somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রখর রৌদ্রে কোমল জোছনার কথকতা

০১ লা মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পাঁচজন মানুষ। পৃথিবীর পাঁচ কোণায়। প্রায় সমদূরত্বে। ইরান-তুরান, অ্যামেরিকা, জাপান, ফ্রান্স-ক্যানাডা আর ভারত-পাকিস্তানে। বিষয় মাত্র একটা, বিষয় একই, প্রখর রৌদ্রে কোমল জোছনার কথকতা।

মিল নেই ভাষায়, ধর্মে, গোত্রে, জাতিতে- কিছুতেই মিল নেই। মিল শুধু অন্তর্গত ব্যাপারে। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রোডিজি। সত্যিকার মেধাবী। জীবনের প্রথমদিকেই তাঁদের প্রত্যেককে পেতে হয়েছে অকল্পনীয় আঘাত অথবা বাঁধা। প্রত্যেকেই অসাধারণ জ্ঞানী। প্রত্যেকেই জাদুময় ব্যক্তিত্ব্যের অধিকারী। এবং সবচে বড় কথা, প্রত্যেকেই মনেপ্রাণে কিছু একটা বিশ্বাস করতেন এবং সেই বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়ার সামর্থ্য তাদের ছিল নিজ দেশ ও ভাষার বাইরেও। এবং আরো একটা বিষয়ে মিল আছে যা ক্রমপ্রকাশমান।

প্রথমজন হাসান ই সাব্বাহ। ১০৫০-১১২৪। ১৭ বছর বয়সে নাজিরি মুসলিম সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে এসে ইসমাঈলিয়া শিয়া মুসলিম ধর্মমত গ্রহণ করেন। সেখান থেকে আংশিক বেরিয়ে এসে, ইরান ত্যাগ করে উত্তর আফ্রিকা গিয়ে আবার ফিরে এসে গঠন করেন হাশিশান গ্রুপ।

দ্বিতীয়জন জোসেফ দ্য মামব্রো। ১৯২৪। রোজিক্রুশিয়ান কাল্ট থেকে আংশিক বেরিয়ে এসে নিজ দেশ ফ্রান্স ছেড়ে ক্যানাডায় পত্তন গেড়ে তৈরি করেন অর্ডার অভ দ্য সোলার টেম্পল।

তৃতীয়জন শোকো আশাহারা। ১৯৫৫। চিজিও মাৎসুমুতো নাম ও জেন বৌদ্ধিস্ট ধর্ম ঘরানা থেকে আংশিক বেরিয়ে এসে, মাতৃভূমি জাপান থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষে ঘুরেফিরে ফিরে গিয়ে গঠন করেন ওম শিনরিকয়ো।

চতুর্থজন ডেভিড কোরেশ। ১৯৫৯। জন্মগত ভার্নন ওয়েন হাওয়েল নাম ও খ্রিস্টধর্ম থেকে আংশিক বেরিয়ে এসে গঠন করেন ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান সেক্ট বা ফিরকা।

পঞ্চমজন আবুল আলা মওদুদী। ১৯০৩-১৯৭৯। নিজ মতবাদ ওয়াহাবি ইসলাম থেকে আংশিক বেরিয়ে এসে, মাতৃভূমি ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে গিয়ে গঠন করেন জামায়াত ই ইসলামি।

হাসান ই সাব্বাহ জানতেন, মানুষ বেহেশত চায়। আর তাঁর দরকার ছিল নব্যদীক্ষিত হয়েছেন যে মতবাদে, সেই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা। মানুষ চায় বেহেশতের সুরা, হুররূপী নারী। আর তাঁর দরকার ছিল ভাঙের শরবত, তাঁর দরকার ছিল ভাঙ খাইয়ে কিছু দক্ষ যোদ্ধাকে তাঁর গুপ্ত পার্বত্য বাগানে নিয়ে গিয়ে নারী সংস্পর্শে নিয়ে এসে মাতাল অবস্থা কাটার আগেই আবার 'বাহিস্ত' বা পর্বত থেকে নামিয়ে এনে পরে এই অনুভূতি দেয়া, যে তিনি চাইলেই বেহেস্তে নিয়ে যেতে পারেন এবং এরা তার অধীন সুতরাং গোপনে যাও এবং খুন করো যাকে আমি করতে বলি। বিনিময়ের বাহিস্ত এ তো তুমি গেছই। এই ভাঙের নাম হাশিশ, আর যারা হাশিশ খেয়ে খুন করত তারা হল হাশিশান, আর হাশিশান থেকে ইংরেজি শব্দ অ্যাসাসিন আসে।

জোসেফ দ্য মামব্রো হতাশ তাঁর কাল্ট নিয়ে। আগেই হতাশ হয়েছেন খ্রিস্ট ও মুসলিম ধর্ম এবং ইহুদিবাদ নিয়ে। বেরিয়ে এলেন অনেকটাই, একত্র করতে চাইলেন খ্রিষ্ট-মুসলিম-ইহুদিবাদের সমস্ত শাখা প্রশাখাকে। কিন্তু নিজেই বিশ্বাস করে বসলেন, এই পৃথিবী আর বেশিদিন টিকবে না। যা করার এখনি করতে হবে। প্রস্তুত হতে হবে মহাজাগতিক সফরের জন্য। কিন্তু কসমিক যাত্রা শুরু করতে হলে যে সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এই সত্য সবাইকে জানাতে হবে! ভোতা কাঠ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করতে হবে আপন সন্তানকে, তাহলেই 'সেই' প্রভু খুশি হবেন। আর আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করতে হবে!

শিশু শোকো আশাহারা নানা দিক দিয়েই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। এই প্রতিবন্ধীতা কাটাতে গিয়ে সে শিখল অনন্ত আনন্দের আকর, মুক্তির আকর ধ্যান। কিন্তু তার তৃষা মেটে না। সারা পৃথিবী ঘুরে, ভারতবর্ষে ঘুরে সে টের পেল, পৃথিবী নষ্টদিকে যাচ্ছে। টোকিওর পথে পথে চলতে থাকা মানুষ শুধু টাকা আর নিছক সামাজিকতার দিকে যাচ্ছে। সুতরাং তাদের শিক্ষা দাও। প্রভু এসেছেন, তিনি সেরেন গ্যাসের আক্রমণ করলেন টোকিওর সাবওয়ে রেলে। বহু লোক মারা পড়ল এক আক্রমণে।

ডেভিড কোরেশ চৌদ্দ বছর বয়েসি কুমারী মাতার সন্তান, তার মায়ের বয়ফ্রেন্ড ডেভিডের জন্মের আগেই আরেক মেয়ের সাথে চলে গেছে। কী কষ্ট! কী লড়াই! না, এ লড়াই এভাবে করবে কেন কোরেশ? সে ঘোষণা করল, সে-ই জেসাস ক্রাইস্ট রিবর্ন। ড্রাগ নাও, যত খুশি নেশা করো, সব নারী মহান শেষ পয়গম্বরের (!) ভোগ্য।

পৃথিবীর সবচে সৌকর্যময় রাজ্যের সবচে সুষমামন্ডিত রাজার দেশ, হায়দ্রাবাদে আবুল আলা মওদুদী দেখল, সব বুজরুকি। আধ্যাত্মিকতা বলতে কিছু নেই। রূহানী ক্ষমতা বলতে কিছু নেই। পারফেকশন বলতে কিছু নেই। সব বুজরুকি। ইসলাম ধর্ম আসলে এসেছে শুধুই রাজনীতির জন্য। এক আল্লাহকে মানো, আর সবার উপর আল্লাহর নীতি চাপিয়ে দাও। সব পাপ মাফ। শুধু যেভাবে পারো সবার উপর আল্লাহর নীতি চাপিয়ে দাও। হায়দ্রাবাদে সমস্যা, করাচিতে গিয়ে সেখানেও সমস্যা। এমনকি তার যে নীতি, সেই ওয়াহাবি মতবাদেও সমস্যা, ওয়াহাবি মতবাদ হাদিস মানার ভাণ করে, কিন্তু হাদিস মানতে গেলে কিছুই হয় না। সবই ভুল। সব নবীর ভয়ানক সব ভুল আছে। সব সাহাবির ভয়ানক সব ভুল আছে। সবই ইম্পার্ফেক্ট। পারফেকশন মাত্র একটা জায়গায়, কোনক্রমে আল্লাহর মতবাদ প্রতিষ্ঠা করো। যে-ই বিপরীতে যাবে, তার মরণ। কাদিয়ানির মরণ, সমস্ত হিন্দুর মরণ, সমস্ত বাঙালির মরণ। রাজ্যগঠনই ইসলাম।

এর পরেরটা খুব দ্রুত বলে ফেলি, প্রখর রৌদ্রের কথা আর কত?

হাসান আল সাব্বাহর দলকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। জোসেফ দ্য মামব্রোর দলকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। নিশ্চিহ্ন করা হয় ডেভিডকে, তার আস্তানায় ডেল্টা ফোর্স পাঠিয়ে। শোকো আশাহারাকে নিশ্চিহ্ন করা হয় তার প্রতিটা অনুসারীকে শুদ্ধপথে নিয়ে আসার সাইকোথেরাপি দিয়ে এবং তাকে আজীবন কারাবন্দি করে।

এই পাঁচটা দলকেই যারা সাপোর্ট করেছে, তৃণমূল পর্যায়ে তারা সবাই একেবারেই সরল। নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল এবং মোহগ্রস্ত। তাদেরকে ভয়ানক থেকে সাধারণ মানুষের কাতারে নামিয়ে আনা খুব সহজ ছিল, শুধু বিষয়টাকে উপড়ে ফেলা, বিষয় যারা অনুসরণ করে তাদের নয়।

প্রখর রৌদ্র থেকে কোমল জোছনায় পৌছতে হলে কঠিনের পথ পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু কঠিনের পথ হত্যা নয়, হত্যা করায় বাধ্য করাও নয়।

ভাই, তোমরা শুনতে পাচ্ছ? তোমরা বুঝবে। বোঝালে তোমরা বুঝবে।

*ইমন জুবায়ের ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা। ইমন জুবায়ের ভাইয়ের দর্শন বিভাগ থেকে এই বিষয়গুলো জেনেছিলাম। তিনি আজকে থাকলে কতই না সুন্দর করে আমাদের কাছে বিষয়গুলো উপস্থাপন করতেন!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:২৮
৩১টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×