১.
মায়ের ঘরে গভীর রাতে আলো জ্বলছে দেখে দরজার কাছে দাঁড়ালাম। মা কখনও দরজা বন্ধ করে ঘুমায় না। আমি দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই কীভাবে যেন টের পেলো। লেখার টেবিলে বসে, লেখা থেকে মুখ না তুলে বললো, কী রে, ঘুমুসনি?
- না। আমার তো এখনও ঘুমুবার সময় হয়নি। তোমার ব্যাপারটা কী, মা? এত রাত জাগছ আজ?
- ঘুম আসছিল না। তাই ভাবলাম, একটু লিখি। অনেকদিন ডায়েরী লেখা হয় না।
- কী লেখ? আমাকে দেখানো যাবে?
- নাহ। দেখানোর মতো কিছু না। কখনও তোর বাবাকে চিঠি লিখি, কখনও বা সারাদিনের বিশেষ কোন ঘটনা…
আমি এবার মায়ের বিছানায় গিয়ে বসলাম। মা ডায়েরীটা বন্ধ করে আমার দিকে মন দিলো। আমার মনটা হঠাৎ ভাল হয়ে গেলো। এই যে, সামান্যতম একটা ব্যাপার, আমি মায়ের ঘরে ঢুকেছি, মা আমার দিকে তার সবটুকু মনোযোগ দিচ্ছে, এটা স্বাভাবিক, তবু আমার খুব ভাল লাগলো। যেন, খুব বড় কিছু পেয়ে গেলাম।
কথাটা মা-কে বলতেই মা হেসে ফেললো। আমাকে কাছে টেনে একটু আদর করে দিলো। এই ২৩ বছর বয়সেও মায়ের আদর পেতে আমার খুব ভাল লাগে। আমি গলে গলে যাই, আমি ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে ঝরে পড়ি, আমি মেঘের মতো ভেসে ভেসে যাই।
এভাবে কাটে কয়েক মূহুর্ত। আমি মা-কে বললাম, আজ তুমি কী লিখছ, আমি জানি।
- কী, বলতো?
- আমার বিয়ের কথা। আজ তোমার মেয়ের বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল। এটা নিয়েই তুমি লিখছ। কী, ঠিক না?
- ঠিক। সত্যিই তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি রে, তিথি!
- ধুর, এইটুকু বুঝতে বেশি বুদ্ধি লাগে না। এবার তুমি ঘুমোও। কাল তোমার স্কুলে পরীক্ষার ডিউটি আছে। তোমার তো আর আমার ভার্সিটির মতো না, যে ইচ্ছে হলো, তো দেরি করে গেলাম…।
মা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন। আমার কথা শুনে আমাকে বিদায় করে ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি ফিরে গেলাম আমার ঘরে। একটু পর শিহাব ফোন করবে। আজ আমাদের সবচেয়ে আনন্দের দিন। আমাদের দুই বছরের প্রেম বিয়ের দিকে মোড় নিলো আজ। শিহাব বলেছে, এই উপলক্ষে সে আজ সারারাত কথা বলবে। কাল অফিস ছুটি নেবে, আমরা সারাদিন ঘুরবো।
শিহাবের কথা ভাবতে ভাবতেই ওর ফোনটা এলো। আমার মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে ওর হাসিমুখটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করছে না। ফোনটা ধরলেই তো ওর এই হাসিমুখটা দেখতে পাবো না।
শিহাবের এই সহজ সরল হাসি দেখে আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। ভালবেসে ফেলেছিলাম ওর সরলতা, সততা আর কবিতাকে। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে, আমার ভালবাসার মানুষটির ঘরণী হতে চলেছি খুব শিগগিরই…।
শিহাবের ধৈর্য আছে। ৪র্থ বার ও কল দিলো। ও জানে, আমি একবারে ওর ফোন ধরি না। ফোন বেজে চলেছে, ছবির শিহাব আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছি, তাকিয়ে আছি…।
২.
আমার বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে বেশ সাজ-সাজ রব। আমাদের মা-মেয়ের ছোট্ট সংসার। ভাইয়া থাকে কানাডায়। আমি আর মা থাকি দুই রুমের একটি ভাড়া-বাসায়। সেখানেই যেন আজ আনন্দের বন্যা। আমার খালাতো ভাই-বোনেরা দায়িত্ব নিয়েছে বাসাটাকে ঝেড়ে-মুছে “বিয়ে বাড়ি” বানাবার। হাই ভলিউমে গান বাজছে, রং-মিস্ত্রি কাজ করছে। আমাকে বলা হয়েছে ঘরে বসে থাকতে। বাইরে বের হওয়া বারণ। সামনের সপ্তাহে বিয়ে, তার পরের সপ্তাহে পরীক্ষা শুরু। বিয়ের চিন্তায় পড়াশোনা মাথায় উঠেছে, আর পরীক্ষার চিন্তায় বিয়েটাও ঠিকমতো উপভোগ করতে পারছি না । ছাতার এই বুয়েটে ৪ বছরের কোর্স ৫ বছরেও যেন শেষ হয় না। বিয়েটার তারিখ ঠিক হয়েছিল এমনভাবে, যেন আমার শেষ টার্ম ফাইনাল হয়ে যাবার পর বিয়েটা হয়। দু’দফা পরীক্ষা পিছিয়েছে। শিহাবের বাবা-মা বিয়ের তারিখ পেছাতে নারাজ। কাজেই, টার্ম ফাইনালের আগেই বিয়েটা হচ্ছে। হোক। বিয়ে উপলক্ষে না হয় আমার রেজাল্ট একটু খারাপ হবে। গোল্লায় যাক পড়াশোনা। আমি অত পড়ুয়া ছাত্রী নই, সি.জি.পি.এ. থ্রি এর নিচে নেমেছে শিহাবের প্রেমে পড়ার পর পর।
শিহাব আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র। “সিভিল ডে” উপল্ক্ষে কালচারাল প্রোগ্রামে আমার গানের সাথে আবৃত্তি করেছিল শিহাব। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আর নির্মলেন্দু গুণের কিছু কবিতার লাইন আর আমার গান নিয়ে একটা ফিউশনের মতো করেছিল শিহাব। সেই থেকে পরিচয়, তারপর প্রেম। পাশ করেই শিহাব চাকরি পেলো, একবার চাকরি বদল করল। বিদেশে পড়তে যাবার চেষ্টা করছে।এর মধ্যে বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল। বিয়েতে শুরুতে মত ছিল না শিহাবের বাবা-মায়ের। আমার মা-বাবার বিয়ে টেকেনি, এটাই আমার দোষ। অনেক চেষ্টায় পরিবারকে রাজী করিয়েছে শিহাব। সে সব মনে পড়ছে বলে কি না জানি না, এখন হঠাৎ আমার মনটা খারাপ লাগছে। শিহাবের সাথে দেখা হচ্ছে না, এটাও হয়তো মন খারাপের কারণ।
মন ভাল করতে আমি ঢুকলাম মায়ের ঘরে। মা ঘরে নেই। আজ স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হবে, সেটা বলেই গেছে সকালে। এই বিষন্ন দুপুরে আমি তাই মায়ের বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে আছি মায়ের বইয়ের তাকের দিকে। অনেক কবিতার বই, উপন্যাসের বই। শরৎচন্দ্র, শংকর, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সুচিত্রা, আশাপূর্ণা – এদেঁর বই যেমন আছে, তেমনি উঁকি দিচ্ছে হুমায়ূন আহমেদে, আনিসুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, আহমেদ ইউসুফ সাবের, তসলিমা নাসরিন, নাসরিন জাহান –এর বেশ কিছু বই। কিন্তু আমার নজর কাড়লো একটা নামহীন মলাট। হাতে নিয়ে দেখি, বই নয়, ডায়েরী। ১৯৯০ সালের।
ডায়েরীটা মায়ের। পড়ব? উচিত হবে? কৌতুহলের কাছে হার মানলো নৈতিকতা। তাছাড়া একান্ত ব্যক্তিগত হলে এটা বুক-শেল্ফ নয়, মায়ের ড্রয়ারে থাকতো। কাজেই এটা পড়লে অন্যায় কিছু হবে না। আমি পড়তে শুরু করলাম। শুরুর অনেকগুলো পাতা সাদা। প্রথম লেখাটা মার্চ মাসে:
২৯ মার্চ, ১৯৯০: হামিদ কি অন্য কাউকে ভালবাসে? এমন করে কেন ও আমার সাথে? আমার কোন কিছুই যেন আর ভাল লাগে না ওর। একসময় ও চাইতো, আমি সাজগোজ করি। এখন সাজলে বলে, কেন এত সাজি? স্কুলের পুরুষ সহকর্মীদের জন্যে কি সাজি আমি? একটা মেয়ে কি শুধু অপরের জন্যে সাজে? আজকাল হামিদের কথা আর ওর মায়ের কথার মধ্যে কোথায় যেন মিল খুঁজে পাই। শাশুড়ির মন যুগিয়ে চলার এত চেষ্টা করি, তবু আমার কত দোষ যে তাঁর চোখে পড়ে!
মায়ের ডায়েরীটায় বেশ কিছু কবিতা পেলাম। বেশিরভাগই রবীন্দ্রনাথের। এপ্রিলে মা আবার লিখেছেন:
১৪ এপ্রিল ১৯৯০: আজ পয়লা বৈশাখ। কত আনন্দ করব ভেবেছিলাম! কিন্তু কী হলো? সামান্য রান্না নিয়ে যে কী ভীষণ দুর্ব্যবহার করা যায়, তা কেউ যেন আমার শ্বাশুড়ীর কাছে শেখে! মা-কে বলেছিলাম, আমি আগে কখনও নোনা-ইলিশ রান্না করিনি। তিনি একবার বললেনও না কীভাবে রান্না করলে তাঁর পছন্দ হবে। আমি আমার বুদ্ধি দিয়ে চেষ্টা করলাম। ফলাফল নেতিবাচক। কষ্ট রাখার জায়গা পাই না, যখন মনে হয়, হামিদ আমার পক্ষ নিয়ে একটা কথাও বলল না ওর মা-কে। বরং আমার শ্বশুর অনেক ভাল। আব্বা না থাকলে হয়তো আজ আমাকে চুলের মুঠি ধরে বাড়ী থেকেই বের করে দিতো মা-ছেলে মিলে…।
মায়ের এইটুকু লেখা পড়ে আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমি জানি মায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। জানি, বাবার দ্বিতীয় বিয়ে করার পর মা আমাকে আর ভাইয়াকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। জানি, কী ভয়ংকর যুদ্ধ তাঁকে করতে হয়েছে একা হাতে আমাদের মানুষ করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসীর মাস্টার্স শেষ করে ভাইয়া স্কলারশীপ নিয়ে পড়তে গেছে কানাডায়। আমিও বুয়েটে পড়ছি প্রায় বিনা খরচে। আমাকে বিয়ে দিয়ে মা এবার বোধহয় একটু শান্তির মুখ দেখবেন।
কিছু পাতা পর একটা চিঠি পেলাম। বাবাকে লেখা:
১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯০:
হামিদ,
সুখবরটা শুনে তুমি এমন করবে, কল্পনাও করিনি আমি। আমার পেটে আমাদের ভালবাসার দ্বিতীয় ফুল। খবরটা জানার পর তোমাকে বলার জন্যে ছটফট করেছি সারাদিন। অনেক রাতে তুমি ফিরলে। তীর্থ-র এত জ্বর, তবু তুমি দেরী করে ফিরলে! কেমন বাবা তুমি? আর এই কথা তোমাকে বলতেই তুমি হুলুস্থুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলে? এই গভীর রাতেও? আমার গর্ভে নতুন অতিথি, সেটা নিয়ে কোন উচ্ছ্বাস কেন নেই তোমার? কেন বাইরে পড়ে থাকে তোমার মন? কী এমন খারাপ আমি?
মায়ের এই ডায়েরীটা পড়ে আমি এক অদ্ভুত আতংক অনুভব করছি। আমার শৈশব-স্মৃতিতে বাবা নেই। আমার খুব ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সেপারেশন। এরপর চূড়ান্ত বিচ্ছেদ। কাজেই আমার দাদা-দাদী আমার মায়ের সাথে কী করেছেন, তা কখনও জানতে পারিনি। বাবার স্নেহ কী, তা যেমন জানি না, বাবার শাসন কী, তাও দেখিনি। মা কেন এসব কখনও বলেনি আমায়? ক’দিন পর আমার বিবাহিত জীবন শুরু হবে। সেটা কেমন হবে? শিহাব বলেছে, ও বিদেশ যাবার আগ-পর্যন্ত ওদের জয়েন্ট ফ্যামিলিতেই থাকতে হবে আমাকে। কেমন হবে সেই জীবন? আমার এই তেইশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শান্তির গানের মতো জীবনের সাথে নতুন সেই জীবনের সুর মিলবে তো? আমি কতটুকু পারব খাপ খাইয়ে নিতে? ওঁরাই বা কীভাবে গ্রহণ করবেন আমায়? কেমন যেন অস্থির বোধ করতে থাকি আমি। ঝিম মেরে মায়ের বিছানায় বসে থাকি কিছুক্ষণ।
একটু পর মা এলো। আমার তখন ভেজা চোখ আর হাতে মায়ের সেই পুরনো ডায়েরী। চকিতে মা বুঝে গেল আমার মনের আবহ। আমাকে কাছে টেনে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কেন এসব ভাবছিস? আমার আর তোর ব্যাপারটা এক নয়। তোর হবু শ্বশুর-শ্বাশুড়ীকে আমি যেটুকু দেখিছি, ওঁরা খুব ভাল মানুষ। খুব পছন্দ করে তোকে। তাছাড়া শিহাব আছে তোর পাশে। ভালবেসে বিয়ে করছিস তোরা…।
মায়ের কথা শুনতে শুনতে আমি চোখ মুছি। মা বলে চলে, শিহাব তোকে আগলে রাখবে। ও খুব ভাল ছেলে। আর তোর মতো মেয়ের জীবনে খারাপ কিছু ঘটতেই পারে না। ওঠ মা, এসব নিয়ে ভাবিস না। তোর ঘরে যা। একটু পড়াশোনা কর, সামনে পরীক্ষা না তোর?
আমি চোখ মুছলাম। তারপর হঠাৎ মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।
৩.
বিয়ের এক মাস হতে চলল। নতুন জীবনে সবকিছুই বোধহয় ভাল লাগে। কীভাবে যে এই এক মাস পার হয়ে গেল, যেন চোখের পলকে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। রাতগুলো কাটে এক অদ্ভূত উন্মাদনায়, আর দিনগুলো কাটে রাতের অপেক্ষায়…।
এর মধ্যেই চলছে আমার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা। শিহাব সারাদিন অফিস করে। আমি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। সেই ব্যস্ততাও মধুর লাগে যখন হঠাৎ ওর ফোন পাই। কখনও কখনও টেক্সট মেসেজ পাঠায় রোমান্টিক কোন কবিতা, কখনও বা ডার্টি জোকস। আমি লজ্জা পাই, আবার খুশিও হই। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই যখন বলে, চল, মোড়ের দোকান থেকে ফুচকা খেয়ে আসি, আমি যেন স্বর্গের চাবি হাতে পাই।
শুরু থেকেই আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর কাছ থেকে ভাল আচরণ পেয়ে আসছি। আমার ননদ শার্লিন কলেজে পড়ে; শিহাবের সাথে প্রেম হবার পর থেকে ও-ও হয়ে উঠেছিল আমার খুব ভালো বন্ধু। এখন তো পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওর সাথেও বেশ আড্ডা জমে। লেখা-পড়ায় আমার সাহায্য নেয় কখনও কখনও। বেশ ফুরফুরে মসৃণ গতিতে এগুচ্ছে জীবন। তবু একটা বিষয় মেনে নিতে পারি না আমি। আমার শ্বাশুড়ীর চোখে এক অদ্ভূত ঈর্ষা দেখি আমি। শিহাব বাসায় ফিরে “আগের মতো” কেন আগে তার মা-কে খোঁজে না, আমি কেন পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে শিহাবের সাথে ফোনে-স্কাইপে এত কথা বলি, রাতে আমরা কেন ছাদে দীর্ঘ সময় কাটাই – এসব নিয়ে আমার আড়ালে তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে শিহাবকে কথা শোনান। আমি সেটা জানতে পারি শার্লিনের কাছ থেকে। মাঝে মাঝে ওকে থামিয়ে দিই। শুনতে চাই না, শুনে কষ্ট পাই বলে। তবু শুনতে হয়…। মাঝে মাঝে ভাবি, জেনে রাখি, মানুষের অদেখা রূপ। মাঝে মাঝে টের পাই শিহাবের কিছু কথা থেকেও, ও যেন ওর মায়ের কথাগুলোই নিজের মুখ দিয়ে বলছে। অবাক হয়েছিলাম যখন বলেছিল, মাঝে মাঝে সকালে বাবার জন্যে রুটি বানিয়ে দিতে, বাবা নাকি এতে খুশি হবেন! ও জানে, আমি রাত জেগে পড়ি, বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। তবু এমন করে কেন বলল ও আমায়? ওর মা শিখিয়ে দিয়েছেন, বুঝতে পারি। কিন্তু ওর বিবেচনাটা কোথায়? এত দ্রুতই কি পুরনো হয়ে গেলাম? এখনই ধরতে হবে রান্নাঘরের হাল?
বিয়ের দিন যে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেটাও মনে দাগ কেটে আছে আমার। মধ্যরাতে বাসর ঘর থেকে শিহাবকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মা, এই কথা বলতে যে, আমার বিয়ের গহনাগুলো যেন তাঁর আলমারিতে রাখা হয়, আমাদের ঘর থেকে চুরি হয়ে যেতে পারে সেই অজুহাতে। শিহাব নীরবে তার মায়ের আদেশ পালন করেছিল। আমাকে সব গহনা খুলে দিতে হয়েছিল ওর হাতে, ওর মা-কে দেবার জন্যে….। সেই রাতে আমি কিছু বলিনি শিহাবকে।
আজ বলব। কারণ, আজ শার্লিনের কাছে জানতে পারলাম, আমার সেসব গহনা থেকে একটা নেকলেস আমার শ্বাশুড়ী তাঁর বোনের মেয়ের বিয়েতে উপহার দিয়েছেন। এবং সেটা করা হয়েছে আমাকে না জানিয়ে। আমার পরীক্ষা ছিল বলে সেই বিয়েতে যাইনি আমি, রাতে “সনি” হলে ছিলাম। এই ফাঁকে কাজ সারলেন তিনি! এত চতুরতা আমি নিতে পারি না। শিহাবের এই অতি-মাতৃভক্তিও আমি নিতে পারি না। আমি মেনে নিতে পারি না, বিয়ের পর একটি ছেলে বিয়ের আগের মতোই আচরণ করবে। বিয়ে অনেক বড় একটি ঘটনা মানুষের জীবনে। মানুষকে আমূল বদলে দেবার মতো একটি ঘটনা। একটি মেয়ে যেমন বিয়ের পর বদলে যায়, ছেলেও তাই। এই ধ্রুব সত্য কিছুতেই মানতে রাজী নন আমার শ্বাশুড়ী।
সন্ধ্যায় শিহাব বাসায় ফেরার সাথে সাথে ওকে বললাম কথাগুলো। হয়তো আমার আরেকটু সময় নেওয়া উচিত ছিল। স্বামী কাজ থেকে ফেরার সাথে সাথে তার সামনে অভিযোগের ঝুড়ি খুলে বসতে নেই, কথাটা বিয়ের আগে মা আমাকে বলেছিল। আমি ধৈর্য রাখতে পারিনি। আমার অভিযোগ শিহাবের মায়ের বিরুদ্ধে, শিহাব এতেই চরম ক্ষিপ্ত। বলল, গহনাটা তোমাকে দিয়েছিলেন আমার মামা। সেটা মা দিয়েছে আমার খালার মেয়েকে। তোমার এত আপত্তি কেন?
- আপত্তি, কারণ ওটা আমার। আমি বিয়েতে উপহার পেয়েছি, সেটা অন্য কেউ কেন আরেকজনকে দিয়ে দেবে?
- অন্য কেউ? আমার মা অন্য কেউ? তার রাইট নেই?
- না! নেই। তোমার মূল্যবোধ এত নিচে নামলো কবে, শিহাব? নাকি মা অন্যায় করলে সেটা অন্যায় নয়? বউ কিছু বললে সেটা দোষ?
- তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, তিথি!
- তুমি ভুল করছ। বদলে গেছ তুমি। বিয়ের আগের তুমি এমন ছিলে না। অনেক কেয়ার করতে আমাকে। এখন এমন ভান করছ, যেন আমাকে বিয়ে করে উদ্ধার করেছ আমায়?
- বাহ! একটু আগেই বললে, বিয়ের পর ছেলেদেরকে বদলে যেতে হয়। এখন বলছ আমি বদলে গেছি, খারাপ হয়ে গেছি? কী চাও আসলে তুমি? তুমি আসলে তোমার ফ্যামিলি থেকে কিছুই শিখে আসোনি। এটাই প্রবলেম।
ঝগড়াটা ক্রমেই কুৎসিত দিকে মোড় নিচ্ছে। শিহাব টেনে আনছে আমার বাবা-মায়ের দাম্পত্যের প্রসঙ্গ। দাম্পত্য কী, পরিবার কী, এসব নাকি আমি বুঝিই না। ওর মায়ের নাকি পূর্ণ অধিকার আছে তাঁর পুত্রবধুর গহনা নিয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার! শুনে আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম।
আর ঠিক তখনই আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন আমার শ্বাশুড়ী। দরজাটা খুলে দিলো শিহাব। ঘরে ঢুকে তিনি বললেন, আমাকে মাফ করো তোমরা, দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে তোমাদের ঝগড়া শোনা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু আমাকে নিয়েই যেহেতু ঝগড়া, তাই তোমাদের মধ্যে একটা কথা বলতে চাই।
আমি আমার শ্বাশুড়ীর এই আচরণে বজ্রাহত। কীভাবে সম্ভব একজন শিক্ষিত মায়ের পক্ষে তাঁর ছেলের ঘরে আঁড়ি পাতা! তিনি আমার বিস্মিত ও বীতশ্রদ্ধ দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শিহাবকে বললেন, তুই কি জানিস, তিথি ফেসবুকে আমাকে নিয়ে কী লিখছে আজকাল?
- না। আমি গত কয়েকদিন ফেসবুকে ঢুকিনি।
- আমি ফেসবুক-টেসবুক চিনি না। শার্লিন তিথির ফেসবুক ফ্রেন্ড। ও বলল, তিথি নাকি লিখেছে, শ্বাশুড়ী কখনও মা হয় না।
এবার আমি ক্রোধে জ্বলে উঠলাম, মিথ্যে কথা! আমি লিখেছি, শ্বাশুড়ী কি পুত্রবধুকে মেয়ে বলে ভাবতে পারে?
- কী? আমি মিথ্যেবাদী? শিহাব শুনলি? কয়েকদিন আগে “পুতুলের বিয়ে” না কী নামে ও নাকি একটা কবিতা লিখেছে। সেখানে আমাকে নিয়ে আরো অনেক কিছুই নাকি আছে।
শিহাব এবার আমার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, এর জন্যে তোমার ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম আমি? আজই তোমার একাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেব।
আমি এরকম উপর্যুপরি আক্রমণে একেবারেই বিধ্বস্ত। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই শিহাবকে আমি ভালবেসেছিলাম। শিহাব কি সত্যিই আমাকে ভালবেসে বিয়ে করেছে? আমি কিছু ভাবতে পারছি না। ওর এই চেহারা আমি দেখব বিয়ের মাত্র এক মাসের মাথায়, এ আমার কল্পনারও অতীত। কান্না রোধ করার কোন চেষ্টাই সফল হলো না। ভেউ ভেউ করে কেঁদে চললাম আমি।
জয়েন্ট ফ্যামিলিতে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়, তা নিয়ে বেশ লম্বা একটা বক্তৃতা শুনতে হলো আমাকে। বক্তা আমার শ্বাশুড়ী ও শিহাব। একটু পর এলেন আমার শ্বশুর। তবে নীরব থাকলেন তিনি। পরিস্থিতিটা যেন এমন যে, আমি এক আসামী, বাকিরা বিচারক। বক্তৃতার ফাঁকে শিহাব এটাও বলল, এখানে থাকতে হলে সবকিছু মানিয়ে থাকতে হবে। এবং ফেসবুকে সাংসারিক কোন বিষয়ে কিছু লেখা যাবে না।
এরপর শিহাব আমাকে বলল, তুমি মা-র কাছে ক্ষমা চাও তিথি।
আমি মূর্তির মতো নীরব, নির্বিকার। আমার শ্বশুর বললেন, থাক, এখন ক্ষমা চাইতে হবে না। ভবিষ্যতে এমন আর করবে না, ঠিক আছে, বৌমা?
তিনি আমার শ্বাশুড়ীকে নিয়ে চলে গেলেন। শিহাব চলে গেল বারান্দায়। আমি চুপ করে সব শুধু শুনলাম। আজ আমি কিছুই বলব না। এ যেন এক ঝড়ের রাত। আর আমি এক দুর্বল গাছ। ঝড়ের দাপট সহ্য করা ছাড়া আমার যেন আর কিছুই করার নেই…।
সমূদ্রের ঢেউয়ের মত একের পর এক কান্নার ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই থামছে না। আজ আমি সারারাত কাঁদব। আজ মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে আমি বড় একা।
৪.
আজ ছিল শেষ পরীক্ষা। সেই ঝড়ের রাতের পর আমি সকালে উঠেই ব্যাগ গুছিয়ে মায়ের কাছে চলে এসেছিলাম। মা সব শুনে বলেছিল, আগে পরীক্ষাটা শেষ হোক। তারপর দেখা যাবে।
- আমি আর ও’বাড়িতে ফিরব না, মা।
- তিথি, আমি চাই না, আমার জীবনের পুনরাবৃত্তি তোর জীবনে হোক।
- আমি কি সেটা চেয়েছিলাম, মা? এখানে আমার দোষটা কোথায়?
- বিষয়টা দোষ-গুনের বিচার নয়। মেয়েদেরকে হতে হয় জলের মতো। যে পাত্রে থাকবে, সেটার আকার নেবে…।
- সেই যুগ নেই, মা। সেই যুগে মেয়েরা নিরুপায় ছিল, অসহায় ছিল। এখন মেয়েরা স্বাবলম্বী। এখন মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করে পড়ে থাকবে না মেয়েরা।
মা আমার সাথে তর্ক করতে নারাজ। পরীক্ষাটা ভাল মতো দিতে হবে, এটুকুই ছিল তার তখনকার চাওয়া। আমিও তর্কে জড়ানোর মানসিকতায় ছিলাম না সেদিন।
এরপর কেটে গেছে দু’সপ্তাহ। আজ পরীক্ষা শেষ করে বাসায় এসে একটা ঘুম দিলাম। ঘুম ভাংলো কলিং বেলের শব্দে। মা বাসায় নেই। অগত্যা আমাকেই গিয়ে খুলতে হলো দরজা। ভাবলাম, মা ফিরেছে।
দরজা খুলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম আমি। দরজার বাইরে শিহাব দাঁড়িয়ে। এই দৃশ্যটা গত দু’সপ্তাহে আমি অনেকবার কল্পনা করেছি। শিহাব আমাকে নিতে এসেছে, আমি দড়াম করে ওর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছি, শিহাব দরজার বাইরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে – এমন দৃশ্য আমি বহুবার কল্পনা করেছি। বাস্তবে তা হলো না। শিহাবকে দেখে আমি দরজা খুলে ভেতরে আসতে বললাম, সোফায় বসতে বললাম, এমন কি, চা খাবে কি না জিজ্ঞাসা করলাম।
শিহাবকে দেখে বুঝতে পারছিলাম, ও বিধ্বস্ত। ওদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর ও কয়েকবার আমাকে ফোন করেছে, আমি ধরিনি। বিভিন্নভাবে টেক্সট মেসেজ করে ক্ষমা চেয়েছে, আমি জবাব দিইনি। বুয়েটের ক্যাম্পাসে পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে একদিন দেখি, আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে ও তখন দেখতে পায়নি, আমি দূর থেকে ওকে দেখে অন্য পথ দিয়ে বাসায় ফিরেছি।
আজ শিহাব আমার মুখোমুখি, চার দেয়ালের এই ঘরটায় আমরা নীরব দু’টি প্রাণী পরস্পরকে শুধু দেখলাম কিছুক্ষণ। একটু পর মুখ খুলল শিহাব, পরীক্ষা কেমন হয়েছে, তিথি?
- ভাল।
- এ প্লাস হবে?
- আমি কি অত ভাল ছাত্রী?
- বুয়েট-লাইফ শেষ, কেমন লাগছে তোমার?
- তুমি কি সেটা জানতে এখানে এসেছ?
- না। একটা কথা জানতে এসেছি।
- কী?
- জীবনে কি আর একটা সুযোগ আমি পেতে পারি না? বাবা-মা গুরুজন। তবু তাঁরা স্বীকার করেছেন, তাঁরা অনুতপ্ত। তোমার জন্যে একটা নেকলেসও কিনেছেন বাবা।
কথাগুলো শুনলাম। বিশ্বাস হলো না। আমার নির্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা হয়তো আন্দাজ করতে পারলো শিহাব। বলল, তোমার মা সব জানেন। তিনি এখন আমাদের বাড়িতে। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন ওখানে।
- ওখানে কেন?
- আজ শার্লিনের জন্মদিন। তুমি হয়তো ভুলে গেছ।
- ও, হ্যাঁ। সরি, ভুল গেছিলাম…।
- তুমি যাবে না, তিথি? প্লিজ!
আমি দ্বিধায় পড়লাম। আমি কি যাবো? নাকি অভিমান করে থাকবো? যে অপমান আমাকে করা হয়েছে, তা কি কেউ ক্ষমা চাইলেই ভুলে যাব আমি? নেকলেস ফেরত দেওয়াই কি এর ক্ষতিপূরণ? এরকম ঘটনা আবার ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
আমার ভাবনায় ছেদ ঘটালো মোবাইল ফোন। মা আমাকে কল করেছে। আমি জানি মা কী বলবে। ফোনটা ধরলাম না।
আমি হয়তো এমন একটা দিনের জন্যে ভেতরে ভেতরে প্রতীক্ষায় থেকেছি। আমি হয়তো শিহাবের এই আহ্বান শোনার জন্যে এতগুলি ঘন্টা, এতগুলি মিনিট ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকেছি। পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে ওর পুরনো টেক্সটগুলো পড়েছি, ফেসবুক ঘেঁটে বের করেছি আমাদের স্মৃতিময় সব ছবি…। আমি জানি, আমি শিহাবকে এতটাই ভালবাসি যে, ওর কোন অপরাধ আমি মনে পুষে রেখে বলতে পারবো না, আমি আর ওকে ভালবাসি না। বরং এই দু’সপ্তাহে বহুবার আমার ইচ্ছে করেছে, সব অভিমান ভুলে ওর কাছে ছুটে যাই।
এবার আমি ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম শিহাবকে। শিশুর মতো কাঁদলাম, আমার চোখের জলে ওর শার্ট ভিজে যাচ্ছে। ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছে আমার চোখ, ঠোঁট, গাল, গ্রীবা, বুক…। কথা নেই কারো মুখে। তবু কত কথা হয়ে গেল দু’জনায়… হাতে হাতে, ঠোঁটে ঠোঁটে…।
নিজেকে সামলাতে বেশ সময় লাগলো আমার। বললাম, তুমি একটু বসো, আমি আসছি।
- কোথায় যাচ্ছ?
- শার্লিনের জন্মদিনে আমি কি এই পোশাকে যাব?
কথাটা শুনে শিহাব হাসলো। সেই সহজ সরল হাসি। চকিতে মনে হলো, কোথায় ছিল ওর এই হাসি, সেই ঝড়ের রাতে? ভাবনাটাকে এখন আর পাত্তা দিলাম না।
কিছুক্ষণ পর আমরা গাড়ি নিয়ে চলে এলাম রাস্তায়। কিন্তু শিহাব ওদের বাড়ির দিকে না গিয়ে গাড়ি ঘোরালো শাহবাগের দিকে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথায় যাচ্ছ?
- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
- কেন?
- এখনই বাড়ি যেতে হবে কেন? সন্ধ্যা হোক!
শিহাব এক হাত দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। আরেক হাত আমার হাতে। মিরপুর রোডে উঠে আমার চোখ গেল আকাশের দিকে। কী অপরূপ সুন্দর আজকের আকাশটা! মেঘাচ্ছন্ন, অথচ সুন্দর! মেঘগুলোর গায়ে এসে পড়েছে অস্তগামী সূর্যের লাল রশ্মি। সে লালিমায় অদ্ভূত এক সিঁদুরে রং পেয়েছে মেঘগুলো। সারি সারি সিঁদুরে মেঘে ছেয়ে আছে গোটা নীল আকাশ। যেন মেঘে মেঘে গড়ে উঠেছে আকাশজোড়া এক বিশাল রংধনু।