খলিফা ইবনে হুবাইরা তাঁকে মুসলিম বিশ্বের প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণের অনুরোধ করলেন। এমন একটা পদ, খলিফার পরই যার প্রতাপ ও খ্যাতি। তিনি তা প্রত্যাখ্যানের মত দৃঢ়তা দেখান। তিনি বলেন, এত গুরুভার বহন করে আবার প্রশাসনকে খুশি করতে আমি যোগ্য নই।
আপনি যোগ্য, তাও মিথ্যা কথা বলছেন।
আমি মিথ্যা বলে থাকলে দ্বিগুণ অযোগ্য।
বৃদ্ধাবস্থায় তাঁকে এই অস্বীকৃতির কারণে ১০ দিন, প্রতিদিন ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে রাজধানীর সড়ক প্রদক্ষিণ করাতে করাতে ১০ টি করে চাবুকের আঘাত করা হতো।
এরপর খলিফা আবু জাফর মানসূর ক্ষমতায় বসেই আবার তাঁকে আহ্বান করেন। তিনি আবারো সরাসরি অস্বীকৃতি জানান। বিচার হয়। বিচারের পর তাঁকে কারাবাস এবং কারাগারে চাবুকের আঘাতের শাস্তি দেয়া হয়।
এরপর তৃতীয়বার খলিফা মানসূর তাঁকে প্রধান বিচারপতি হবার জন্য অনুরোধ করেন। এবার তিনি প্রভুর নামে প্রতিজ্ঞা করেন যে, বেঁচে থাকতে কোনদিন প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করবেন না।
এবার জনসম্মুখে তাঁর পোশাক খুলে নেয়া হয় ত্রিশবার। প্রতিবার চাবুকের আঘাতে রক্তাক্ত করা হয়। অবশেষে না মানাতে পনেরদিন সীমাবদ্ধ খাবার দেয়া হয়। এবং শেষবার না মানাতে কারাগারে বিষ পান করতে বাধ্য করে শহীদ করা হয়।
ইমামে আজম হানাফী মাজহাবের ইমাম নু'মান ইবনে সাবিত, আবু হানিফা আলাইহির রাহমা জন্মগ্রহণ করেন ৬৯০ খ্রিস্টাব্দে। ইমামগণের ইমাম, মুসলিম জাতির প্রদীপ, হাফিজে হাদিস (লক্ষ হাদিসের কন্ঠস্থ সংরক্ষক) এবং ধর্মীয় সিদ্ধান্তদাতাদের পথপ্রদর্শক- তাঁর প্রচলিত উপাধী।
ইমাম আবু হানিফা র.'র জীবন অকল্পনীয়। একাধারে চার দশকেরও বেশি সময় জুড়ে তিনি ইশার নামাজের সময় ওযু করতেন, সেই ওযু থাকা অবস্থাতেই সারারাত নামাজ, পড়ালেখা, যিকর করে ভোরে ফজর পড়ে তারপর ঘুমাতেন।
একজন যদি ৪,০০০ শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন, যে শিক্ষকদের মধ্যে স্বয়ং সাহাবা রা. ছিলেন ৭২ জন! আর বেশিরভাগই ছিলেন সরাসরি আলী রা., আবু হুরাইরা রা., আনাস রা. সহ মহীরুহ সাহাবীদের সরাসরি ছাত্র।
তিনি আঠারো বছর আনাস রা.'র ছাত্র ইমাম হাম্মাদ র.'র কাছে শিক্ষা নিয়েছেন- তার আগেই ২২ বছর বয়স থেকে ছিলেন মুসলিম-খ্রিস্টান-ইহুদি-মূর্তিপূজারক এবং আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসীদের সাথে আলোচনা করে ইসলামের প্রতি অকাট্য প্রমাণ আনার প্রবাদ-পুরুষ, যে ঘটনাগুলোর অনেক উদাহরণ আজো এমনকি যারা তার নামাজকে অশুদ্ধ বলছে, তারাও বর্ণনা করে বেড়ায় সারা পৃথিবীতে।
যিঁনি জ্ঞান অর্জন ও ধর্ম পালনে এতটা অকল্প সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন, তাঁর ধর্মীয় সিদ্ধান্ত কতটা প্রখর হতে পারে! কতটা নির্ভুল হতে পারে!
তাঁর এই শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন জান্নাতের সমস্ত পুরুষদের অধিকারী ইমাম হুসাইন রা.'র সন্তান ইমাম সাইয়্যিদুনা আবু জাফর মুহাম্মাদ আল বাকির রাদ্বিআল্লাহু তাআলা আনহু, ইমাম হুসাইন রা.'র দৌহিত্র ইমাম সাইয়্যিদুনা জায়িদ ইবনে আলী রাদ্বিআল্লাহু আনহু এবং সাইয়্যিদুনা জাফর আস্ সাদিক ইমামে পেশওয়া রাদ্বিআল্লাহু আনহু।
উপরন্তু তিনি ছিলেন সবচে প্রসিদ্ধ তাবিয়িদের মধ্যে একজন। রাসূল দ. বলেছেন, নিশ্চয়তা আছে তিন প্রজন্মের ধর্ম-সিদ্ধান্তদাতাদের দৃঢ়তা ও সঠিকতার বিষয়ে- আমার যুগ, তার পরের যুগ, তার পরের যুগ। তাঁর যুগের পরবর্তী প্রজন্ম হচ্ছেন জীবিত আসহাব রা. গণ। এবং সব শেষের প্রজন্ম হচ্ছেন সরাসরি আসহাব রা. গণের ছাত্র তাবিয়ী র. গণ।
৭০,০০০ হাদীসে তাঁর পরিপূর্ণ দখল ছিল, সেখান থেকে ৪,০০০ হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইসলাম কীভাবে পালন করতে হবে, তার বিশ্লেষণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিতাব উল আতহার (হাদীস গ্রন্থ), আলীম ওয়াল মু'তা আলীম, ফিক্বহে আকবর, জামিলুল মাসানিদ, কিতাবুল র'দ আলাল ক্বদরিয়্যাহ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
প্রতি রোজার মাসে তিনি ৬০ বারের বেশি পূর্ণ কুরআন শরীফ পড়তেন, ৫৫ বার হজ্ব করেছেন, রাতে তাঁকে কখনো দেখা যেত না (ইবাদাত), কুরআন শরীফের এমন কোন সূরা নেই, যা তিনি নফল নামাজেও পড়েননি, কোনদিন কারো দয়া গ্রহণ করেননি, কারো কাছে ঋণ গ্রহণ করেননি, তাঁর কাছে ঋণী লজ্জায় সরে গেলে হাজারো দিরহাম মুহূর্তে অধিকার ছেড়ে দিয়েছেন, পরচর্চা করতে কেউ দেখেনি, দুর্ঘটনার কথা শোনামাত্র খালিপায়ে যে অবস্থায় থাকতেন সে অবস্থায় রওনা হতেন এবং অসুস্থকে প্রতিদিন দেখতে যেতেন, প্রতি বেলায় নামাজের আগেই তিনি কান্না শুরু করে দিতেন, তাঁকে নামাজের এক রাকাআতে পুরো কুরআন শরীফ পড়তে দেখা গেছে, একটা ভেড়া চুরি গেছে- এই সংবাদ পেয়ে তিনি সাত বছর ভেড়ার মাংস খাননি ওই ভয়ে যে, সেই ভেড়াটা হতে পারে।
অথচ এতসব কাজের বাইরে তাঁর সারা জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে শুধুমাত্র কুরআন-সুন্নাহর উপর ভিত্তি করে ইজমা ও কিয়াসের সহায়তায় শরীআহ্ এর একটা পদ্ধতি, যার এক পাশের উপর ভিত্তি করে অন্য পাশ দাঁড়িয়ে থাকবে, তা দাঁড় করানোতে।
তাঁর হাদীস গ্রহণের পদ্ধতি ছিল এমন-
১. কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে হবে।
২. হাদীস সরাসরি রাসূল দ. থেকে তাঁর জানা পর্যন্ত মধ্যবর্তী যারা যারা বর্ণনা করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের চরিত্র-পবিত্রতা-সততা এবং পরিপূর্ণ আজীবন সত্যবাদীতা প্রশ্নাতীত থাকতে হবে। এবং পুরোটা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিশ্চিত হতে হবে।
৩.পূর্ণ গ্রহণীয় বিখ্যাত হাদীসের সরাসরি বিপরীত কোন হাদীসের ব্যাখ্যা জানার পাশাপাশি তিনি সেটাকে অগ্রহণীয় পর্যায়ে রেখে দিতেন।
চার হাজার শিক্ষকের বাইরে তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেছেন স্বয়ং ইমাম হুসাইন রাদ্বিআল্লাহু আনহুর সন্তানের কাছে। বলেছেন, নু'মানের সারা জীবনের সমস্ত অর্জন আহলে বাইতে রাসূল দ.'র দুইবছর সঙ্গলাভের কাছে অকিঞ্চিৎকর।
ক্বাসিদা এ নু'মান এ তিনি দয়াময় রাসূল দ.'র প্রতি আর্জি জানান,
‘O the one!
Who is better than all humans and jinns and who is the treasure of Allah,
please give me from what Allah has bestowed on you
and make me happy like Allah has pleased you.
I am a candidate for your shower of generosity.
There is no one for Abu Hanifah in the entire creation except you.’
এই ইমাম আবু হানিফা র. সরাসরি প্রায় শত সাহাবা রা.'র কাছ থেকে নামাজ-রোজা-হজ্ব-যাকাত থেকে শুরু করে সব বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তখনো হাদিস লেখার যুগই আসেনি, আর সরাসরি সাহাবা থেকে হাদিস যারা শোনেন অথবা হাদিসের অনুসিদ্ধান্ত লেখেন, তাঁরা সব প্রশ্নের ঊর্দ্ধে যেটা কখনোই তাবিয়ি নন, এমন কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
বাংলাদেশের মানুষ আবহমান কাল থেকে যেভাবে নামাজ রোজা থেকে শুরু করে সব করে এসেছে, তা এই ইমাম আবু হানিফা আলাইহির রাহমার জ্ঞান থেকে সরাসরি নিজের বা তাঁর ছাত্রের লেখা পদ্ধতিতে।
আমাদের ইমামে আজম আবু হানিফা সরাসরি সাহাবীদের পিছনে নামাজ পড়েছেন, আর সাহাবারা সরাসরি রাসূল দ.'র পিছনে নামাজ পড়েছেন। আমরা সৌভাগ্যবান যে, পূর্ণ ত্রুটিহীন নামাজ পড়ার এবং জীবনযাপন করার পদ্ধতি আমাদের জন্য সরাসরি সাহাবিদের কাছে দেখে শিখে রেখে কেউ লিখে রেখে গিয়েছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ৯:২১