর্মী।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালা ও প্রাইমারী। ছোটবেলায় পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা, বইপড়া ও লেখালেখি করে সময় কাটাতেন। প্রাইমারী পড়াশুনা শেষ করে রাঁচির (বিহার) স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন বাঁকুড়ার কলেজে। এ কলেজে পড়াশুনাকালে তিনি সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল অনুশীলনের সঙ্গে পরিচিত হন। ধীরে ধীরে তিনি এই দলের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল অনুশীলনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে বাঁকুড়া কলেজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। কিছুদিন পর তিনি অনুশীলন দলের সিদান্ত অনুযায়ী কলকাতায় এসে সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশের উৎপাতে কারণে লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটতে থাকে। পুনরায় তিনি দলের কথা মতো বরিশালে এসে ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি তার মাতুল সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে থাকতেন। সত্যানন্দ দাশ ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের পিতা। এখানেও বেশীদিন থাকা সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি বিপ্লববাদী দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
১৯৩৪ সালে তার পিতা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত অবসর গ্রহণ করলে তারা সপরিবারে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের গাউরদিয়া গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে সবাই বসবাস করতে শুরু করেন। ২ বছর পর ওই গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। তখন সবাই ঢাকা শহরে চলে আসেন। বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত তখন বার্ধক্যের কারণে উপার্জন করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন রণেশ দাশগুপ্ত সংসার চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। চাকরি নেন সংবাদপত্রে। শুরু হয় সাংবাদিকতা জীবন।
তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সোনার বাংলা’য় সাংবাদিক জীবনের সূচনা ঘটে। এ সময় থেকেই মূলত তাঁর লেখক জীবনের শুরু হয়। সেকালের ঢাকা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য বিখ্যাত ছিল। তিনি তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ, অচ্যুত গোম্বামী, কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত প্রমুখের বন্ধুত্ব লাভ করেন। এদের সঙ্গে নানা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে থাকেন। এ সময় তিনি ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির রাজনীতির সাথে যুক্ত হন।
১৯৪৩ সাল। বাংলা ১৩৫০ সন। এই সনটি ইতিহাসে মন্বান্তরের সন হিসেবে পরিচিত। এই সময় ইংরেজ শাসকদের অবহেলার কারণে সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। এ সময় তিনি দুর্ভিক্ষ ও মহামারী মোকাবেলার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রাজনৈতিক কারণে তাকে পাকিস্তান পুলিশ গ্রেফতার করে। বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। গোটা পাকিস্তানি আমলে তাঁকে বহুবার গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। কারণ একটাই তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন এবং বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়েও তিনি জেলে ছিলেন। সেখানে বসেও তিনি তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে পাঠচক্র করতেন। নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে ‘কবর’ নাটক লিখতে তিনিই উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ‘কবর’ নাটকটি তাদের চেষ্টায় কারাগারে মঞ্চস্থ হতে পেরেছিল।
কারামুক্তির পর ১৯৫৫ সালে তিনি ‘সংবাদ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার চাকরি নেন। এ পত্রিকাকে ব্যাপক অর্থে প্রগতির মুখপত্র হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর অবদানই ছিল মূখ্য। তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতি ঘটে এ সময়েই। তিনি এসময় ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’ (১৯৫৯) নামে একটি বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ রচনার জন্য। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের সময়ে তাকে আবার পাকিস্তান পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। আবার কারারুদ্ধ করা হন ১৯৬৫ সালে। এবার মুক্তি পান ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর। ১৯৬৯ সালে বিপ্লবী কথাশিল্পী সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ একঝাঁক তরুণ মিলে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী গঠন করেন।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একজাঁক সংবাদ কর্মীকে নিয়ে ভারতে যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তিনি। তরুণ ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক ও কৃষকদের রিক্রুট, ট্রেনিং, দেয়া প্রভৃতি এবং কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনার যোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর কলকাতায় একটি সভায় যোগ দিতে গিয়ে সেখানে থেকে যেতে বাধ্য হন। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে সামরিক শাসন চালু হয়েছিল। তারপর বাংলাদেশ নানা বিপর্যয় ও উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়। তিনি আর ফিরে আসেননি, স্বেচ্ছানির্বাসিতের জীবন বেছে নিয়েছিলেন।
তিনি একাধিক ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। ইংরেজি ও উর্দুভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ত করেছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের অধিকাংশই মননশীল প্রবন্ধ ও অনুবাদ।
উপন্যাসের শিল্পরূপ(বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে (বঙ্গাব্দ ১৩৭৩), ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রাম(১৯৭২ খ্রি.), আলো দিয়ে আলো জ্বালা(১৯৭০ খ্রি.) ও আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ। অনুবাদঃ ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা (১৯৬৯ খ্রি.)। সম্পাদনাঃ জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র।
রণেশ দাশগুপ্ত ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর কলকাতর পিজি হাসপাতালে মারা যান। অকৃতদার ছিলেন তিনি। নিরভিমান ও ঋষিতুল্য উদার স্বভাবের এই মানুষটির মরদেহ সবার ইচ্ছায় ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ স্বদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। দেশের সবাই পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে পোস্তগোলা শ্মশানে তার অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।






৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×