(১)
ছুটির দিন সকাল আটটায় ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের শব্দে । অন্যান্য দিন এই সময় আমি অফিসের পথে থাকি। ছুটির দিনে এটা ভোর। বিরক্তি নিয়ে দরজা খুললাম।
জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে মাঝারি আকারের ট্রাভেল ব্যাগ, অন্য হাতে চারটি ঝুনা নারকেল।
- আসসালামু আলাইকুম।
- কী রে, তুই হঠাৎ?
জয়নাল হয়তো এমন অভ্যর্থনা আশা করেনি। ঘুম-ভাঙ্গার বিরক্তির কারণে আমি বোধ করি একটু রুক্ষ আচরণ করলাম। তাছাড়া ফোন না করে হুট করে কেই বাসায় এলে আমি বিব্রত হই। এটা অবশ্য ওকে বলে লাভ নেই।
জয়নাল আমার গ্রামের ছেলে। কিছুদিন পর পর চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসে।
নকল-টকল করে বি এ পাশ করেছে । ওর বাবা আমার বাবার বন্ধু, সেই সুবাদে ঢাকায় এলে ও আমার বাসায় এসে ওঠে। আমার স্ত্রী মনি শুরুর দিকে এ নিয়ে ওজর-আপত্তি করত, আমি সেটা আমলে নিই না দেখে হাল ছেড়েছে।
জয়নাল গোসল সেরে বান্দায় আমার পাশে বসল। আমি তখন খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছি।
- কী জয়নাল, এবার তোর কী ধান্দা? চাকরি না ব্যবসা?
- এবার ভাইয়া অন্য কেস, বলতি এটটু লজ্জা লাগতিছে।
- অন্য কেস? আগের বার শেয়ার ব্যবসায় কয়েক লাখ খুইয়ে তারপর গ্রামে ফিরে গেলি। তার আগের বার কোন দালালকে বিদেশ যাবার জন্য তিন লাখ দিয়ে ঠকলি
- এবার আর ঠকা-ঠকির সিন নেই, এবার ঘটনা সেইরাম
- কীরাম? সেই যে কাকা তোকে দোকান করে দিলেন আর তুই বাকি দিতে দিতে ব্যবসায় লাল বাতি জ্বালালি, সেইরাম? কাকার জমি-জিরাত কিছু অবশিষ্ট আছে এখনও ?
-আব্বা এবার আমারেই বেইচে দেবে।
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। হাসির শব্দে ছুটে এলো আমার আট বছরের কন্যা ইমা।
জয়নাল একটু মনে হয় লজ্জা পেল।
- ভাইয়া, এবারের ব্যাপারডা এহেবারে নতুন। এবার কোনো ইনভেস্ট নেই। পুরোডাই লাভ ।
- কী রকম ?
জয়নালের কাছে যা শুনলাম, তার সারকথা হলো, জয়নাল এবার ঢাকায় এসেছে বিয়ে করতে। পাত্রী কানাডা-প্রবাসী এক বিধবা, ঈদ করতে দেশে এসেছেন, আত্মীয়রা তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের ব্যবস্থা করেছন। বিয়ের শর্ত খুব সহজ, পাত্রকে কানাডা গিয়ে থাকতে হবে, মহিলার রেস্টুরেন্টের ব্যবসা দেখা-শোনা করতে হবে। ঘটক জয়নালের মামার পরিচিত। জয়নাল ও তার বাবা এই প্রস্তাব পেয়ে সানন্দে রাজি। ছবি দেখে পাত্রী পছন্দ করেছে জয়নালকে, ঈদের পর বিয়ে হবে পাত্রীর ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে।
জয়নালের কথা বেডরুম থেকে শুনছিল মনি । বারান্দায় এসে সে জিজ্ঞাসা করল, পাত্রীর বয়স কত?
- বয়স তেমন না, ভাবি, পঁয়ত্রিশ।
আমি বললাম, তোর চেয়ে পাঁচ বছরের বড় মহিলাকে বিয়ে করবি?
- ব্যাপার না ভাইয়া, নবীজিও তো করিছেন।
কথাটা বলে জয়নাল যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে গেল।
- বিদেশ যাবার খুব শখ তোর, জয়নাল?
- শখ কচ্ছেন ক্যান, ভাইয়া? এডা এহন আমার স্বপ্ন...
(২)
ঈদটা ভালই কাটলো। জয়নাল আমার গরু কেনা থেকে মাংস বিতরণ - সব কাজে সাহায্য করেছে নিজের মতো করে। কিন্তু ঈদের পরদিন সন্ধ্যা থেকে ওকে আর খুঁজে পাচ্ছি না। ওর ফোন বন্ধ, গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সেখানে যায়নি ।
আমি অবশ্য এটা নিয়ে খুব চিন্তিত নই । হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া জয়নালের পুরনো অভ্যেস । বছর তিনেক আগের কথা, বি এ পাশ করে চাকরি খুঁজতে সেবার ও প্রথম ঢাকায় এলো । ওর ধারণা ছিল, সার্টিফিকেটের ফাইল হাতে নিয়ে মতিঝিলের অফিস পাড়ায় ঘুরঘুর করলে চাকরি পাওয়া যায়। ওকে বোঝালাম, সেটা একমাত্র বাংলা সিনেমার নায়কদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। খবরের কাগজ ঘেঁটে কয়েকটা Walk-in-Interview আর সেলস এক্সিকিউটিভ এর চাকরির বিজ্ঞাপন বের করে দিয়েছিলাম ওকে। মাসখানেক থেকে বেশ কিছু ইন্টারভিউ দিয়েছিলো, কোনটাতেই লাভ হলো না। ব্যর্থ হয়ে সেবার গ্রামে ফিরে না গিয়ে সে নিরুদ্দেশ হলো। হাত-খরচের টাকা শেষ করে তারপর ফিরলো, জানা গেল, লালনের আখড়ায় মজে গিয়েছিল সে। এর পর ব্যবসা ও বিদেশ গমনের একাধিক প্রচেষ্টা। ফলাফল ঋণাত্মক। তারপর একদিন হঠাৎ আমাকে ফোন। বলল, ভাইয়া আপনি যদি আমারে একটা চাকরি না দেন, তালি গিরামে আমারও ইজ্জত থাকে না, আপনারও থাকে না।
-তোর ইজ্জত থাকে না বুঝলাম, আমারটা নিয়ে টানছিস কেন?
-ক্যান, আপনি আমাগে গিরামের গর্ব। ম্যাট্রিকে ইস্ট্যান্ড। বুয়েটে পড়িছেন। আপনার কি গিরামের ছাওয়াল-পাওয়ালের প্রতি দায়িত্ব নেই?
ওর যুক্তির কাছে মেনেছিলাম। ও জানালো, ও এখন যে কোন চাকরি করতে রাজি। কিন্তু চাকরি ওকে পেতেই হবে। সেবার আমি আমার বন্ধু শিমুলের বায়িং হাউজে ওকে চাকরি জুটিয়ে দিলাম। কাজ সামান্য, বিভিন্ন গার্মেন্টেস আফিস আর ফ্যাকটরী ঘুরে ঘুরে স্যাম্পল কালেকট করতে হবে। আবদুল্লাহপুরে মাস তিনেক কাজটা করেছিল জয়নাল। তারপর হঠাৎ একদিন উধাউ।শিমুল আমাকে ফোন করে অস্থির করে তুলেছিল, থানা-পুলিশও করতে চেয়েছিল। দু’সপ্তাহ পর জয়নাল ফিরে এলো ভারত থেকে। কোন বন্ধুর পাল্লায় পড়ে সে চলে গিয়েছিল সুন্দরবন। সেখান থেকে ভোমরা হয়ে ভারত। চাকরিটা ওর ভাল লাগছিল না। সেটা আমাকে বলতে সাহস পায়নি ওটা আমি যোগাড় করে দিয়েছিলাম বলে।সেবার খুব বকেছিলাম জয়নালকে। বলেছিলাম, ওর চাকরির ব্যাপারে আর আমি কিছু করব না।সৈয়দ শামসুল হকের কবিতাটা বলেছিলাম ওকে: মানুষ এমন তয় / একবার পাইবার পর / নিতান্তই মাটির বলে মনে হয় তার / সোনার মোহর…।
মোবাইলের রিংটোনে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। উত্তরা থানার এক এস. আই. ফোন করেছেন। জয়নাল আছে উত্তরা থানায়। অফিসের কাজ ফেলে ছুটলাম সেখানে।জয়নালকে হাতকড়া পরিয়ে লক-আপ থেকে বের করে আনা হলো। সাথে তার বন্ধু মিজান। মিজানকে চিনলাম, কারণ, গত সপ্তাহে গরুর হাটে ওর সাথে পরিচয় হয়েছে। জয়নালের সে পুরনো বন্ধু, দীর্ঘদিন পর তারা পরস্পরের দেখা পেয়েছিল সেদিন গরুর হাটে।
-ওদেরকে থানায় কেন আনা হয়েছে?
আমার প্রশ্নটা এস.আই, সাহেবকে করেছি। জবাবটা দিল মিজান, ভাই, জয়নালের কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার।
মিজানকে ধমক দিলেন এস.আই.। জানালেন, র্যাব এই দু’জনকে গ্রেফতার করেছে গতকাল সকালে। ওরা এক ভদ্রলোককে অপহরণ করে মুক্তিপণ চেয়েছিল। ভদ্রলোকের আত্মীয়রা র্যাবের সাহায্য নিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন, গ্রেফতার হয় জয়নাল ও মিজান। আজ তাদেরকে কোর্টে চালান করা হবে। চার্জশীট রেডি। কোর্ট থেকে জামিন হতে পারে, না হলে জেল।জয়নালের ফোনটা ডিসচার্জড ছিল। আজ সেটাকে চার্জ করে আমার ফোন নাম্বার যোগাড় হয়েছে।
এইটুকু শুনে আমি বললাম, এস. আই. সাহেব, জয়নালকে ঘটনার বিস্তারিত বলার অনুমতি দিন।
তিনি অনুমতি দিলেন। জয়নালে বক্তব্যটি এরকম:
মিজানের সাথে জয়নাল কলেজে পড়ত। কোরবানির গরুর হাটে তাদের দেখা হয় প্রায় ৬ বছর পর।মিজান ঢাকায় থাকে। ড্রাইভার। গরুর হাটে আড্ডা দিতে দিতে জয়নাল জানায় কানাডা-প্রবাসী নারীর সাথে তার বিয়ের খবর। ঘটকের নাম শুনে মিজান ক্ষেপে যায়। এই লোক গত কোরবানি ঈদের সময় তার কাছ থেকে দুই লাখ নিয়েছিলেন কানাডা-প্রবাসী নারীর সাথে তাকে বিয়ে দিয়ে কানাডা পাঠাবে বলে। মিজানের পাসপোর্টও তিনি জমা নিয়েছিলেন। এরপর থেকে তাঁর অফিস ও মোবাইল ফোন – দুটোই বন্ধ পেয়েছে মিজান। তার হাতে কোন প্রমাণ ছিল না বলে পুলিশকে জানায়নি সে। এই কথা জেনে জয়নাল তক্ষুণি ঘটককে ফোন করেছিল। এখানে একটি বিষয় জয়নাল আমার কাছে গোপন রেখেছিল যে, ঢাকায় এসে সেও তার পাসপোর্ট ও এক লাখ টাকা ঘটককে দিয়েছে। কথা ছিল, ঈদের পর বাকি এক লাখ টাকা জয়নাল ঘটককে দেবে। বিয়ের পর স্ত্রীর কাছ থেকে সে এই টাকা ফেরত পাবে। সেই রাতে জয়নাল ঘটককে ফোন করে বলেছিল যে, ঈদের পরদিন তার এক বন্ধুর বাসায় সে থাকবে, ঘটক যেন এসে টাকাটা নিয়ে যান। সেই প্ল্যান মোতাবেক, তারা ফাঁদ পেতে প্রতারক ঘটককে আটক করে এবং তাঁর পরিবারকে জানায় তিন লাখ টাকা না পেলে তারা তাঁকে ছাড়বে না। ঘটকের ছোট ভাই তখন র্যাবকে খবর দেয় এবং তারপরের ঘটনা আমি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি।
সব শুনে আমি কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে রইলাম। জয়নালকে খানিক বকলাম আমাকে না জানিয়ে এত ঘটনা ঘটাবার জন্যে। সেটা নিয়ে কথা বাড়িয়ে এখন লাভ নেই। আমার এক চাচাত ভাই ওকালতি করেন। তাঁকে ফোন করে আসতে বললাম কোর্টে।
জয়নাল আর মিজানকে প্রিজন ভ্যানে ওঠানো হলো। আমি উঠলাম আমার গাড়িতে। প্রিজন ভ্যানের এক ফালি জানালা দিয়ে জয়নাল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু ওর চোখ দুটো আমার কাছে দৃশ্যমান। বিদেশ যাবার স্বপ্ন আজ সে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু হয়ে…।
-কাজী মিতুল
19.10.2013