ছবি: এই জাবাল আন নূর বা আলোর পাহাড়ের হেরা গুহার দিকে তাকিয়ে যদি কিছু আমরা উপলব্ধি করতে পারি...
গুহাশ্রয়ী
পৃথিবীতে সব ধর্ম, সব ভাষা, সব মতবাদ পাশাপাশি অবস্থান করে। এতেই সৌন্দর্য। এতেই সাম্য। আমাদের প্রিয় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া আসহাবিহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন, কালোর উপর সাদা অত্যাচার করছে। পারসিক সাম্রাজ্য রোমান সাম্রাজ্যের উপর যুদ্ধ চালাচ্ছে শত শত বছর ধরে। আবার উভয়ে অত্যাচার করছে আরবদের উপর। বেদুঈন অত্যাচার করছে নগরবাসীর উপর। ধনী দরিদ্রের উপর। পুরুষ নারীর উপর। ধর্মের নামে খ্রিস্টান, ইহুদি ও আরব পৌত্তলিকদের পারস্পরিক বর্বরতা তিনি দেখলেন। আরব মুওয়াহিদদের নিশ্চুপতা দেখলেন। চিন্তাক্লিষ্ট মনে দীর্ঘ পনের বছর মানবজাতির মুক্তির জন্য সাধনা করলেন নিজের বাড়ি থেকে কয়েক মাইল দূরের হেরা গুহায়- কীভাবে এই মানবজাতিকে মুক্তি দেয়া যায়?
শান্তি ও সমর্পণই ইসলাম
সেই রাসূল দ.'র ইসলাম এলো। ইসলাম এলো তীব্র আলো নিয়ে। যে কোন মানুষ যে কোন ধর্ম নিজের ইচ্ছামত পালন করতে পারবে। এটাই ইসলাম। নারীর অনুমতি ব্যতীত তাকে কারো হাতে তুলে দেয়া যাবে না, এটাই ইসলাম। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর মহত্তের কথা প্রচার করতেই থাক, যে পর্যন্ত মানুষ বুঝতে না পারে- তাই ইসলাম।
সহাবস্থান ও সমর্মীতাই ইসলাম
রাসূল দ.'র যুগেও নাস্তিক ছিল। কুরআনের আয়াতেই তা স্পষ্ট। তারা আল্লাহ ও পরকাল সহ কর্মফলকে পুরোপুরি রিজেক্ট করে। কুরআনে তাদের নিজের নাফসের উপর যুলমকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলাম বলছে, আশপাশের চল্লিশ ঘর পর্যন্ত প্রতিবেশী। প্রতিবেশী কেউ না খেয়ে থাকলে হবে না- প্রতিবেশীতে মুসলিম অমুসলিম যুক্ত করা হয়নি।
ইসলাম সেই ধর্ম, যেখানে একজন ইহুদি আর একজন মুসলিম এলেন রাসূল দ.'র কাছে বিচার নিয়ে। তিনি ইহুদিকে পার্থিব বিষয়ে ন্যায়ের পক্ষে দেখে তার দিকেই রায় দিলেন। খ্রিস্টান রাজা তাঁর কাছে হন সম্মানিত। এমনকি তাঁর সাথে এতটাই সৌহার্দ্য যে, তাঁর সাহাবী রা. গণ খ্রিস্টান রাজার মেহমান হয়ে হিজরত করেন। খ্রিস্টানগণ মসজিদে নববীতে এসে প্রার্থনার জন্য বেরুতে চাইলে তিনি বলেন, এই স্থান কি তোমাদের কাছে যথেষ্ট পবিত্র লাগছে না? তাঁর পথের উপর কাঁটা বিছানোর কথা কে না জানে!
তিনি নিজে শুধু উঠে দাঁড়াননি যে কোন মানুষের লাশ দেখে, শিক্ষা দিয়েছেন। সেই শিক্ষা তাঁর সাহাবীরা বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করেছেন।
এই মহামহিম মুহাম্মাদ দ. তাঁর যুগের সবচে বড় ন্যায়বিচারক ছিলেন প্রথাগত ইসলামের আগেই। তাঁর ঘোরতর শত্রুরাও তাঁদে আল-আমীন, বিশ্বাসী বলতো। এমনকি তাঁকে হত্যার জন্য যারা রাতের আঁধারে যুক্তবাহিনী প্রেরণ করে, স্বয়ং তাদের সম্পদ ছিল এই রাসূলের দ. ঘরে। গচ্ছিত, আমানাহ। তিনি এই আমানাহ হাদ্বরাত আলী রা.'র কাছে বুঝিয়ে দিতে কুন্ঠা করেন না।
তাঁকে তিন বছর পরিবার সহ নির্বাসন দেয়া হল মক্কার পাহাড়ে। হায়রে কষ্ট! হায়রে কষ্ট! খাবার নেই, পানি নেই। গাছের পাতা খায় যেজন সারা পৃথিবীর ব্যথার ব্যথী! উটের চামড়া কোনমতে সামান্য পানিতে সিদ্ধ করে খায় মানবতা ও পারস্পরিক সহাবস্থানের কান্ডারী। গাছের পাতা খায় মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ দ.। কিন্তু একবারের জন্য বলেননি, আল্লাহ, তুমি এদের ধ্বংস করে দাও।
আজকের কিছু 'নাস্তিকের' মত সেদিনও তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছিলেন লোককবি হাসসান বিন সাবিত। সেই হাসসান বিন সাবিত রা. পরবর্তীতে উল্টো হয়ে গেলেন নবীর কবি, বললেন,
ইয়া রাসূল আল্লাহ! আপনাকে প্রভু তৈরি করেছেন কুল্লি আয়েব ছাড়া (সকল দোষত্রুটি মুক্ত করে)!
এই হল ইসলাম। এই হলেন ইসলামের নবী।
তাঁকে নিয়ে বাণিজ্যের পসরা আজ
অথচ আজকে তাঁকে নিয়ে বিচিত্র বাণিজ্যের পসরা। তাঁর নামে ভোট চাইলে ভোট পাওয়া যায়। তাঁকে ব্যঙ্গ করে পোস্ট করলে হিট পাওয়া যায়। যে ব্যক্তি, ধর্মবেত্তা মুহাম্মাদ দ.'র বিষয়ে সমকালীন বিরোধী আরবরাও কাজ, চরিত্র, নীতির দিক দিয়ে তাঁকে সরাসরি মানতো, সেই রাসূল দ.'র বিরোধিতা করে শুধু নয়, তাঁর চরিত্রের উপর কালি লেপনের চেষ্টা করা হচ্ছে অনেকদিন থেকে। নাস্তিকতা আর সব ব্যক্তিগত স্ট্যান্ডের মতই একটা পজিশন। এই পজিশন তখনি প্রশ্নবিদ্ধ হবে যখন ব্যক্তি বা ধর্মবেত্তা রাসূল দ. কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে এবং এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে ঘোষণা দিয়ে হাসাহাসি করার ব্যানার ঝুলিয়ে রাখা হবে। আর এই অতি আগে থেকে চলে আসা নগ্ন কাজের জন্য আজকে বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আস্তিক, নাস্তিক, বাঙালি, অবাঙালি নির্বিশেষে বাংলাদেশীদের জাতীয় দাবি, মুক্তিযুদ্ধে দলীয় সিদ্ধান্তে অকল্পনীয় অপরাধকারী জামাতে ইসলামের অপসারণ ও রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি গোলাম আযম, কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী সহ নেতাদের গণহত্যায় নেতৃত্বের দায়ে, দেড় কোটি বাঙালিকে দেশছাড়া করার দায়ে, পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্রহ্মপুত্রকে লক্ষ লক্ষ লাশের আস্তাকুড় করার দায়ে, দুই মতান্তরে চার লক্ষ নারীকে শিয়াল কুকুরের মুখে ছেড়ে দেয়ার দায়ে, মা মাতৃভূমি মাতৃভাষার সাথে বেঈমানী করার দায়ে প্রাপ্য সর্ব্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাচ্ছে।
তবে হা হতোস্মির বিষয় হলো, এই অনলাইন প্রচারণা মূলত শুরু হয়েছিল জামাত যখন ক্ষমতায়, সেই সময়টাতে। তারা তখন কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। কোন সরকারি ব্যবস্থা নেয়নি। অথচ আজকে এত বছর পর, সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেটে সমস্ত ব্লগারদের বানানো হল নাস্তিক। এই পুরনো কাসুন্দিতে রাসূল দ.'র অবমাননা নেই। কারণ, সেটা অনেক আগেই হয়ে গেছে। বরং দলীয় নেতাদের অবমাননা ঠেকাতে তারা উদ্বুদ্ধ করল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে। সাধারণ মুসলমান ও কিছু উগ্রপন্থী ভাবধারাকে। সাথে নিল বিভিন্ন নিষিদ্ধ সংগঠন।
এবং তাদের মুখের বাণী কী বলছে?
একাত্তরে যেমন বলেছিল, পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দু মুক্ত করতে হবে, ঠিক তেমনি সুর। তথাকথিত হিন্দু মুক্ত করা তো রাসূল দ.'র ধর্ম নয়। তাঁর রাষ্ট্রে ইহুদি, খ্রিস্টান, মূর্তি পূজারী, নক্ষত্রপূজারী এমনকি অগ্নি উপাসকরা অতি স্বাভাবিকভাবেই ধর্ম পালন করে গেছে। ধর্ম পালন করে গেছে সাইয়্যিদুনা সিদ্দিকে আকবর রা.'র সময়, ফারুকে আযম রা.'র সময়, যুন নূরাইন রা.'র সময়, আসাদুল্লাহিল গালিব রা.'রও সময়।
অবাক লাগে, ফারুকে আজম রা.'র সময়কালে একজন বিধর্মীর প্রদেয় ট্যাক্সের পরিমাণ ছিল একজন মুসলিমের প্রদেয় ট্যাক্স থেকে অনেক অনেক কম।
একাত্তর সালের মত করে ব্লগার বা নাস্তিক যিকির ধরে আবারো বাংলাদেশের মানুষ নিধনের পথে নেমেছে তারা। এই ব্লগারদের মধ্যেও নব্বইভাগ মুসলিম। জাতির পতাকা খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন। যে ইসলামকে সামনে আনা হচ্ছে, যে ইসলামের কথা বলা হচ্ছে, তা শুধুই প্রতিশোধের একটা বাহ্যিক খোলস। ইসলাম কখনো নয়। পতাকা টেনে হিঁচড়ে মাটিতে নামানো মানে বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষকে টুকরা টুকরা করে মাটিতে নামানো। শহীদ মিনার ধ্বংস করা মানে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে গুঁড়ো করে দেয়া। এই কষ্ট বাংলাদেশের মানুষ রাখবে কোথায়?
সামান্য কয়েকজন জাতিগত হত্যাকারীকে রক্ষা করার জন্য গৃহযুদ্ধের ঘোষণা। সামান্য কয়েকজন গণধর্ষণনেতার জন্য প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার কাজ আটকে হরতাল।
আহা, এই জিঘাংসা, এই তীব্র অপপ্রচার- হেরা হতে হেলে দুলে আসতে থাকা আমাদের নূর নবী হাদ্বরাতের কথা তাদের একবারও মনে পড়ে না! ধর্মঅবিশ্বাসী যারা তাঁর বিষয়ে অপপ্রচার চালিয়েছিল, তাদের দাঁড়াতে হবে আয়নার সামনে। নিজ বিবেকের আরশী নগরের সামনে। আর যারা স্বয়ং বাংলাদেশ ও তার পতাকা-মিনারকে ধূলিস্মাৎ করল, তাদের এই রাসূল দ.'র সামনেই দাঁড়াতে হবে কিয়ামতের সময়টাতে।
তাঁর অধিকার হরণ হচ্ছে। বাংলাদেশটাকে অবশেষে পরিণত করা হচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক এর মত হাজার যুদ্ধ আর বোমা হামলার দেশে। হায় সেলুকাস! আর তা করছে তারাই, যারা তাঁকে সামান্য দোষে গুণে ভরা মানুষ হিসাবে উল্লেখ করে। নিজামীর মত বর্বর ব্যক্তিকে যারা তাঁর সাথে তুলনা করে। তাঁর সেই সহাবস্থান ও মৌলিক প্রত্যাশার বুকে ইসলামের নামে যারা ছুরি চালিয়ে দিল, ওদের জবাব দিতে হবে।
আর সময় থাকতে বাংলাদেশের মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে, বাংলা হবে আফগান যারা বলেছিল, তারা কোন আফগান উপহার দেয়ার ক্ষমতা রাখে? পাকিস্তান আবার পুন:প্রতিষ্ঠিত হবে যারা এখনো আশা করে তারা কোন পাকিস্তানের মত বাংলাদেশ গড়তে চায়?
অসহনশীল মানুষ কখনো পাশাপাশি বাস করতে পারে না। অসহনশীল সব মতবাদই ক্ষতিকর।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:২৪