জন্মদায়িনী মায়ের কথা থেকেই শুরু হোক।
আমার মা পোড়া ভাত শুধু যে খেতে পারেন না, তা নয়, তিনি পোড়া তরকারি বা ভাত বা যে কোন খাদ্য সামনে দেখলেই কিছুটা রিপালসিভ হয়ে ওঠেন।
কারণ? একাত্তর। তিনি তখন অত্যন্ত কমবয়েসি একটা বাচ্চা মেয়ে। তাদের গ্রাম যখন পুড়িয়ে দেয় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী, তখন গ্রামের পর গ্রামের পর গ্রাম কোন খাদ্য ছিল না। অথচ প্রতিটা বাসায় ছিল আলুর মাচা। পোড়া ঘরগুলো খুঁটি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আর ছিল পোড়া আলু।
খেতে পারেন না। খেতে ইচ্ছা হয় না। খাবার উপায় নেই। কিন্তু পোড়া আলু খেতে হচ্ছে। কারণ না খেলে মানুষ বাঁচে না। পোড়া আলু বাসী হয়ে গেছে। গন্ধ। সেটাই খেতে হচ্ছে।
আমরা ব্যক্তিগতভাবে আমাদের মায়ের জন্য লিখতে বসেছি, বিষয়টা এমন নয়।
আমার নানা। কোনদিন কি নামায কাজা করেছেন? হ্যা, হাসপাতালে অপারেশন টেবিল থেকে ফিরে যদি অজ্ঞান হয়ে থাকেন, তো করেছেন। কিন্তু জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে কাযা নামায আদায় করে নিতে দেখেছি তাকে। সেই মানুষটা একাত্তরে ছোট ভাইয়ের লাশ ঘরে রেখে আরেক আপন ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে বসে আছেন। ফুসফুস ফুটো। তিনি ফুসফুস ফুটো ভাইয়ের জন্য দুধ আনতে গেছেন। রাত। হাসপাতালের গেট বন্ধ। তিনি গেটের সামনে ফুটপাতে বসে পড়েছেন। ছোট ভাইটার দাফন হয়েছে কিনা, জানেন না।
পরিচিত একজন পিছন থেকে ডাক দিল, মোল্লা সাহেব...
তিনি চমকে উঠলেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, আমি কিছু করি নাই। আমি কিছু করি নাই।
আমরা ব্যক্তিগতভাবে আমাদের যার যার নানার কথা বলতে বসেছি, ব্যাপারটা এমন নয়।
আমার দাদী, প্রতিদিন শোনেন, মুক্তিবাহিনী আরো মারা পড়ছে। আরো। আরো। তিনি মাসের পর মাস রোজা রাখেন। বাসায় ভাত চড়ে না। তিনি বলেন, আল্লাগো, তোমার নবীর দোহাইগো আল্লা, আমার পোলাটারে ফিরাইয়া দেও।
বাবা ফিরে এলেন, দাদা বললেন, দেশ স্বরাজ করছ, খুব ভাল করছ ভাবা। আমার বাড়িত একটা লুটে টেকা যেন না আহে।
আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের দাদী ও দাদার কথা, বাবার কথা বলতে আসিনি।
আমরা বলতে আসিনি ওই আত্মীয়ের কথা, যার তিন চার মাসের স্ত্রী রেখে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। হয়ত অন্ত:সত্ত্বা। কে জানে? কে বলতে পারবে?
বলতে আসিনি ওই রাজাকারের কথা, যাকে আমাদের আত্মীয়রা চেনে, যে এখনো পাকিস্তানে বসবাস করছে অথবা তার নামে অন্য কেউ।
না, আমি আমার মায়ের কথা বলব না। বলব না, তিনি নৌকা দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলায় অন্যগ্রামে যাবার সময় শুধু শকুন দেখেছিলেন। শকুনগুলো শুধু লাশের উপর বসে। আর লাশগুলো টুপ করে ডুবে যায়।
আবার বসে। আবার ডুবে যায়।
হায়রে, মাঝি নৌকা বাইতে পারে না। বৈঠা শুধুই লাশের গায়ে লেগে যায়।
হ্যা। আমরা প্রথম থেকেই ওই লাশগুলোর কথা বলতে এসেছি।
এবং আমরা বলতে পারি না, কুৎসা আমাদের মুখ বন্ধ করে দেয়। চেপে ধরে। দুর্গন্ধযুক্ত করতে চায় আমাদের।
তখন আমরা চিৎকার করে উঠি। বলি, ওই লাশগুলোর চেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত সত্য আর কোনদিন কোনকালে কোথাও ছিল না।