মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রাসাদ হিরাঝিল দেখে ফিরছিলাম । হাতে সময় কম । ফিরতি ট্রেনে কলকাতা আসব । ট্রেনের সময় একেবারে কাছাকাছি, একটি টাঙ্গায় করে ফিরছি । মুরব্বি গোছের একজন চালক, নাম সামাদ আলী । বললেন, স্যার বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, নিমকহারামের দেউড়ি না দেখেই ফিরে যাবেন, এটা কেমন হয় । ২০০৪ সাল । সেবারই প্রথম গিয়েছি মুর্শিদাবাদে । অনেক কিছুই জানা নেই । জানতে চাইলাম সেটা আবার কী ? সামাদ আলী বললেন, সেটা মীরজাফরের সমাধি । এটাকে মানুষ নিমকহারামের দেউড়ি বলেই জানে । এ নামেই তার পরিচিতি । বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের বাড়িটিকেই মানুষ নাম দিয়েছে নিমকহারামের দেউড়ি । তবে এখানে কেউ আসে না । যারা আসে তারা থুথু দিয়ে যায় । সামাদ আলীকে বললাম, চলুন আমি যাব । যার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে আমাদের প্রায় দুইশ’ বছর ব্রিটিশের দাসত্ব করতে হল, যাদের হাত থেকে এই দেশ মুক্ত করতে হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হল, পঙ্গুত্ব বরণ করতে হল, সেই বিশ্বাসঘাতকের বাড়িটা অবশ্যই দেখা দরকার । থুথু নয়, চলুন ওই বাড়ির দেওয়ালে একটি লাথি মেরে যাই । সামাদ আলী নিয়ে গেলেন সেখানে । পুরনো জরাজীর্ণ একটি বাড়ি, বলতে গেলে ধ্বংসাবশেষ । বাড়ির পাশেই ছোট একটি সাইনবোর্ড লেখা নিমকহারামের দেউড়ি । ওটা দেখে ফিরতে দেরি হয়ে গেল । ট্রেনের টিকেট কাটা ছিল, মিস হয়ে গেল । অনেক কষ্ট করে ভোরের ট্রেনেরে একটি টিকেট জোগাড় করলাম ।
ট্রেন মিস করে ভালোই হল । হাতে তখন অনেক সময় । সামাদ আলীকে বললাম, একজন লোকের কাছে নিয়ে যেতে, যার কাছ থেকে মুর্শিদাবাদের পল্প শোনা যাবে । সামাদ আলী বলছিলেন, ভাই এমন কাউকে তো আমি চিনি না । তবে একজন স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে । তার কাছে যেয়ে দেখতে পারেন, নাম সারোয়ার আলী । সরকারি কলেছের শিক্ষক ।
বললাম, চলুন যাব তার কাছে । তিনি বাড়ির সামনে চেয়ারে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন । হাজারদুয়ারী থেকে নিমকহারামের দেউড়ি কোথায় কোনটা আছে, সেগুলোর একটা ভালো বর্ণনা শুনলাম তার কাছ থেকে । বাকি যা বললেন তার অনেক কিছুই জানা ।
শুরুটা নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর থেকে । মীরজাফরকে ব্রিটিশরা জোর করে নবাবি থেকে সরিয়ে দিলেও পরবর্তীকালে মীরজাফরের বংশধরদের রাষ্ট্রীয় ভাতা দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার । এটাকে মুর্শিদাবাদের শিক্ষিত সমাজ অভিহিত করে বেইমানি ভাতা বলে । ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে গেলেও মুর্শিদাবাদে বসবাসকারী মীরজাফরের বংশধররা এখনও সে ভাতা পায় । ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে ভারত সরকার চালু রেখেছে সে ভাতা । তবে নবাবের উত্তরাধিকার হলেও সিরাজউদ্দৌলার বংশধরদের কেউ সে ভাতা পায়নি । সারোয়ার আলীর কাছ থেকে নতুন করে শুনে বিষয়টি ঝালাই করে নিলাম, পাকিস্থানের প্রথম দিকের প্রেসিডেন্ট ইষ্কান্দার মীর্জা, যার মাধ্যমে সদ্য নতুন পাকিস্থানের গণতন্ত্র নিহত হয়েছিল । সেই ইষ্কান্দার মীর্জা ছিলেন মীরজাফরের বংশধর । ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ইরাক যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি সাড়া জাগানো প্রতিবেদন করেছিলেন । সাদ্দাম হোসেন তার যেসব উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার ওপর নির্ভর করতেন, যাদের ওপর ভরসা করে যুদ্ধের দায়িত্ব তাদের দিয়েছিলেন, তাদের অন্যতম একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন মীরজাফরের বংশধর । মীরজাফরের পূর্বপুরুষরা আদতে ইরানের লোক । ইরান থেকে তারা এসেছিল ভারতে । অন্যদিকে ওই সেনা কর্মকর্তার পূর্বপুরুষরা ইরান থেকে এসেছিল ইরাকে । যুদ্ধ শুরুর পরপরই ওই সেনা কর্মকর্তা হাত মিলিয়েছিলেন মার্কিনিদের সঙ্গে । পাচার করে দিয়েছিলেন যুদ্ধের সব পরিকল্পনা । সে কারণে যুদ্ধ শুরুর আগে বিনাযুদ্ধে প্রায় পরাজিত হলেন সাদ্দাম হোসেন ।
কয়েক বছর আগে । ঢাকার সাংবাদিক বন্ধু সারোয়ার হোসেন একদিন বললেন, এই ঢাকা শহরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর বসবাস করছে । দেখুন তো একটা সূত্র ধরে তাদের কাছে পৌছানো যায় কি না ? আমি লেগে পড়লাম । কয়েক দিনের মধ্যেই একটি সূত্র পেয়ে গেলাম ।
সিরাজউদ্দৌলার বংশধর আরেব; কথা হল তার সঙ্গে । বাসায় যেতে বললেন । ঠিকানা দিলেন । অতীব ভদ্রলোক । পিতামাতা, ভাইবোন নিয়ে থাকেন ঢাকাতে । বাবা ছিলেন বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী । এখন অবসরপ্রাপ্ত । সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে আসেন তারা, উঠেন খুলনাতে । সেখান থেকে ঢাকায় । বর্তমানে বসবাস করছেন রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় । সিরাজউদ্দৌলা পরিবারের নবম পুরুষ সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেবের সঙ্গে কথা হয় তার বাসায় আরও কয়েক বছর আগে । এরাই যে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর, সেটা প্রমাণ করতে কয়েকবার কথা বলেছি তাদের পরিবারের সঙ্গে । প্রাসঙ্গিক বেশ কিছু ডকুমেন্টও নেড়েচেড়ে দেখেছি । আবার নবাব সিরাজের উত্তরাধিকার নিশ্চিত হতে এই ঢাকা শহরে বসবাসকারী মীরজাফরের বংশধরদের সঙ্গেও কথা বলেছি । তারাও স্বীকার করেছেন সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেবরা সিরাজউদ্দৌলার বংশধর । মজার ব্যাপার হল, মীরজাফরের বংশধররা বেশ গর্বভরেই উচ্চারণ করেন, তারাও নবাবের উত্তরাধিকার । ঘটনা তো সত্য । ব্রিটিশদের সহযোগীতা করার কারণে তারা মীরজাফরকেও নবাব করেছিল কিছুদিনের জন্য ।
নবাব সিরাজের মৃত্যুর পর তার পরিবারের ওপর ব্রিটিশ শাসকরা অবিচার করেছে, তবে সে নির্যাতনের মাত্রা যে এতটা ভয়াবহ, তা জানা ছিল না । নবাব পরিবারের একটি ডকুমেন্ট দেখে হতবাক হতে হয়েছিল । সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর থেকে তাদের বংশধর ও নিকটাত্মীয়দের জন্য সব ধরণের সরকারী চাকরি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল । সিরাজের মৃত্যুর অনেক বছর পর তার পঞ্চম বংশধর সৈয়দ জাকি রেজাকে ব্রিটিশ সরকার মুর্শিদাবাদের ডেপুটি সাবরেজিষ্ট্রার পদে একটি চাকরি দিয়েছিল । সে চাকরিটা দেওয়া হয়েছিল ঢাকার নবাব স্যার সলিমউল্লাহর অনুরোধে । স্যার সলিমউল্লাহ সৈয়দ জাকি রেজার চাকরির আবেদনের ওপর সুপারিশে লিখেছিলেন, ‘তিনি সিরাজউদ্দৌলার বংশধর হলেও শিক্ষিত ও ভালো লোক । তাকে একটি সরকারি চাকরি দেওয়ার অনুরোধ করছি ।
ইতিহাসের একটি বিষয় আজও ঘোলাটে হয়ে আছে । অনেকে উল্লেখ করেছেন সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর তার নানি আলীবর্দী খাঁর স্ত্রী শরিফুন নেসাসহ সিরাজের মা আমেনা বেগম, স্ত্রী লুৎফননেছাসহ পরিবারের অন্যদের বুড়িগঙ্গায় নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করেছিল । তবে ইতিহাসের এ দাবিটি ধোপে টিকে না । এখনও মুর্শিদাবাদের খোশবাগে আলীবর্দী খাঁর স্ত্রীর কবর আছে । আমেনা বেগমের কবর আছে । এ ছাড়াও দেখা যায় সিরাজের মৃত্যুর প্রায় পনের বছর পর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুননেছাকে সরকারি কিছু ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল । তবে তিনি ব্রিটিশদের সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি । বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে তাদের হত্যা করা হলে নিশ্চয়ই মুর্শিদাবাদে তাদের কবর হওয়ার কথা নয় ।
সিরাজের পতনের পর প্রায় আট বছর তার স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল ঢাকার অদূরে বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পাড়ে জিঞ্জিরা এলাকায় । সেখান থেকে কয়েক দফায় তাদেরকে মুক্তি দিয়ে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয় ।
নবাব পরিবারের পারিবারিক ও ইতিহাস সূত্রে পাওয়া যায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার কোনো পুত্রসন্তান ছিল না । তার ছিল একমাত্র কন্যা । এই কন্যা উম্মে জহুরা ওরফে কুরসিয়া বেগমের জন্য আহার জোগাড় করতে গিয়েই ভগবান গোলার ভন্ডপীরের গোপন ষড়যন্ত্রে ধরা পড়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলা । নবাবের এই কন্য উম্মে জহুরার সঙ্গে বিয়ে হয় সিরাজের আপন ভাই ইকরামউদ্দৌলার ছেলে মুরাদউদ্দৌলার । তাদের সন্তান হলেন শমসের আলী খান । শমসের আলী খানের সন্তান হচ্ছেন সৈয়দ লুৎফে আলী । তার কোনো পুত্র ছিল না । তার একমাত্র কন্যা ছিলেন ফাতেমা বেগম । ফাতেমা বেগমের একমাত্র কন্যা হলেন হাসমত আরা বেগম । হাসমত আরা বেগমের পুত্র হচ্ছেন সৈয়দ জাকি রেজা, নবাব সলিমউল্লার অনুরোধে ব্রিটিশ সরকার যাকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছিল । সৈয়দ জাকি রেজার সন্তান সৈয়দ গোলাম মোর্তজা দেশভাগের সময় মুর্শিদাবাদ থেকে চলে আসেন খুলনাতে । তার ছেলে সৈয়দ গোলাম মোস্তফা চাকরি করতেন বিদ্যুৎ উন্নয়ণ বোর্ডে, প্রকৌশলী পদে । এখনও জীবিত আছেন তিনি, বসবাস করছেন ঢাকা শহরে । সৈয়দ গোলাম মোস্তফার ছেলে সৈয়দ গোলাম আব্বাস ঢাকায় জড়িত আছেন সমাজকর্মের সঙ্গে । তার অন্য ভাইয়েরা চাকরি করেন । ঢাকার একটি সামাজিক সংস্থা গোলাম আব্বাস আরেবের উপাধি দিয়েছে নবাবজাদা বলে ।
যে কথা বলছিলাম । কলকাতা হাইকোর্টের একটি রায়ের কথা । সেখানে মীরজাফরের বংশধরদের মুর্শিদাবাদের নবাবির বৈধ উত্তরাধিকার বলে রায় দেওয়া হয়েছে । আদালতে এমন রায় প্রথম হলেও নবাব সিরাজের পতনের পর থেকেই মীরজাফরের বংশধরদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকাতা দেওয়া হয়েছে । ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে ভাতা দিয়েছে, সরকারি সে ভাতা অব্যাহত থেকেছে বর্তমান ভারতেও । আছে এখনও । সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন না । তাদের পূর্বপুরুষ বাংলায় এসেছিল ইরান থেকে । তবে তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন । বাঙালিয়ানার প্রভাব ছিল তার সব আচরণে । তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন বাংলাকে স্বাধীন রাখতে, কিন্তু পারেননি মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে । আজও উপমহাদেশের মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে সিরাজউদ্দৌলা হয়েছেন স্বাধীনতার প্রতীক, অন্যদিকে মীরজাফর নামটি গালিতে পরিণত হয়েছে । মুর্শিদাবাদের খোশবাগে গেলে মানুষ সিরাজের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়, থুথু দেয় মীরজাফরের কবরে । এটি ইতিহাসের নিয়তি হলেও আজও বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশে ভালো আছেন মীরজাফরের বংশধররা । এই ঢাকাতেও আছেন মীরজাফরের বংশধর, আছেন বেশ দাপটে । অন্যদিকে ঢাকা শহরে অনেকটা আত্মগোপনেই থাকেন সিরাজউদ্দৌলার বংশধররা ।
সূত্রঃ সকালের খবর, ৮ম পৃষ্ঠা, তাং ১১ মে ২০১৬ ।
তথ্য সংগ্রকারী, লেখক ও সাংবাদিক, লায়েকুজ্জামান ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৬ দুপুর ২:৫৬