ঈদের ছুটি শুরু হতে আর এক সপ্তাহ বাকি। সামাদ সাহেবের এখন অনেক ব্যস্ততা। হাতে তিন তিনটে প্রজেক্ট। সবগুলোর রানিং বিল জমা পড়েছে, ঠিকাদাররা ঈদের আগে টাকা চায়। কার ফাইল রেখে তিনি কার ফাইল ছাড়বেন? বড়ই পেরেশানি! তিনি অবশ্য কারো ফাইল আটকে ঘুষ নেন না। প্রত্যেক ঠিকাদার চাপাচাপ করে অন্যদের ফাইলের আগে তারটা ছাড়ার জন্য। কী যে যন্ত্রণা! গত বছরের মতো এবছরও তিনি প্রতি ফাইলের রেট ঠিক করে দিয়েছেন। পিয়ন সগির আলি খুবই করিৎকর্মা। ‘খামগুলো’ বেশ টেকনিক্যালি একটা পাটের ব্যাগে রাখছে। দূর থেকে ব্যাগটা দেখে মনে হবে ভেতরে লাঞ্চবক্স…।
…
দেখতে দেখতে সপ্তাহ শেষ! আজ শেষ অফিস। সকাল থেকে মনটা খুব ফুরফুরে হয়ে আছে সামাদ সাহেবের। কোন রকমে আজকের দিনটা পার করলেই ঈদের ছুটি। মেয়েটা বায়না ধরেছে কক্সবাজার যাবে ঈদের ছুটিতে। এবার আর বাসে নয়, এয়ারে যাবেন সপরিবারে। ঈদের পরদিন বিকেলে ফ্লাইট। টিকেট কাটা, হোটেল বুকিং সব করে দিয়েছে এক ঠিকাদার। আজ দুপুরের পর আর অফিস করলেন না সামাদ সাহেব। পাটের ব্যাগটার চেইন বন্ধ করে ড্রাইভারকে দিয়ে আগেই পাচার করলেন। একটুপর নিজেও বেরিয়ে পড়লেন।
…
শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে দ্রুত লাঞ্চ সারলেন সামাদ সাহেব। হাত ধুতে ধুতে বললেন, “বকুলের মা, টাকাটা বের কর। গরুটা আজ কিনেই আনি।”
“পাশের বাসার ডাক্তার সাহেব কিন্তু গত ঈদে মহল্লার সবচেয়ে বড় গরুটা কোরবানি দিয়েছেন। এবার যেন আমার মান থাকে” রাহেলা বেগম কড়া গলায় বলে দিলেন।
“আরে, উনাকে তো কোন ওষুধ কোম্পানী থেকে গরু দিছে। ওইটা দিয়ে কি কোরবানী হবে? এমব আল্লাহ পছন্দ করেন না।”
“আমি অত শত বুঝি না” রাহেলা বেগমের স্বর আরো এক স্কেল চড়ে।
বিগলিত হয়ে সামাদ সাহেব বললেন, “আচ্ছা, আচ্ছা। এবার মহল্লায় সবচেয়ে বড় গরুটা হবে আমাদের। খুশি?”
“হুহ, ঢং!” কপট রাগ দেখিয়ে আলমারি খুলে পাটের ব্যাগ থেকে হাজার টাকার নোটের একটা বান্ডিল বের করে দিলেন রাহেলা বেগম।
দেখে হা হা করে উঠলেন সামাদ সাহেব, “আরে, আরে, কর কী? কর কী? ঐ পাটের ব্যাগ থেকে দিও না। ওটা থাক। দেখ, একটা বড় খামে কিছু টাকা রাখা আছে, ওখান থেকে দাও।”
“কেন? এই ব্যাগের টাকা কি নকল?”
“আরে, এই টাকা দিলে কোরবানী দিলে কবুল হবে না। তুমি আমার ঈদ-বোনাসের টাকা থেকে দাও। ওইটা আমার হক্কের টাকা…”
আর কথা না বাড়িয়ে পাটের ব্যাগের টাকা সেখানে রেখে অন্য খামটা খুললেন রাহেলা বেগম।
…
গরুর হাটে এবার ইন্ডিয়ান গরু কম। সামাদ সাহেব আর ড্রাইভার মতিন মিয়া দুপুর থেকে গাবতলীর হাটে ঘুরছেন। দাম এবার বেশিই হাঁকছে ব্যাপারীরা। তাতে অবশ্য সামাদ সাহেবের সমস্যা নেই। এবার তাঁর বাজেট বেশি। ঘুরতে ঘুরতে, গোবরের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে তিনি আধবেলা পার করলেন। এর মধ্যে মতিন মিয়া গেল টয়লেটে। গেল তো গেল, আর আসার নাম নেই। একটু পর এক লোক ডাব নিয়ে হাজির।
“ডাব কেন?”
“আপনার ডেরাইভার পাঠাইছে, ছার। সেও ঐখানে খাইতেছে।” লোকটা পান-খাওয়া দাঁত বের করে হাসলো। সামাদ সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে অবশ্য মতিনকে দেখলেন না। তবে সে যে ডাব একা না খেয়ে একটা তাঁর জন্য পাঠিয়েছে, এতে বেশ তুষ্ট হলেন। ঈদে ওকে ছুটি দেওয়া হয়নি। কক্সবাজার যাবার আগে ওকে এবার বখশিশ বাড়িয়ে দিতে হবে। ডাবের পানি খাওয়ার পর পরই মনে হলো মাথার ওপর রোদটা খুব চড়েছে। একটু বসা দরকার। যে লোকটা ডাব এনে দিয়েছিল, সে বলল. “ছার কি একটু জিরাইবেন? আসেন, আমার সাথে আসেন।” হাঁটতে গিয়ে কি মাথাটা একটু ঘুরে উঠলো। নাকি কোন গরু তাঁকে পেছন থেকে গুঁতো দিলো? সামাদ সাহেবের মনে হলো পৃথিবীটা একটু দুলে উঠল। তারপর সব অন্ধকার।
…
সামাদ সাহেবের যখন জ্ঞান ফিরলো, তিনি তখন মিরপুরের একটা হাসপাতালে। তাঁর পাশের বেডে মতিন মিয়া তখনও অচেতন। সামাদ সাহেব অভিজ্ঞ লোক। তিনি আর মতিন যে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েছিলেন, সেটা বুঝতে সময় লাগলো না। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না, তিনি এখানে কীভাবে এলেন? ক’টা বাজে এখন? ঈদ কি হয়ে গেছে? গরু তো কেনা হলো না! বাড়ির সবাই কি জানে তাঁর খবর? পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন, মোবাইল ফোন, ওয়ালেট, কিচ্ছু নেই! আর গরু কেনার সেই টাকা? ওটাও নেই! হঠাৎ পাটের ব্যাগটার কথা মনে পড়ল সামাদ সাহেবের। ঈদের পর যার যার টাকা ফেরত দেবেন বলে মনস্থ করলেন সামাদ সাহেব।
- কাজী মিতুল
১০.৯.২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০১