মাঠে প্রান্তরে আবদুল করিম নামের দুরন্ত এক বালক গরু চরানোর ফাঁকে মনের আনন্দে আপন মনে হিজল-করচ গাছের নিচে বসে বাঁশিতে সুর তোলে। ওই বালক রাখালের বাঁশির সুরে মন্ত্রমুগ্ধ আশপাশের ক্ষেতে হালচাষরত কৃষকেরা। সেই বাঁশি আর পিছু ছাড়েনি রাখালবালক করিমের। এই বাঁশির প্রেমে পড়েই এরপর হাতে উঠল একতারা। অভাব-অনটন আর দুঃখ-দারিদ্রে বেড়ে ওঠা আবদুল করিম শৈশবকালেই আশপাশের গ্রামগুলোতে যাত্রা-বাউল-মালজোড়া-পালাগানে মত্ত হয়ে উঠেন। যেখানে বেহালার তারের সুর, সেখানেই শিশু করিম সবার আগে দর্শক-শ্রোতা হয়ে বসে পড়তেন।
বাউল গানের জীবন্ত কিংবদন্তী শাহ আবদুল করিমের জন্ম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে। বাউল শাহ আবদুল করিমের সংগীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। বাউল সম্রাটের প্রেরণা তার স্ত্রী আফতাবুন্নেসা। তিনি তাকে আদর করে ডাকতেন সরলা বলে। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ, দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তিনি অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে গান বাধতেন এবং গাইতেন।
তার বয়স যখন ১২ বছর, পারিবারিক দুরাবস্থা তখন চরমে। খেয়ে-না খেয়ে কোনোরকমে চলছে সংসার। পরিবারের হাল ধরতে দুটাকা মাসিক বেতনের গরু রাখালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামের পাশ্ববর্তী ধলবাজারের একটি মুদির দোকানে কাজ নিলেন। এ চাকরি থেকে যে সামান্য কয়েকটি টাকা আসত তা মাস শেষে বালক করিম বাবার হাতে তুলে দিতেন। মুদির দোকানের চাকুরি আর রাতের বেলা হাওরে-বাওরে ঘুরে ঘুরে গুনগুনিয়ে গান গাওয়া। এটাই ছিল বালক করিমের একমাত্র কাজ। ঠিক এ সময়ই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি নৈশ বিদ্যালয়। অক্ষর জ্ঞান শেখার জন্য তিনি ভর্তি হলেন সেই নৈশ বিদ্যালয়ে। মাত্র আটদিন লেখাপড়া করার পর গ্রামে গুঞ্জন উঠলো- এ বিদ্যালয়ে যারাই পড়াশোনা করবে তাঁদেরকেই বিশ্বযুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হবে। এই ভয়ে বালক করিম আর বিদ্যালয়মুখী হননি।
দিনের পর দিন যায়। গানপাগল করিম গ্রামের বিভিন্ন মঞ্চে একটু-আধটু গানও গাইতে শুরু করলেন। এরপর বাকিটা ইতিহাস। অল্প সময়েই তিনি হয়ে উঠলেন গ্রামবাসীর প্রিয় শিল্পীতে। উঠতি গায়ক হিসেবে আবদুল করিমের জনপ্রিয়তা তখন এলাকাজুড়ে। তাঁর গানের গলা এতই চমৎকার যে সেই বয়সেই সুরমাধুর্য দিয়ে নিজের এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে আশপাশের উপজেলাগুলোতে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে প্রতিদিনই মানুষ ভিড় জমাতে শুরু করলেন। যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই মাতিয়েছেন দর্শক-শ্রোতাদের। তরুণ বয়সেই পরিচিতি পেলেন সকলের প্রিয় করিম ভাই। এরপর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, কাগমারী সম্মেলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর গান হয়ে উঠেছে বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণা। মৌলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন দীর্ঘকাল। এসব তুখোড় রাজনীতিবিদদের বক্তৃতার পাশাপাশি শাহ আবদুল করিম গণসংগীত গেয়ে উপসি'ত সকলকেই আন্দোলন-সংগ্রামে উজ্জীবনা জোগাতেন।
ততদিনে তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাউলসম্রাট উপাধি। তিনি তখন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। এসব সুখস্মৃতির পাশাপাশি কিছু দূঃখের স্মৃতিও রয়েছে বাউলের মনে। বিভিন্ন সময় গান গাওয়ার অপরাধে গ্রামের এক শ্রেণীর উগ্র ধর্মান্ধদের হাতে নির্যাতিত ও ঘর ছাড়া হয়েছিলেন। আকবর নামে তাঁর প্রিয় এক শিষ্যের জানাজা পর্যন্ত করেনি তারা। তবুও হাল ছাড়েননি তিনি। নিজের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ও দর্শন বিলিয়ে দিতে ছুটে চলেছেন অবিরত। সাত দশকব্যাপী নানা ঘাতপ্রতিঘাত এবং বৈরী পরিবেশের মধ্য গিয়ে তিনি সঙ্গীত-সাধনা করে এসেছেন এবং অনেক আগেই অমরত্বের পথটি নিজের অজানে-ই তৈরি করে নিয়েছেন। ক্লান্তিহীন হেঁটেছেন গানের প্রান্তরে।
সুনামগঞ্জ জেলার ধলআশ্রম গ্রামের এক রাখালবালক এভাবেই হয়ে উঠলেন বাউলসম্রাট। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অপরিহার্য এ সাধক মানুষটি আর কখনো পূর্ণ যৌবনা উত্তাল হাওরের আফাল দেখে তাকিয়ে থাকবেন না। একতারা হাতে কালনী নদীর কূলে তিনি আর গাইবেন না আমি বাংলা মায়ের ছেলে। গত কয়েকদিনের শ্বাসকষ্ট আর প্রচণ্ড কাশিতে শাহ আবদুল করিম অনেকটাই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঠিক যেন শেষ বর্ষার তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কালনী নদীর মতোই নিশ্চুপ-উত্তালবিহীন।
বাউল শাহ আব্দুল করিম প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। সাম্প্রতিককালে এ সময়ের বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করার ফলে আব্দুল করিম দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।
বাউল শাহ আবদুল করিমের এ পর্যন্ত ৬টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হলো- আফতাব সংগীত, গণ সংগীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে এবং দোলমেলা। সম্প্রতি সিলেট জেলা মিলনায়তনে তাঁর রচনাসমগ্র (অমনিবাস)-এর মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে।
১। বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে
২। আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
৩। গাড়ি চলে না
৪। আমি কূলহারা কলঙ্কিনী
৫। কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া
৬। কোন মেস্তরি নাও বানাইছে
৭। কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
৮। বসন্ত বাতাসে সইগো
৯। আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু
১০। মহাজনে বানাইয়াছে ময়ুরপংখী নাও
১১। আমি তোমার কলের গাড়ি
১২। সখী কুঞ্জ সাজাও গো
১৩। জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে
১৪। মানুষ হয়ে তালাশ করলে
১৫। আমি বাংলা মায়ের ছেলে
২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার শাহ আবদুল করিমকে প্রদান করা হয় সর্বোচ্চ রাষ্টীয় সম্মান একুশে পদক। ২০০৪ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পান। ২০০০ সালে কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক পান। প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রাপ্তির শুরু তখন থেকে। পেয়েছেন প্রায় তিন শতাধিক পুরষ্কার। এসব পুরস্কারের সঙ্গে আছে গণমানুষের ভালোবাসা।
চুরি হওয়া আর লোকমুখে ছড়ানো-ছিটানো গান বাদ দিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গানের সংখ্যা সাতটি। এগুলো হচ্ছে, আফতাব সঙ্গীত (১৯৪৮), গণসঙ্গীত (১৯৫৭), কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮), কালনীর কূলে (২০০১) ও শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র (২০০৯)।
করিম গবেষক, সাংবাদিক সুমন কুমার দাশ জানান, গত ২২ মে তাঁর জীবনের সর্বশেষ অনুষ্ঠানে তাঁরই প্রকাশিত শাহ আবদুল করিমর রচনাসমগ্র বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন কতই না উচ্ছসিত! সে উচ্ছাস আর ভালোলাগা নিয়ে করিম বাংলা লোকসাহিত্যের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবেন। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম মারা যান।
সম্পাদনায়-ছামির মাহমুদ ও শেখ রফিক