সাইকেলের বেলের টুং টাং শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন রোকেয়া বেগম।
-আসসালামু আলাইকুম.....।
-ওয়া আলাইকুস সালাম....।
-কেমন আছেন খালা? শরীর-মন ভালো তো?
-তুমি যেভাবে সব সময় খোঁজ খবর নিচ্ছ, তাতে ভালো না থেকে পারি! তা তুমি কেমন আছো বাবা?
-জ্বি খালা, ভালো আছি। তবে ছোট মেয়েটার দুই দিন ধরে জ্বর। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছেন এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হবে।
খালা, আরিয়ান স্কাইপিতে ভিডিও চ্যাটিং-এ আপনার সাথে একটি মেয়ের পরিচয় করিয়ে দেবে।
-ভিডিও চ্যাটিংয়ের বিষয়টি রোকেয়া বেগমের কাছে একেবারে নতুন। তাই ছেলে আরিয়ানের সাথে ভিডিও কনফারেন্স ও একটি মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে এটা ভেবে তিনি তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ চালু করতে বললেন। স্কাইপিতে আরিয়ানের সাথে কথোপকথন চলছে।
- মা, তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
- আফছা আফছা দেখা যাচ্ছে। ভূত না মানুষ বোঝা যাচ্ছে না।
- হা... হা.... মা, নেটওয়ার্ক সমস্যা তো তাই ঠিকমতো সংযোগ পাচ্ছে না। সে কারণে এমনটা হচ্ছে।
-আচ্ছা, তুই নাকি কোন মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিবি? তো মেয়েটাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
-মা, ও বাথরুমে গেছে। ফিরে আসলে কথা বলিয়ে দেবো। তুমি ভালো আছ তো!
- হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। তোর বন্ধু নির্জন সব সময় আমার খোঁজ খবর নিচ্ছে। আচ্ছা, ওই মেয়েটা কে রে?
-মা, ওর কথা তোমাকে অনেকবার বলেছি। তুমি তো ওর সাথে কয়েকবার কথাও বলেছ। ওকে আমি পছন্দ করি। ওকে আমি বিয়ে করবো। তারপর তোমাকে শহরে নিয়ে আসবো।
- মেয়েটা বুঝি অনেক ভালো, তাই নারে!
- হ্যাঁ মা, ও অনেক ভালো মেয়ে। এই ফেইসবুক, ই-মেইলের যুগে এমন সাদা-মাটা মেয়ে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। ওর নাম তিথি। মা, ও এসেছে। ওর সাথে কথা বলো।
- দে দে, একটু দেখি। হ্যালো... হ্যালো...।
- মা, তোমাকে দেখা যাচ্ছে না তো! হ্যালো... হ্যালো...।
নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে স্কাইপ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কয়েকবার চেষ্টা করেও সংযোগ দেওয়া সম্ভব হলো না। আরিয়ান ফোন দেয় তার মার কাছে। মা, আজ তো দেখতে পেলে না! অন্য দিন তোমাকে দেখাবো। মা, ওর একটি ছবি পাঠাচ্ছি। তুমি আপাতত ছবি দেখে নিও।
- ঠিক আছে বাবা, তুই ভালো থাকিস।
নির্জন তার ই-মেইল ঠিকানা থেকে ছবিটি ডাউনলোড করার পর প্রিন্ট দিয়ে নিয়ে আসে। ছবিটি দিয়ে সালাম জানিয়ে বিদায় নেয়।
আরিয়ানদের পৈত্রিক বাড়ি রাজশাহী। নলডাঙ্গা গ্রামে। আরিয়ানের পাঠানো ছবিটি দেখছেন রোকেয়া বেগম। ছবিটির মানুষটার পাশে গা ঘেঁষে বসে আছে আরিয়ান। মানুষ দুটোকে অনেক আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। রোকেয়া বেগম মনে মনে ভাবছেন- দেখতে দেখতে আরিয়ানটা অনেক বড় হয়ে উঠেছে। আজ নিজের কাছে তার অনেক ভালো লাগছে। হালকা লাগছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে উঠোনের নিম গাছটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবেন- আরিয়ানেরর বাবা মারা যাবার বার বছর পার হলো। তিলে তিলে অনেক পরিশ্রম করে আরিয়ানকে মানুষ করেছি। অনেক দিন পার হলো আরিয়ান বাড়িতে আসেনি। আমার রান্না করা তার প্রিয় তেলাপিয়া মাছ ভাজা, মুরগির মাংসের মালাইকারি খায়নি। কাছে বসিয়ে আদর করে খাওয়াইনি। সে কথা মনে করে চোখের কোনায় পানি আসে। এই চোখের পানির মধ্যেই সে অন্য রকম এক সুখ বোধ করেন।
আজ বিরোধীদলের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালের দ্বিতীয় দিন চলছে। সূর্যের খা খা রোদ। প্রেসক্লাব রোডে রাস্তায় হালকা ও মাঝারী যানবাহন দু একটা যাওয়া-আসা করতে দেখা যাচ্ছে। দলীয় নেতা-কর্মীরা লাঠি-সোঠা নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। পিকেটারদের মিছিল চলছে ক্ষণে ক্ষণে। আরিয়ান ও তার সহকর্মী সাংবাদিক জয়ন্ত, মল্লিকা, সুমন প্রেসক্লাবের সামনের রোড দিয়ে পল্টনের দিকে এগোচ্ছে। আরিয়ানের ফোনটা বেজে ওঠে। তার মা ফোন দিয়েছে।
মা’র সাথে কথা বলছে আরিয়ান- মা, তিন দিনের ছুটি পেয়েছি। আমি আগামীকাল সকালে রওনা দেবো। রাতে তোমার কাছে পৌঁছে যাবো। মা, আমি ফ্রি হয়ে তোমাকে ফোন দিচ্ছি। এখন রাখছি। মা’র সাথে কথা শেষ করে আরিয়ান তার সহকর্মীদের সঙ্গে কথোপকথনে যোগ দেয়।
জয়ন্ত- সাংবাদিকতার এই চাকরিটা আর ভালো লাগছে না। ভাবছি- বেশি দিন আর করবো না।
মল্লিকা- তুই ঠিক বলেছিস। আমারও না বিতৃষ্ণা-বিরক্তি এসে গেছে। সারাদেশে হরতালে মানুষ মারা যায়। গাড়ী পোড়ানো হয়। আর তার সাথে আমরা নিজেরাও পুড়ছি প্রতিনিয়ত। হঠাৎ সুমন পেছনে তাকিয়ে দেখে আরিয়ান নেই। সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলার আগেই আরিয়ানের চিৎকার শোনা গেলো। ওরা সবাই পেছনে প্রেসক্লাবের রাস্তার দিকে তাকালো। আরিয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে আসলো।
সুমন- কি হয়েছে রে আরিয়ান?
আরিয়ান- বিরোধীদলের একটি মিছিল এদিকেই আসছে। তারা দুটো মাইক্রোবাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চল আমরা পল্টন মোড়ে যাই। তার কথায় সবাই সম্মত হলো। পল্টনে পুলিশ বেড়িকেট দিয়ে রেখেছে। জয়ন্ত বেড়িকেটের কয়েকটা ছবি তুললো। আরো কয়েকজন সাংবাদিক জড়ো হলো সেখানে। তারাও ছবি তুললো। বেড়িকেটের ছবি তোলা দেখে পুলিশের এক কর্মকর্তা চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকালো। রাজউক ভবনের রাস্তা দিয়ে সরকারি দলের একটি মিছিল পল্টনের দিকে আসছে। মল্লিকা দেখলো পেছনের মিছিলটাও পল্টনের দিকে ধেয়ে আসছে। সরকারি দলের মিছিলকারীরা ও পুলিশ মিলে বেড়িকেট সরিয়ে বিরোধী দলের মিছিলে ধাওয়া করলো। মুহূতেই বিরোধী দলের মিছিলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। পুলিশের এক কর্মকর্তা চোখ গরম করে সাংবাদিকদের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে নির্দেশ দিলো- ধর শালাদের! সাংবাদিকরা কিছু বলার আগেই ওদেরকে জোর করে লাঠি দিয়ে পেটাতে পেটাতে গাড়িতে তুললো। গাড়ির মধ্যে আরিয়ান পুলিশের ওই কর্তাকে বললো- দেখুন, আমরা সাংবাদিক। আমাদের পেটাচ্ছেন কেন? এ কথা শুনে পুলিশের ওই কর্তা গর্জে ওঠে- চুপ শালা! পাছার মধ্যে গরম ডিম ঢুকিয়ে দিলে সাংবাদিকগিরি ছুটিয়ে দিবো।
সন্ধে হয়ে আসছে। সারাবেলা কারো কিছু খাওয়া হয়নি। সবার মোবাইল কেড়ে নিয়েছে ওরা। বাইরে কারো সাথে যোগাযোগও করতে দেয়নি। মাগরিবের আযানের দশ মিনিট আগে পুলিশ জয়ন্ত, মল্লিকা, সুমনকে ছেড়ে দেয়। আরিয়ানকে কেনো ছেড়ে দেওয়া হবে না? মল্লিকা এ প্রশ্ন করতেই পুলিশের এক কর্তা আঙ্গুল তাক করে চেঁচিয়ে ওঠে- ওই মাগী! তোরে ছাইড়্যা দিছি না! যা ফোট! কথাটা শোনামাত্র সুমন ওই পুলিশের কর্তার গালে জোরে একটা চড় বসিয়ে দেয়। এরপর সুমনকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়ে পিকআপ ভ্যানের মধ্যেই পেটাতে থাকে। পুলিশ এক ঘণ্টা পর আরিয়ান ও সুমনকে ছেড়ে দিলো।
আজ বিরোধীদলের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালের তৃতীয় দিন চলছে। দূর পাল্লার বাস চলাচল বন্ধ। আরিয়ান তার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট কেটে রেখেছিল তিন দিন আগে। ট্রেনের ছ বগির চেয়ার কোচের তেত্রিশ নাম্বার আসনে বসে আছে। নির্দিষ্ট সময়ের আড়াই ঘণ্টা পর ট্রেন ছেড়ে দেয়। আরিয়ান তার ট্রাভেল ব্যাগ থেকে নিজের লেখা একটি পাণ্ডুলিপি বের করে। পাণ্ডুলিপির শিরোনাম ‘মা ও আমি’। বইটি এবার একুশের বইমেলায় বের হবে। পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশনীতে দেওয়ার আগে মা’কে পড়ে না শোনালে রুমেল কিছুতেই তৃপ্তি পাচ্ছে না। তাই বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের পাণ্ডুলিপিটি নিজেই যত পড়ছে ততই নিজের কাছে ভালো লাগছে তার। পান্ডুলিপিটি পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে রুমেল। মানুষের আর্ত-চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে তার। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে পাশের বগিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ট্রেনটি ছুটে চলছে। বাঁচার জন্য ট্রেনের দরজা-জানালা দিয়ে মানুষ লাফাচ্ছে। শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে শুরু করে সব মানুষের কান্না ও চিৎকারে বাতাস গম গম করছে। ট্রেনের ভেতরে আগুন আরো ভারি হচ্ছে। হঠাৎ ট্রেনটি লাইনচ্যূত হয়ে পড়ে যায় পাশের ধানের জমিতে। আরিয়ান ধাক্কা খায় ট্রেনের লোহার জানালার সাথে।
আরিয়ান গোঙাচ্ছে। তার কোমর থেকে নিচের দিকের অংশ চেয়ারের সাথে আটকে আছে। নড়াচড়া করতে পারছে না। কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। মাথাটা নিচের দিকে টানছে। দূরে শোনা যাচ্ছে মানুষের কান্নার দীর্ঘতা। এই বগিতে মানুষ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু চোখ যতদূর যায় কারো কোনো অস্তিত্ব পেলো না। ট্রেনের বাইরে থেকে মানুষের আওয়াজ এলো- হরতালকারীরা রেললাইনের ফিস প্লেট ও স্লিপার খুলে দিয়েছে এবং ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
আরিয়ান অনুভব করছে- তার চোখের পাতার ওপর যেন কেউ বসে আছে। তার দেহের রক্ত শীতল হয়ে আসছে। পান্ডুলিপিটি চেয়ারের চিপায় আটকে গেছে। পান্ডুলিপিটি বা হাত দিয়ে টান দিতেই কিছু অংশ ছিঁড়ে আসলো। মা’কে মনে করে তার ভেতরের মানুষটা ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ভেতরে ভেতরে নদীর পাড় ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পেলো। তার মনে হলো সে যেন বিশাল সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা লাগছে। নিকস কালো রাত যেন চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে। অন্ধকার আকাশে ছোট্ট একটা তারার অস্তিত্ব খুঁজে পেলো সে। তারাটি একবার জ্বলছে আরেকবার নিভছে। তার কেবলি মনে হলো- সে নলডাঙ্গা গ্রামের একটা গম ক্ষেতে তার মা’র হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হিংস্র জানোয়ারগুলো গম ক্ষেতে মা ও আরিয়ানের দিকে ধেয়ে আসছে। বাঁচার আকাঙ্খায় মা’কে নিয়ে প্রাণপণ দৌঁড়াচ্ছে। রাত গভীর হয়ে আসছে। হঠাৎ তার দু’হাতে পাখা গজায়। সে পৃথিবীর অন্ধ আকাশে উড়তে থাকে। পাখায় ভর করে সে কেবল শূন্যে ভাসে। এক সময় পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে।
রাতের প্রথম প্রহর। ঘন কুয়াশা ঘিরে ফেলেছে নলডাঙ্গা গ্রাম। বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়ে একটা পেঁচা ডেকে উঠলো কয়েকবার। আঙিনায় শোনা গেলো একটা নেড়ি কুত্তার আর্তনাদ। একটা বনবিড়াল থাবা দিয়ে মা মুরগীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেলো বাচ্চা মোরগটাকে। শোনা গেলো মা মুরগীর কাতরোক্তি। ঘরের চৌকি ছেড়ে উঠে বসেন আরিয়ানের মা। বাইরে হু হু করে বাতাস বইছে। দূরে শোনা গেলো ট্রেনের হুইসেল। আর আরিয়ানের আসার অপেক্ষায় বসে থাকলেন মা রোকেয়া বেগম।
সাইকেলের বেলের টুং টাং শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন রোকেয়া বেগম।
-আসসালামু আলাইকুম.....।
-ওয়া আলাইকুস সালাম....।
-কেমন আছেন খালা? শরীর-মন ভালো তো?
-তুমি যেভাবে সব সময় খোঁজ খবর নিচ্ছ, তাতে ভালো না থেকে পারি! তা তুমি কেমন আছো বাবা?
-জ্বি খালা, ভালো আছি। তবে ছোট মেয়েটার দুই দিন ধরে জ্বর। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছেন এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হবে।
খালা, আরিয়ান স্কাইপিতে ভিডিও চ্যাটিং-এ আপনার সাথে একটি মেয়ের পরিচয় করিয়ে দেবে।
-ভিডিও চ্যাটিংয়ের বিষয়টি রোকেয়া বেগমের কাছে একেবারে নতুন। তাই ছেলে আরিয়ানের সাথে ভিডিও কনফারেন্স ও একটি মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে এটা ভেবে তিনি তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ চালু করতে বললেন। স্কাইপিতে আরিয়ানের সাথে কথোপকথন চলছে।
- মা, তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
- আফছা আফছা দেখা যাচ্ছে। ভূত না মানুষ বোঝা যাচ্ছে না।
- হা... হা.... মা, নেটওয়ার্ক সমস্যা তো তাই ঠিকমতো সংযোগ পাচ্ছে না। সে কারণে এমনটা হচ্ছে।
-আচ্ছা, তুই নাকি কোন মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিবি? তো মেয়েটাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
-মা, ও বাথরুমে গেছে। ফিরে আসলে কথা বলিয়ে দেবো। তুমি ভালো আছ তো!
- হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। তোর বন্ধু নির্জন সব সময় আমার খোঁজ খবর নিচ্ছে। আচ্ছা, ওই মেয়েটা কে রে?
-মা, ওর কথা তোমাকে অনেকবার বলেছি। তুমি তো ওর সাথে কয়েকবার কথাও বলেছ। ওকে আমি পছন্দ করি। ওকে আমি বিয়ে করবো। তারপর তোমাকে শহরে নিয়ে আসবো।
- মেয়েটা বুঝি অনেক ভালো, তাই নারে!
- হ্যাঁ মা, ও অনেক ভালো মেয়ে। এই ফেইসবুক, ই-মেইলের যুগে এমন সাদা-মাটা মেয়ে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। ওর নাম তিথি। মা, ও এসেছে। ওর সাথে কথা বলো।
- দে দে, একটু দেখি। হ্যালো... হ্যালো...।
- মা, তোমাকে দেখা যাচ্ছে না তো! হ্যালো... হ্যালো...।
নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে স্কাইপ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কয়েকবার চেষ্টা করেও সংযোগ দেওয়া সম্ভব হলো না। আরিয়ান ফোন দেয় তার মার কাছে। মা, আজ তো দেখতে পেলে না! অন্য দিন তোমাকে দেখাবো। মা, ওর একটি ছবি পাঠাচ্ছি। তুমি আপাতত ছবি দেখে নিও।
- ঠিক আছে বাবা, তুই ভালো থাকিস।
নির্জন তার ই-মেইল ঠিকানা থেকে ছবিটি ডাউনলোড করার পর প্রিন্ট দিয়ে নিয়ে আসে। ছবিটি দিয়ে সালাম জানিয়ে বিদায় নেয়।
আরিয়ানদের পৈত্রিক বাড়ি রাজশাহী। নলডাঙ্গা গ্রামে। আরিয়ানের পাঠানো ছবিটি দেখছেন রোকেয়া বেগম। ছবিটির মানুষটার পাশে গা ঘেঁষে বসে আছে আরিয়ান। মানুষ দুটোকে অনেক আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। রোকেয়া বেগম মনে মনে ভাবছেন- দেখতে দেখতে আরিয়ানটা অনেক বড় হয়ে উঠেছে। আজ নিজের কাছে তার অনেক ভালো লাগছে। হালকা লাগছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে উঠোনের নিম গাছটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবেন- আরিয়ানেরর বাবা মারা যাবার বার বছর পার হলো। তিলে তিলে অনেক পরিশ্রম করে আরিয়ানকে মানুষ করেছি। অনেক দিন পার হলো আরিয়ান বাড়িতে আসেনি। আমার রান্না করা তার প্রিয় তেলাপিয়া মাছ ভাজা, মুরগির মাংসের মালাইকারি খায়নি। কাছে বসিয়ে আদর করে খাওয়াইনি। সে কথা মনে করে চোখের কোনায় পানি আসে। এই চোখের পানির মধ্যেই সে অন্য রকম এক সুখ বোধ করেন।
আজ বিরোধীদলের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালের দ্বিতীয় দিন চলছে। সূর্যের খা খা রোদ। প্রেসক্লাব রোডে রাস্তায় হালকা ও মাঝারী যানবাহন দু একটা যাওয়া-আসা করতে দেখা যাচ্ছে। দলীয় নেতা-কর্মীরা লাঠি-সোঠা নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। পিকেটারদের মিছিল চলছে ক্ষণে ক্ষণে। আরিয়ান ও তার সহকর্মী সাংবাদিক জয়ন্ত, মল্লিকা, সুমন প্রেসক্লাবের সামনের রোড দিয়ে পল্টনের দিকে এগোচ্ছে। আরিয়ানের ফোনটা বেজে ওঠে। তার মা ফোন দিয়েছে।
মা’র সাথে কথা বলছে আরিয়ান- মা, তিন দিনের ছুটি পেয়েছি। আমি আগামীকাল সকালে রওনা দেবো। রাতে তোমার কাছে পৌঁছে যাবো। মা, আমি ফ্রি হয়ে তোমাকে ফোন দিচ্ছি। এখন রাখছি। মা’র সাথে কথা শেষ করে আরিয়ান তার সহকর্মীদের সঙ্গে কথোপকথনে যোগ দেয়।
জয়ন্ত- সাংবাদিকতার এই চাকরিটা আর ভালো লাগছে না। ভাবছি- বেশি দিন আর করবো না।
মল্লিকা- তুই ঠিক বলেছিস। আমারও না বিতৃষ্ণা-বিরক্তি এসে গেছে। সারাদেশে হরতালে মানুষ মারা যায়। গাড়ী পোড়ানো হয়। আর তার সাথে আমরা নিজেরাও পুড়ছি প্রতিনিয়ত। হঠাৎ সুমন পেছনে তাকিয়ে দেখে আরিয়ান নেই। সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলার আগেই আরিয়ানের চিৎকার শোনা গেলো। ওরা সবাই পেছনে প্রেসক্লাবের রাস্তার দিকে তাকালো। আরিয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে আসলো।
সুমন- কি হয়েছে রে আরিয়ান?
আরিয়ান- বিরোধীদলের একটি মিছিল এদিকেই আসছে। তারা দুটো মাইক্রোবাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চল আমরা পল্টন মোড়ে যাই। তার কথায় সবাই সম্মত হলো। পল্টনে পুলিশ বেড়িকেট দিয়ে রেখেছে। জয়ন্ত বেড়িকেটের কয়েকটা ছবি তুললো। আরো কয়েকজন সাংবাদিক জড়ো হলো সেখানে। তারাও ছবি তুললো। বেড়িকেটের ছবি তোলা দেখে পুলিশের এক কর্মকর্তা চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকালো। রাজউক ভবনের রাস্তা দিয়ে সরকারি দলের একটি মিছিল পল্টনের দিকে আসছে। মল্লিকা দেখলো পেছনের মিছিলটাও পল্টনের দিকে ধেয়ে আসছে। সরকারি দলের মিছিলকারীরা ও পুলিশ মিলে বেড়িকেট সরিয়ে বিরোধী দলের মিছিলে ধাওয়া করলো। মুহূতেই বিরোধী দলের মিছিলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। পুলিশের এক কর্মকর্তা চোখ গরম করে সাংবাদিকদের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে নির্দেশ দিলো- ধর শালাদের! সাংবাদিকরা কিছু বলার আগেই ওদেরকে জোর করে লাঠি দিয়ে পেটাতে পেটাতে গাড়িতে তুললো। গাড়ির মধ্যে আরিয়ান পুলিশের ওই কর্তাকে বললো- দেখুন, আমরা সাংবাদিক। আমাদের পেটাচ্ছেন কেন? এ কথা শুনে পুলিশের ওই কর্তা গর্জে ওঠে- চুপ শালা! পাছার মধ্যে গরম ডিম ঢুকিয়ে দিলে সাংবাদিকগিরি ছুটিয়ে দিবো।
সন্ধে হয়ে আসছে। সারাবেলা কারো কিছু খাওয়া হয়নি। সবার মোবাইল কেড়ে নিয়েছে ওরা। বাইরে কারো সাথে যোগাযোগও করতে দেয়নি। মাগরিবের আযানের দশ মিনিট আগে পুলিশ জয়ন্ত, মল্লিকা, সুমনকে ছেড়ে দেয়। আরিয়ানকে কেনো ছেড়ে দেওয়া হবে না? মল্লিকা এ প্রশ্ন করতেই পুলিশের এক কর্তা আঙ্গুল তাক করে চেঁচিয়ে ওঠে- ওই মাগী! তোরে ছাইড়্যা দিছি না! যা ফোট! কথাটা শোনামাত্র সুমন ওই পুলিশের কর্তার গালে জোরে একটা চড় বসিয়ে দেয়। এরপর সুমনকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়ে পিকআপ ভ্যানের মধ্যেই পেটাতে থাকে। পুলিশ এক ঘণ্টা পর আরিয়ান ও সুমনকে ছেড়ে দিলো।
আজ বিরোধীদলের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালের তৃতীয় দিন চলছে। দূর পাল্লার বাস চলাচল বন্ধ। আরিয়ান তার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট কেটে রেখেছিল তিন দিন আগে। ট্রেনের ছ বগির চেয়ার কোচের তেত্রিশ নাম্বার আসনে বসে আছে। নির্দিষ্ট সময়ের আড়াই ঘণ্টা পর ট্রেন ছেড়ে দেয়। আরিয়ান তার ট্রাভেল ব্যাগ থেকে নিজের লেখা একটি পাণ্ডুলিপি বের করে। পাণ্ডুলিপির শিরোনাম ‘মা ও আমি’। বইটি এবার একুশের বইমেলায় বের হবে। পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশনীতে দেওয়ার আগে মা’কে পড়ে না শোনালে রুমেল কিছুতেই তৃপ্তি পাচ্ছে না। তাই বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের পাণ্ডুলিপিটি নিজেই যত পড়ছে ততই নিজের কাছে ভালো লাগছে তার। পান্ডুলিপিটি পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে রুমেল। মানুষের আর্ত-চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে তার। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে পাশের বগিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ট্রেনটি ছুটে চলছে। বাঁচার জন্য ট্রেনের দরজা-জানালা দিয়ে মানুষ লাফাচ্ছে। শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে শুরু করে সব মানুষের কান্না ও চিৎকারে বাতাস গম গম করছে। ট্রেনের ভেতরে আগুন আরো ভারি হচ্ছে। হঠাৎ ট্রেনটি লাইনচ্যূত হয়ে পড়ে যায় পাশের ধানের জমিতে। আরিয়ান ধাক্কা খায় ট্রেনের লোহার জানালার সাথে।
আরিয়ান গোঙাচ্ছে। তার কোমর থেকে নিচের দিকের অংশ চেয়ারের সাথে আটকে আছে। নড়াচড়া করতে পারছে না। কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। মাথাটা নিচের দিকে টানছে। দূরে শোনা যাচ্ছে মানুষের কান্নার দীর্ঘতা। এই বগিতে মানুষ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু চোখ যতদূর যায় কারো কোনো অস্তিত্ব পেলো না। ট্রেনের বাইরে থেকে মানুষের আওয়াজ এলো- হরতালকারীরা রেললাইনের ফিস প্লেট ও স্লিপার খুলে দিয়েছে এবং ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
আরিয়ান অনুভব করছে- তার চোখের পাতার ওপর যেন কেউ বসে আছে। তার দেহের রক্ত শীতল হয়ে আসছে। পান্ডুলিপিটি চেয়ারের চিপায় আটকে গেছে। পান্ডুলিপিটি বা হাত দিয়ে টান দিতেই কিছু অংশ ছিঁড়ে আসলো। মা’কে মনে করে তার ভেতরের মানুষটা ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ভেতরে ভেতরে নদীর পাড় ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পেলো। তার মনে হলো সে যেন বিশাল সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা লাগছে। নিকস কালো রাত যেন চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে। অন্ধকার আকাশে ছোট্ট একটা তারার অস্তিত্ব খুঁজে পেলো সে। তারাটি একবার জ্বলছে আরেকবার নিভছে। তার কেবলি মনে হলো- সে নলডাঙ্গা গ্রামের একটা গম ক্ষেতে তার মা’র হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হিংস্র জানোয়ারগুলো গম ক্ষেতে মা ও আরিয়ানের দিকে ধেয়ে আসছে। বাঁচার আকাঙ্খায় মা’কে নিয়ে প্রাণপণ দৌঁড়াচ্ছে। রাত গভীর হয়ে আসছে। হঠাৎ তার দু’হাতে পাখা গজায়। সে পৃথিবীর অন্ধ আকাশে উড়তে থাকে। পাখায় ভর করে সে কেবল শূন্যে ভাসে। এক সময় পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে।
রাতের প্রথম প্রহর। ঘন কুয়াশা ঘিরে ফেলেছে নলডাঙ্গা গ্রাম। বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়ে একটা পেঁচা ডেকে উঠলো কয়েকবার। আঙিনায় শোনা গেলো একটা নেড়ি কুত্তার আর্তনাদ। একটা বনবিড়াল থাবা দিয়ে মা মুরগীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেলো বাচ্চা মোরগটাকে। শোনা গেলো মা মুরগীর কাতরোক্তি। ঘরের চৌকি ছেড়ে উঠে বসেন আরিয়ানের মা। বাইরে হু হু করে বাতাস বইছে। দূরে শোনা গেলো ট্রেনের হুইসেল। আর আরিয়ানের আসার অপেক্ষায় বসে থাকলেন মা রোকেয়া বেগম।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ রাত ১২:১২