চাঁদে ব্যক্তির ছবি দেখা যাওয়া নিয়ে অনেক বেশি বিনোদন হয়ে গেছে। অথচ ব্ষিয়টা এত খাটো করে দেখার যো নেই।
আসলেই চাঁদে ব্যক্তির ছবি দেখা যাবে। এতে অসম্ভব কিছু নেই। একটু এগিয়ে যাই-
ক. বিজ্ঞান: অবচেতন মন, রড ও কোন, আলো-আঁধারির খেলা
কসমিক বডি বা হ্যাভেনলি বডির মধ্যে আকাশে তাকালে মাত্র দুটা জিনিস সবচে বড়। কল্পবৈজ্ঞানিক আর্থার সি ক্লার্ক বলেছিলেন, চাঁদ এবং সূর্য এই দুইটা মাত্র আকাশের বস্তুকে আমরা সবচে বড় দেখি। অবাক ব্যাপার হল, চাঁদ আর সূর্য দুইটাকেই আমরা সমআকৃতির দেখি।
কিন্তু চাঁদ সাইকোলজিক্যাল দিক দিয়ে এগিয়ে। কারণ হল, সূর্যের দিকে তাকানো যায় না। আর অন্ধকার রাতে চাঁদকে মনে হয় সঙ্গী, কিন্তু দিনের বেলায় সূর্যকে তা মনে হয় না, কারণ সূর্য এম্নিতেই সব আলোকিত করে রাখে, তাই তার প্রয়োজনীয়তা অপাঙক্তেয়।
আর চাঁদের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তিনটা স্তরে-
১. গভীর জেনেটিক লেভেলে মানুষের পূর্বপুরুষের তথ্য লুকায়িত থাকে। এটা আমরা সবাই জানি। এই কারণেও, চারদিক কৃত্রিম ইলেক্ট্রিক আলোতে ভরপুর থাকলেও আমরা সন্ধ্যার পরপরই অস্থির হয়ে উঠি। প্রাচীণ গুহাবাসী মানব, যারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান কিন্তু শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল ছিল জীবজন্তু থেকে, তারা সন্ধ্যার পরপরই অস্থির হয়ে যেত- সেই জেনেটিক ইনফরমেশন আমরা এখনো বয়ে বেড়াই।
এই একই কারণে চাঁদ আমাদের প্রিয়। আমাদের লক্ষ বছরের পূর্বপুরুষ চাঁদকে আকাশের সঙ্গী হিসাবে পেয়েছেন। একটু আলো। আর তাতেই বাঁচার অনেকটা আশা। তাঁদের তথ্য আমরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি।
২. নিজ নিজ জীবনের শুরুতে। হ্যা। প্রতিটা মানুষ নিজ নিজ জীবনের শুরুতেও চাঁদের কাছে ঋণী। প্রত্যেককেই অন্ধকারের মুখোমুখি হতে হয় এবং চাঁদ সেখানে বিশাল আশা এবং বিরাট বড় একটা সঙ্গী রূপে আবির্ভূত হয়। এই কারণেই অবচেতন মনে চাঁদকে সঙ্গী হিসাবে ভাবার প্রবণতা এবং সঠিক পথপ্রদর্শক হিসাবে ভাবার প্রবণতা মনে গেঁথে যায়। তাই সত্য/ আলো/ পথপ্রদর্শক/ বন্ধু বলতে বারবার তার অবচেতন মন এবং সচেতন মন সংযোগ স্থাপন করে চাঁদের সাথে।
৩. চোখের গাঠনিক লেভেলে। মানুষের চোখ যেহেতু লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আগুন জ্বালানোয় অভ্যস্ত, তাই আর সব বন্য জন্তুর মত আমাদের চোখ রাতে জ্বলে না। আমাদের রড ও কোন বেশিরভাগ পার্থিব প্রাণিরচেয়ে অনেক কম সংবেদনশীল। ফলে, আমরা অন্ধকার এর মধ্যে চাঁদকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিবই। কোন উপায় নেই।
রড ও কোন এই তিন বিষয়ের উপর নির্ভর করে চাঁদে আমাকে সাঈদীকে দেখাবে, যদি আমি সাঈদী নিয়ে খুব বেশি পজিটিভ হয়ে থাকি-
১. ছবিটা কিন্তু কল্পনার, বাস্তবের নয়। কিন্তু মানুষের মন অন্ধকারে ছবি কল্পনা করতে পারে না। এই ক্ষেত্রে অক্ষম। কারণ মন তাই পারে, যা সে বিশ্বাস করে। মন বিশ্বাস করে, ছবি শুধু আলোতে দেখা যায়। মন পারে শুধু আলোকিত জায়গায় ছবিটুকু কল্পনা করতে।
আপনি এবার চাঁদের দিকে তাকান, দেখবেন, পুরো আকাশ অন্ধকার এবং যেটুকু অংশ আলোকিত হয়ে আছে, সেখানে তারই ছবি দেখা যাচ্ছে যাকে নিয়ে আপনি অনেক বেশি ভাবিত এবং ইতোমধ্যে প্রভাবিত হয়ে আছেন। আর আলোকিত অংশটুকু হল স্বয়ং চাঁদ।
খ. মনোবিজ্ঞান: মাস সাইকোজেনিক ইলনেস
মানুষের মন অসম্ভব ক্ষমতাধর। সে মরিয়া হয়ে তাই বিশ্বাস করতে চায়, যা তার মন বিশ্বাস করতে প্রস্তুত + তার প্রিয়জন যা বিশ্বাস করাতে চায় + তার বিশ্বাসভাজন যা বিশ্বাস করাতে চায়।
অন্য কোন কথা মানুষ কখনো বিশ্বাস করবে না। হাজার যুক্তিতে না, লাখো প্রমাণে না।
মাস সাইকোজেনিক ইলনেস বা এমএসআই এর স্ট্যাটিস্টিক্স দেখুন। অবাক হয়ে যাবেন। অন্যের প্রভাবে-
মাথাব্যথায় আক্রান্ত হয় ৬৭% মানুষ
ঘোর এ আক্রান্ত হয় ৪৬% মানুষ
বিবমিষা ভাব বা বমি বমি ভাবে আক্রান্ত হয় ৪১% মানুষ
পেটব্যথায় আক্রান্ত হয় ৩৯% মানুষ
যদি এই ভয়ানক শারীরিক সিম্পটম এসে যায় অন্যের কথায়, তাহলে আলোকিত বিন্দুতে চেহারা কল্পনা তো কিছুই নয়।
আমরা জানি, বাংলাদেশের একটা মেয়েদের স্কুলে একই সাথে ৮০% এর বেশি মেয়ে একই দিনে অজ্ঞান হওয়া শুরু করে। চাঁদে কাউকে দেখা কি এরচে কঠিন? মোটেও নয়। তবে, বুঝতে হবে, এটা একটা গণ অসুস্থতা।
গ. গণবিকার: বিশ্বাসভঙ্গের দ্বারপ্রান্ত, চাপ ও নতিস্বীকারের আরেক রূপ
মানুষ তার অবচেতন ও কিছু ক্ষেত্রে অচেতন মনকেও তৈরি করে সচেতন বাহ্যিক কাজকর্ম দিয়ে।
আর আমাদের অবচেতন মন আমাদের চালিত করে ওই কাজের দিকেই।
অবচেতন বা সাবকনশাস মাইন্ড হল একটা সেল্ফ জেনারেটেড এক্সিলারেটর। আমরা যদি তাকে বারবার খবর পাঠাই, আমি দেবতা... তখন যদি কোনওক্রমে আমার মন কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, আমি দেবতা নই, তখনি মন হ্যালুসিলেশনের আশ্রয় নিবে।
কারণ, যদিও অবচেতন মনকে আমি দীক্ষা দিয়েছি, যে আমি দেবতা, কিন্তু আমি নিজে সেই বিশ্বাস থেকে একটু সরতে নিলে সে কিন্তু স্টেপ নিবে। আমাকে টালমাটাল করিয়ে দিবে।
ঠিক তাই হচ্ছে। জনবিশ্বাস পাল্টে যাচ্ছে। যাকে এতদিন ফেরেস্তা জানতাম, যাকে এতদিন আল্লাহর বাণী পৌছানোর প্রধান মানুষ জানতাম, তার বিষয়ে যে অপরাধগুলো দেখছি সেগুলো তো অস্বীকার করতে পারি না। এমনকি সেই অপরাধগুলো যদি অস্বীকার করিও, তার দলটা যে কাজ করছে, সেটা তো অস্বীকার করতে পারছি না।
একাত্তরে এই দলের বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ উঠেছিল তার প্রতিটাই তো এবার তারা রিপিট করল। মসজিদ পোড়ানো, তালা মেরে দিয়ে পুলিশ পোড়ানো, মন্দির ভাঙা, সনাতনদের উপর আক্রমণ, বারবার পতাকা ছেঁড়া ও পোড়ানো, প্রতিদিন নতুন নতুন শহীদ মিনার ভাঙা, ছয়মাস ধরে পুলিশ আহত করা, ভাল ও ধার্মিক মুসলমানদেরকে নাস্তিক/হিন্দু/ভারতের দালাল/ আওয়ামীলীগ/ নেশাসক্ত/ বেশ্যা আখ্যা দেয়া... তাহলে কি সেই দলের প্রধান একজন হওয়াতে সাঈদী সাহেবও তেমন মানুষ?
এই বিশ্বাস যখন টলতে শুরু করে, তখন মানুষের অবচেতন মনই প্রথমে মরণ কামড় দেয়।
অবচেতন মন বলে, না, তুমি এতদিন যা বিশ্বাস করে এসেছ সেটাই ঠিক। বরং দেখ, তুমি বিশ্বাস করতে পারো এমন একটা অলৌকিক ঘটনা দেখিয়ে দিই।
ঘ. ধর্মতত্ত্বে
অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু হঠাৎ টের পাই, এ পোস্ট হয়ত বেশি লম্বা হয়ে যাবে। এক বাক্যে শেষ করে দেই, ধর্মতত্ত্বে চাঁদে মানুষের ছবি দেখা খুবই কমন একটা বিষয়। কিন্তু এটা তাদের বিষয়, যারা আধ্যাত্ম্যবাদে বিশ্বাসী, অলৌকিকে বিশ্বাসী, অতিমানবিক চেতনা ও মহামানবিক ত্রুটিহীনতায় বিশ্বাসী।
অবাক লাগল এই ভেবে যে, জামাতের মত একটা সম্পূর্ণ অলৌকিকে অবিশ্বাসী দল কী করে চাঁদে সাঈদীকে দেখে?
ঙ. প্রোপাগান্ডার ইতিহাস: অলৌকিক শেষ আশ্রয়
পরাজিত হতে থাকা শক্তি সব সময় প্রোপাগান্ডায় অলৌকিককে শেষ আশ্রয় হিসাবে গ্রহণ করে। যখন হিটলারের পতন হয়ে যাচ্ছিল, সেই সময়টায় নিজের দলের মনোবল রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল নাজিদের। তারা ঘোষণা করতে শুরু করে, ভারতবর্ষ ও আলকেমিস্টের দলদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা মহাজাগতিক শক্তিকে ডেকে আনছে। নরকের দ্বার খুলে যাচ্ছে। আর শুরু থেকেই নিজেদের চুজেন রেইস হিসাবে দেখানোও ছিল হাস্যকর প্রোপাগান্ডা।
উত্তর কোরিয়ায় নেতাদের ঠিক এভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হত। তাদের ঈশ্বর পাঠানো নেতা হিসাবে দেখানো হয় মাত্র একটা কারণে, আর সব বাহ্যিক কারণ উবে গেছে যেজন্য মানুষ তাদের সাপোর্ট করবে। তারা অলরেডি টের পেয়ে গেছে, পতন সম্মুখে।
নেপালে এই কদিন আগেও রাজার পতনের আগ দিয়ে রাজাকে সূর্যের সন্তান, দেবতার সন্তান হিসাবে দেখানো হত।
মিশরে সম্রাটদেরকে যুদ্ধের আগে বেশি করে বলা হত, তারা আমন রা, সূর্যের সন্তান।
ইরাক ও লিবিয়ায় পতনটাকে আমি খুব খারাপ চোখে দেখি। কষ্ট পাই। সুখী দেশগুলোকে ইঙ্গ-মার্কিনরা ধ্বসিয়ে দিল। কিন্তু তাদের নেতাদেরও শেষ পর্যায়ে আর দেশের ক্ষমতার উপর নির্ভর না করে অলৌকিক মহান ব্যক্তিত্ব্য হিসাবে জাহির করা হয়েছিল এবং তাদেরও পতন হয়েছিল ।
ঠিক তেমনি এখন চাঁদের বুকে সাঈদী দেখা যাচ্ছে, মিছিলরত জ্বিন ও ফেরেস্তা দেখা যাচ্ছে।
এর বাহ্যিক অর্থ মাত্র একটা। আমাদের টাকা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, রাজনৈতিক শক্তি, জঙ্গিদের মনোবল, দলীয় স্ট্রাকচার এত বেশি ভেঙে পড়েছে যে, এখন আল্লাহ স্বয়ং সহায়তা করা শুরু করেছেন। আমাদের দিয়ে আর হচ্ছে না, চাঁদের বুকে তাঁকে দেখানো হচ্ছে। আমাদের দিয়ে আর কুলাচ্ছে না, জ্বিন ও ফেরেস্তারা আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করছে।
দ্যাটস ইট।
আর যাদের এই কথা মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে ক্ষ্যাপানো যায়, তারা কোন্ স্তরের মানুষ, সেটা কি আলোচনার অপেক্ষা রাখে?
সবশেষে, যারা চাঁদের বুকে সাঈদী দেখতে রাজি আছে, কিন্তু একাত্তরের গণহত্যা ও সাঈদীদের পাপ দেখতে রাজি নেই-
করুণা রইল। জানি না, এই গণ মানসিক অসামঞ্জস্য থেকে সুস্থ হবে কিনা। কারণ, তোমাদের কর্মকান্ড ও বিশ্বাসই এই শাস্তি নাজিল করেছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহকে করাতে হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:২৮